আমাদের একজন জাফর ইকবাল আছে
জাফর ইকবাল তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন শিল্পী। তাঁর শিল্পীসত্তার পরিধি একজন অনবদ্য অভিনেতার পাশাপাশি কণ্ঠশিল্পী এবং আধুনিক স্টাইলিশ ফ্যাশন আইকন হিশেবে বিস্তৃত। আশির দশকের ঢালিউডে তাঁর মতো আধুনিক স্মার্ট শিল্পী আর ছিল না। হাফ হাতা গেঞ্জি, চোখের সানগ্লাসে বা চুলের বাহারি স্টাইলে তখনকার তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি ছেলেবুড়ো সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় ছিল।বুকপকেটে তাঁর ছবি নিয়ে ঘুরত এমন তরুণীও ছিল ঢের। অভিনয়, ফ্যাশন দিয়ে জাফর ইকবাল ছিল তাঁর কালের ক্রেজ, রোমিও।
জন্ম ১৯ এপ্রিল ১৯৫০, ঢাকার গুলশানে। দেশের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বংশীয় ছেলে। জেনেটিক ফর্মে প্রতিভার অধিকারী।ভাই আনোয়ার পারভেজ বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার। বোন শাহনাজ রহমতউল্লাহ নামকরা কণ্ঠশিল্পী। তাদেরই ভাই জাফর ইকবাল ভাইবোনদের থেকে এগিয়ে থাকল প্রতিভার বহুমুখী স্ফূরণে।
অভিনেতা জাফর ইকবালের ক্রেজ মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের প্রথম পর্যন্ত।ক্যারিয়ার খুব বেশি বড় না। অল্প সময়ে ঢালিউডের গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে ওঠে। খান আতাউর রহমান ‘আপন পর’ সিনেমায় জাফর ইকবালকে নিয়ে আসে। সে সিনেমায় বশির আহমেদের গাওয়া ‘যারে যাবি যদি যা’ গানটি জাফর ইকবালের লিপে জনপ্রিয়তা পায়। তারপর একে একে অসাধারণ সব সিনেমা উপহার দেয়া শুরু। প্রায় ১৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেছে। উল্লেখযোগ্য কিছু নাম : আপন পর, ওগো বিদেশিনী, আশীর্বাদ, ফেরারী, সাধারণ মেয়ে, ফকির মজনু শাহ, নয়নের আলো, একই অঙ্গে এত রূপ, দিনের পর দিন, সূর্য সংগ্রাম, বাদল, অপমান, পরিবর্তন, সিআইডি, ফুলের মালা, মর্যাদা, বন্ধু আমার, উসিলা, লাওয়ারিশ, ভাইবন্ধু, সন্ত্রাস, অবুঝ হৃদয়, সন্ধি, যোগাযোগ, বদনাম, চোরের বৌ, ঘর ভাঙ্গা ঘর, প্রতিরোধ, গর্জন, মিস লংকা, অবদান, সাজানো বাগান, লক্ষীর সংসার, মামা-ভাগ্নে, শঙ্খনীল কারাগার।
সিনেমার অভিনেতা জাফর ইকবাল তাঁর সমস্ত অভিনয়শক্তি দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গলা কাঁপিয়ে একটা দারুণ রেশ তৈরি করে ডায়লগ ডেলিভারি দিয়ে দর্শকের আকর্ষণ ধরে রাখার দক্ষতা ছিল। দর্শককে মোহিত করে রাখার জন্য তাঁর রোমান্টিক, স্যাড দুই ধরনের অভিনয়েই সমান পারদর্শিতা ছিল।
জাফর ইকবালের সিনেমা থেকে কিছু সিকোয়েন্সের কথা স্মরণ করলে তাঁর অভিনয়শক্তির প্রমাণ মিলবে ‘ভাইবন্ধু’ সিনেমার তিনটি সিকোয়েন্সে :
১. দিতি যখন ইলিয়াস কাঞ্চনকে হাসপাতালে নিয়ে আসে জাফর ইকবাল দেখতে আসে মায়ের সাথে।মা ও ভাইকে অপমান করে দিতি কারণ ইতোমধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে কাঞ্চনের সাথে জাফরের।ততক্ষণে সুনেত্রা, সোহেল চৌধুরী ওরাও চলে আসে।দিতি ভেতরে চলে গেলে সবাই যায় কিন্তু জাফরের পা আটকে যায়।দিতির কথাগুলো কানে ভাসে।তখন জাফর ইকবালের অশ্রুসজল চোখ দুটো অসাধারণ লাগে।
২. অপারেশন থিয়েটারে ইনজেকশন হাতে দুই চোখের এক্সপ্রেশনের কোনো তুলনা হয় না।
৩.জাফর ইকবাল অন্ধ থাকে প্রথমে। কাঞ্চনের চেষ্টায় অপারেশনের পর সে চোখে দেখতে পায়। দিতির অপমানের পর জাফর অপারেশন থিয়েটারে যায়। মা পিছু পিছু গেলে দরজা আটকে দেয়।মা শতচেষ্টা করেও খুলতে পারে না। দৌড়ে এসে খবর দেয় কাঞ্চনের কেবিনে-‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, রাজা অপারেশন থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’সবাই ছুটে যায়। দরজা খুলতেই জাফর মুখ ঘোরায়। চোখে সানগ্লাস আর দু’চোখ বেয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। ইনজেক্ট করে চোখ অন্ধ করে ফেলেছে। বাকরুদ্ধ সবাই। কেন সে এমন করল দিতির এ জবাবে জাফরের উত্তর-‘তুই যে চোখের কথা বললি সে চোখ তো বাদশার অবদান। কিন্তু ভাইয়ের চেয়ে বেশি যে বন্ধুকে আমি বুঝতে পারিনি আমার সেই চোখ রেখে কি লাভ! দুই চোখে যে জ্বালা ধরিয়ে দিল রে।’অসাধারণ অভিনয় আর কান্না। মর্মান্তিক সে দৃশ্য! সাথে ‘বন্ধু আমার’ সিনেমার ‘বন্ধু আমার’ গানের সময় ফারুক যখন মাইকে গানের প্রথম কলিটা গায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে জাফর ইকবাল যে অপূর্ব এক্সপ্রেশন দেয় সেটা তাকেই মানায়। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে।
সিনেমায় বাণিজ্যিকে দাপটের সাথে অভিনয়ের পাশাপাশি এক্সপেরিমেন্টাল ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এ তাঁর অভিনয় সমান পারদর্শিতাসম্পন্ন।
গানে জাফর ইকবালের ক্যাটাগরি দাঁড়ায় লিপে থাকা আর নিজে গাওয়া। সিনেমায় তাঁর লিপে অনেক গান জনপ্রিয় হয়েছে যা আজও লোকে শোনে, ভালোবাসে। সেদিক থেকে ক্লাসিক কিছু গানের কথা বলা জরুরি :
* আমার বাবার মুখে
এ গান রেডিওতে শুনতাম আর মন ভরাতাম ছোটবেলায়। রেডিওর প্রতিদিন সকাল দশটার ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’ অনুষ্ঠানে শুনতে চেয়ে চিঠি লিখতাম। গানের কথা, সুরে এন্ড্রু কিশোরের অনবদ্য আবেগ আর জাফর ইকবালের একান্তভাবে সে দুঃখকে ধারণ করা মিলেমিশে একাকার হত।
* আমার সারাদেহ খেওগো মাটি
এ গানটাতেও ঐ একই ঘটনা ঘটে। এন্ড্রু কিশোরের দরদী গায়কী আর জাফর ইকবালের জীবন্ত কান্নার অভিনয় শুধুই মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো।
* ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা
এ গান শোনেনি এমন লোক মেলা ভার হবে। ‘ভাইবন্ধু’ সিনেমার কালজয়ী গান। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লোকে কখনো না কখনো গেয়েছে এ গান। বাস্তবসম্মত গান। গানে জাফর ইকবালের গেটআপ আর গীটারের ঝংকারে আধুনিক প্রেজেন্টেশন ক্লাসিক।
* তুমি এলে সমুখে
‘ভাইবন্ধু’ সিনেমার আর একটি শ্রুতিমধুর গান। পর্দার আড়ালে জাফর ইকবালের সানগ্লাস, হাফ শার্ট আর গীটারের তালে তালে গাওয়া এ গান মন কেড়ে নেবে।
* তুমি আমার জীবন
ক্লাসিক গান।জাফর ইকবাল-ববিতার চিরন্তন রসায়ন। গানটি দেখলে মনে হয় এ জুটির জন্যই গানটা তৈরি হয়েছে।
* কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো
‘উসিলা’ সিনেমার ক্লাসিক গান। সুবীর নন্দীর দরদী কণ্ঠে জাফর ইকবাল-দিতির রসায়ন। ছেলেবেলায় বাপচাচাদের দেখতাম গানটা গাইত নিজেরা।
* যারে যাবি যদি যা
এ গানের কোনো তুলনা নেই। বশির আহমেদের বিখ্যাত গান। চিরচেনা। জাফর ইকবালকে প্রথমদিকের চেহারায় খুব ইনোসেন্ট লাগে।কবরীর সাথে ছিল। সিনেমা ‘আপন পর।’
* ওগো বিদেশিনী তোমার চেরী ফুল দাও
‘ওগো বিদেশিনী’ সিনেমার কালজয়ী গান। এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে বুদ হয়ে থাকতে হয়। বিদেশি নায়িকা তামারা-র বিপরীতে ছিল জাফর ইকবাল।
জাফরের লিপে ছিল গানটি।
* চাঁদের সাথে আমি দেব না
এ গানটা সুরের জাদুতে মুগ্ধ করে। ‘আশীর্বাদ’ সিনেমার ক্লাসিক গান।
* আমার বুকের মধ্যেখানে
‘নয়নের আলো’ সিনেমার না ভোলা গান। জাফর ইকবাল-সুবর্ণা মুস্তাফার সুন্দর রসায়ন। সুর যেমন মন ভরায় অভিনয়ও।
* একটাই কথা আছে বাংলাতে
‘বন্ধু আমার’ সিনেমার ক্লাসিক গান। এ গান পুরনো হবে না। সাথে পুরনো হবে না জাফর ইকবালের অভিনয়।
* সকালটা যে আমার বিকেলটা যে তোমার
‘যোগাযোগ’ সিনেমার মিষ্টি প্রেমের গান। ছোটবেলায় গ্রামের ক্লাবে সিনেমাটি প্রথমবার দেখার পর সবার মুখে মুখে ছিল গানটি।
এছাড়া সিনেমায় আরো কিছু গান আছে স্মরণীয় –
* আমি তোমার মনের মতো কিনা – গর্জন
* শোনো সোমা একটু দাঁড়াও – প্রতিরোধ
* এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া – দোষী
* সত্য কি মিথ্যে কি (রোমান্টিক) – ভাইবন্ধু
* সত্য কি মিথ্যে কি (স্যাড) – দোষী
* আপনা হাত জগন্নাথ – ভাইবন্ধু
* আজকে মাফ কালকে মাফ – ভাইবন্ধু
তাঁর সময়ের ব্যস্ত প্রথম সারির অভিনেত্রীদের সাথেই কাজ করেছে। শাবানা, কবরী, ববিতা, চম্পা, দিতি।সবার সাথেই সমান সাবলীল।
সিনেমার গান ছাড়া নিজের কণ্ঠে গান গেয়ে আরো জনপ্রিয়তা আসে জাফর ইকবালের। ব্যান্ডদল ছিল তাঁর। অ্যালবামও আছে।’সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী’ এ গানটা ক্লাসিক হয়ে গেছে। ব্যর্থ প্রেমিকের আর্তনাদ প্রকাশে গানটি অনায়াসে সেরা। ‘বদনাম’ সিনেমায় রাজ্জাকের লিপে জাফর ইকবালের এ গানটাও সুপরিচিত। টাচি গান। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকা জাফর ইকবালের আর একটি অনবদ্য গান ‘যেভাবেই বাঁচি বেঁচে তো আছি/ জীবন আর মরণের মাঝামাঝি। ‘গানের সুর এত টাচি যে যে কাউকে অশ্রুসিক্ত করতে পারে। ‘বিদেশ থেকে দেশে আইলে’ গানটাও মনে রাখার মতো।
জাফর ইকবাল একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা সবই দ্বিগুণ হয় এই ভেবে যে তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন।
জাফর ইকবাল একজন পাগল প্রেমিকও। বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু হৃদয়টা পড়ে ছিল ববিতার কাছে। ববিতাকে ভালোবাসার কথাটা তখন মিডিয়া ও ভক্তপাড়ায় একটা ওপেন সিক্রেট ছিল। ‘অবুঝ হৃদয়’ সিনেমায় ‘তুমি আমার জীবন’ গানে ববিতার সাথে লিপ-লক দেখে তখন সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল তার সাথে হৃদয় দেয়ানেয়াটা দর্শক-ভক্তরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।প্রেম এক আত্মঘাতী জিনিস তাই জাফর ইকবাল শেষ পর্যন্ত বোহেমিয়ান হয়ে পড়ে। বোহেমিয়ানিজমের ফলাফল হিশেবে মদ্যপান ছিল অবধারিত। অতঃপর হার্ট ও কিডনি অকেজো হলো। হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজের শরীরকে অত্যাচারের খনি বানিয়ে ববিতার মুখেই ‘তুমি ভালো ছেলে’ কথাটা শুনে ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি অনন্তে চলে যায় অলরাউন্ডার।
অলরাউন্ডার জীবনের সমাপ্তি ঘটলেও কর্মজগতের অসাধারণ আখ্যানে জাফর ইকবাল ঢালিউডে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দর্শকভক্ত বলবেই-‘আমাদের একজন জাফর ইকবাল আছে।’