Select Page

আমাদের আধুনিক থ্রিলার ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’

আমাদের আধুনিক থ্রিলার ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’

 ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ চলচ্চিত্রে বাঁধনের চরিত্রের যে শক্তি সেটা হলো ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে ভিকটিমকে নিজের আবেগ দিয়ে অনুভব করানো এবং তার পরিণতিকে নিজের পরিণতির মতো করে ভাবা…

আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে থ্রিলার ছবির অভাব আছে যথেষ্ট। এখনো যে-কোনো বাংলাদেশী থ্রিলার ছবির উদাহরণ দিতে বললে ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মালেক আফসারীর ‘ক্ষতিপূরণ’ ছবির কথা অনেকেই বলে জনপ্রিয়তার বিচারে। এরপর খুব উল্লেখযোগ্য হিসেবে থ্রিলারের উদাহরণ তেমন একটা আসেনি। ডিজিটাল সময়ে এসে বেশকিছু থ্রিলার ছবি নির্মিত হয়েছে যার মধ্যে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ভালো প্রচেষ্টা ছিল বিশেষ করে ভিলেনের আলোচনায়। থ্রিলারের অপর্যাপ্ত অবস্থায় ২০২৫ সালে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন ফ্লেবারে নির্মিত হলো ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ ছবি।

আমরা যারা মডার্ন থ্রিলারের কথা বলি তারা দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির উদাহরণ দিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি আমাদের পাশের দেশ হিসেবে। সেক্ষেত্রে মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রির কথা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এ ইন্ডাস্ট্রির থ্রিলার মুভিগুলোতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে রহস্য উন্মোচন বেশি দেখানো হয়। ‘এশা মার্ডার’-এ যেন ঠিক সেরকম একটা ভাইব রয়েছে। এ ছবিতে অস্ত্রের ঝনঝনানি বা ভায়োলেন্সের থেকে মনস্তাত্ত্বিক দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

‘এশা মার্ডার’-এর পরিচালক সানী সানোয়ার বাস্তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা। তিনি এত পরিণত ছবি নির্মাণ করেছেন এটি আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপারই বটে। ছবিটি বাংলাদেশে আর পাঁচটি থ্রিলারের প্যাটার্নে হয়নি। ছবিটির স্টোরি টেলিং এমনভাবে এগিয়েছে মনে হবে এখানেই শেষ রহস্য কিন্তু না শেষ থেকেই আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে এবং চূড়ান্ত রহস্যের উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত আবারও নতুন করে সাসপেন্সের জন্ম হচ্ছে। এই অ্যাঙ্গেলটি আমাদের এখানকার থ্রিলার ছবিতে নতুনই বলতে হবে।

একটা কথা আছে ‘কারমা হিটস ব্যাক’। এটা কোনো না কোনোভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবেই যদি সে কারো প্রতি অন্যায় করে থাকে। ‘মহানগর’ সিরিজের কথাই ধরুন যেখানে ওসি হারুন বলছেন-‘দুইটা জিনিস সবসময় মনে রাখবা, কর্ম আর কর্মফল কখনো পরিবর্তন করা যায় না।’ ‘এশা মার্ডার’ সেই কর্মের দোষে অবধারিতভাবে আসা কর্মফলের ছবি। ছবির শেষ দৃশ্যের সাথে এটার মিনিং পরিপূর্ণভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

ছবির গল্পটা সিম্পল কিন্তু এর এক্সিকিউশন ঘোলাটে আর ঠিক এ কারণেই ছবিটি অনেক পরিণত কাজ হয়েছে। এশা নামের মেয়েটির জীবনের গল্প যে মর্মান্তিকভাবে খুন হয়েছে। তার খুনকে ঘিরে যে রহস্যের জাল ছড়িয়েছে তাকে খুব নিখুঁতভাবে পোট্রে করা হয়েছে।

ছবির নাম ভূমিকায় পূজা ক্রুজ নামের নতুন অভিনেত্রী হলেও আজমেরী হক বাঁধনই যেন এশা হয়ে উঠেছে মন থেকে। বাঁধনের চরিত্রের যে শক্তি সেটা হলো ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে ভিকটিমকে নিজের আবেগ দিয়ে অনুভব করানো এবং তার পরিণতিকে নিজের পরিণতির মতো করে ভাবা। বাঁধন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছবিতে উপস্থিত, তার অভিনয়দক্ষতা বলে দেয় ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর পর তাকে আমাদের সেভাবে উপযুক্ত ক্যারেক্টারাইজেশন দেয়াই হয়নি। তার চোখ যেমন কথা বলে, সাইলেন্ট অ্যাকটিং ঠিক তেমনই গভীর। মুখে কথা না থেকেও চোখ কথা বলে যাচ্ছে। বাস্তবসম্মত অ্যাকশন দৃশ্যে বাঁধন অসাধারণ যেটি আমরা স্বাভাবিকভাবে ব্যথা পেলে যেভাবে রিয়্যাক্ট করি ঠিক সেটাই ছিল ছবিতে, লার্জার দ্যান লাইফের কোনো ব্যাপার নেই।

পূজা ক্রুজ নামভূমিকায় ন্যাচারাল অভিনয় করেছে। তার অভিনয়ে কোনো আতিশয্য ছিল না। ক্লাইমেক্সে যে অভিনেতা অভিনয় করেছে তার অভিনয় অন্যদের থেকে আলাদা ছিল। সাইকো চরিত্রকে ভালোভাবে ডিল করতে পেরেছে। ছবির সবচেয়ে ব্যতিক্রমী অভিনয় তারই ছিল। শরীফ সিরাজ নেগেটিভ চরিত্রে উদীয়মান অভিনেতা, তার অভিনয়ের প্রশংসা করতেই হয়। ফারুক আহমেদ, মিশা সওদাগর, শতাব্তী ওয়াদুদ, সুষমা সরকার, সুমিত সেনগুপ্ত, শিল্পী সরকার অপু, হাসনাত রিপন তারা যার যার জায়গায় ন্যাচারাল।

এ ছবির অন্যতম শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর অসাধারণ বিজিএম। অনেকটা ভয় ধরানো বলা যায়। খুব যে আলাদা ধরনের মিউজিক ছিল বিজিএমে তা নয় কিন্তু শুনতে ‘fear’-এর অনুভূতি আসে। গানের মধ্যে রোমান্টিক ট্র্যাক ‘তোমাকে চাই’ সুন্দর তবে অ্যাকশন ট্র্যাকটি ছিল অসাধারণ।

‘এশা মার্ডার’-এর বাজেট হয়তো খুব বেশি ছিল না কিন্তু এর পরতে পরতে যত্ন করে নির্মাণ করার যে ছাপ সেটি ছিল এ ছবির অর্জন। বলিউডে ২০১২ সালে নির্মিত বিদ্যা বালানের বহুল প্রশংসিত থ্রিলার মুভি ‘কাহানি’-র বাজেট ছিল খুবই কম কিন্তু এর নির্মাণগুণে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তো ভালো ছবি নির্মাণে অনেক বাজেটও অনেক সময় ফ্যাক্টর হয় না, ব্যাস একটা ভালো প্রচেষ্টাও দারুণ কিছু তৈরি করতে পারে। ‘এশা মার্ডার’ তেমনই কিছু হয়েছ। ডিজিটাল সময়ের ছবিতে এরপর যারাই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে থ্রিলার ছবি বানাতে চাইবেন তাদের কাছে ‘এশা মার্ডার’ হতে পারে কেস স্টাডি।

রেটিং – ৮.৫/১০


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply