আমার চলচ্চিত্র দর্শন – ভালোবাসা জিন্দাবাদ
চলচ্চিত্র পরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস তার নতুন ছবি ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ‘ উপভোগ করতে আমাদের কয়েকজনকে ভালোবেসে ফ্রি টিকেট দিয়েছেন। সাথে কথা দিয়েছেন ছবির নায়িকা লাস্যময়ী র্যাম্প মডেল ‘আইরিন সুলতানা’র সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিবেন ।
বাঙ্গালী ফ্রিতে জাহান্নামের দরজা পর্যন্ত ঘুরে আসতে রাজি। আর এতো ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ‘, বোনাস হিসেবে আইরিন। ‘ মাম্মা খাড়াও আইতেছি ‘ বলে চোখ টিফি দিয়ে আমি সেন্ট পাউডার মেখে তৈরি হয়ে গেলাম। নায়িকার সংস্পর্শে যাবো (ভুল মিনিং করবেন না) একটু ঘষামাজা তো করতেই হয়।
তো আমরা কয়েকজন বন্ধু ফ্রি টিকেটের উছিলায় (মূলত আইরিন দর্শনের আকুলতায়) বগল বাজাতে বাজাতে আজ ছুটে গিয়েছিলাম অভিসার সিনেমা হলে। (প্রেক্ষাগৃহের নাম “অভিসার ” নামটা মজার। আমার ধারণা নামটা যিনি রাখছেন তিনি কিন্তু কিঞ্চিৎ সুড়সুড়ি দেয়া আদমি ছিলেন (চোখ টিফি) )
যতটা লৌহ উৎসাহ নিয়ে সিনেমা হলে পৌঁছলাম ততটাই নিস্তেজ হয়ে হলে প্রবেশ করলাম। হলে পৌঁছেই বুঝলাম বেসবাবা সুমনের আমজনতার পক্ষে দেশের প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছে যাওয়া যতটা সহজ (ঈদে-পূজায়) কিন্তু একজন উঠতি আকর্ষণীয় গড়নের নায়িকার কাছে যাওয়া ঠিক ততটাই কঠিন।
উঠতি নায়িকার চারপাশে থাকে চাইনিজ মুবাইলওয়ালা আর একদল খালা। নায়িকার বডিগার্ড হিসেবে থাকে জামদানী শাড়ি পড়া কিছু মহিলা। উনারা খুব সম্ভবত নায়িকার খালা জাতীয় কিছু হবেন। মেয়েকে দেখে রাখা আর কি। অন্ধকার হলে কে কখন কি করে ঠাহর করা মুস্কিল। এই ভয় থেকেই হয়তো এই খালাদের উপস্থিতি। তবে যত খালা মামিই থাকুক কিভাবে যেন হুড়মুড় করে একদল চাইনিজ মোবাইলধারী বিড়িখোর পাবলিক নায়িকার চারপাশে জুটে যায় (তাদের গা থেকে ভুড়ভুড় বিড়ির ঘ্রাণ আসে)। তাদের লক্ষ্য থাকে কিভাবে কম রেজুলেশনের মোবাইল দিয়ে নায়িকার এক্ষান খোমা তুলে নেয়া যায়। জানি না এই অস্পষ্ট খোমা দিয়ে তারা পরবর্তীতে কি করবে। রাতে কি এতো অন্ধকারের খোমা কাজে লাগানো সম্ভব? মনে তো হয় না।
সে যাই হোক, বীর জনতা লাস্যময়ী নায়িকার ছবি তোলায় ব্যস্ত। ফলে এই অধম অনেক কুতকাত করেও আর নায়িকার সংস্পর্শে যাইতে পারি নাই। অল্পের জন্য নায়িকা আমার সামনে দিয়ে কেটে গেছেন। আমার মন উদাস হইছে। তবে আশার কথা নায়িকা সম্পূর্ণ ছবি আমার পাশের রোতে বসে দেখেছেন। এতে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো গেছে।
মুভি শুরু হইল। আমার ঠিক পিছনের সারির এক ছেলে পাশের রো লক্ষ্য করে (যেখানে নায়িকা বসে সিনেমা দেখছে) চিৎকার দিয়ে উঠলো — “ঐ জামান”।’ ঐ জামান’ কাহিনী কিছুই বুঝলাম না। বোঝার চেষ্টাও করলাম না। আগে ছবির কাহিনী বুঝি। তারপর না হয় “ঐ জামান” বোঝা যাবে।
কাহিনী বুঝতে গিয়ে দেখা গেল এই ছবিতে আসলে বেসিক কোন কাহিনী নেই। নায়িকার বাবা (সাদেক বাচ্চু) তার কন্যা আইমিন নায়িকা আইরিনকে (মেঘা) নায়ক আরেফিন শুভ (সৌরভ) এর সাথে লটরঘটর করতে দিবে না। পোলায় লটরঘটর করবেই। বাপে দিবে না, পোলায় করবেই করবে। এর ভিতরেই সব সাসপেন্স, ক্লাইম্যাক্স, নাচা গানা।
সুতরাং হালকার উপর ঝাপসা ভাবে বলা যায়, এই ছবির কাহিনী অনেকাংশে বাবা কাহিনী। বিষয় বিস্তারিত বলছি।
বিষয় হল ভালোবাসা জিন্দাবাদ একটি ‘ বাবা ‘ নির্ভর মুভি। পাঠক, এই বাবা সেই বাবা নয়। এই বাবা, বাবা মা এর বাবা। তাই ঐ বাবা’র সাথে এই বাবা’র চেহারামত মিল থাকলেও কন্টেন্টগত মিল নেই।
(থাক হুদাই বাবা নিয়ে আরও পেঁচাইয়া কাম নাই, লাইনে আসি)
এই ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাবা ভূমিকা মুখ্য। নায়ক নায়িকা যেখানে গৌণ। মানে আপনার সময়ে সময়ে মনে হতে পারে আসলে নায়ক কে? মেয়ের পিতা নাকি মেয়ের বয়ফ্রেন্ড! চলচিত্র পার্টনার বন্ধু আশিফ এর মতে দর্শকদের নাকি হলে প্রবেশের আগেই বলে দেয়া উচিৎ ছবিতে সাদেক বাচ্চু নায়িকার বাবা এবং তিনি নায়ক নন।
পিছনের সারির ঐ ছেলে ছবির মাঝপথে আবার বলে উঠলো — “ঐ জামান”
জামান যাক। ভালোবাসা জিন্দাবাদ অতি মাত্রায় সুশ্লীল মুভি। প্রমান পাওয়া যায় নায়ক আরেফিন শুভ (ছবিতে যার নাম সৌরভ) নায়িকার (মেঘা) এক হাত ব্যাবধানে আসলে নায়িকা একবার বলে উঠেছিল — ‘ছি এইসব কি করছ! এইসব ভালো না! ‘
যদিও শুভ চান্স মিস করে নাই । তিনি এক ফোঁটা চান্স পাওয়া মাত্র ক্যাঁক করে নায়িকাকে জড়িয়ে ধরেছেন । একবার নয় । ১৫-২০ বার তো হবেই ।
ছবিতে একটা বিষয় কিঞ্চিৎ অদ্ভুত লেগেছে। সেটা হল, ঢাকা শহরে এমন একটা ভার্সিটি আছে যেখানে ছাত্র – ছাত্রী কেবল নায়ক নায়িকা দুজন। বিশাল বিশাল বিল্ডিং। খালি। মানুষ ঐ দুই জন। নায়ক নায়িকা। (একবার মাত্র ক্লাস রুমে গুটিকয়েক ছাত্র – ছাত্রী নজরে আসছিল, স্বল্প সময়ে)। গাছ গাছালি ফসল আবাদির ক্যাম্পাস। যেন খা খা বোটানিক্যাল গার্ডেন। এর ভিতর মানুষ। সেই দুজন। নায়ক নায়িকা। আর কেউ নাই। তবে মাঝে মধ্যে জিন ভূত দেখার মতো একটা ছেলেকে সাইকেলের বেল বাজাইয়া পাশ কাটাতে দেখা গেছে আর দেখা গেছে দুজন গার্মেন্টস কর্মী। তারা দ্রুত বেগে সিন ক্রস করে চলে যায়। তারা রহস্য।
আরেকটা বিষয় ঢাকা শহর মানে হাতির ঝিল। নির্মাতা চরম দক্ষতায় তার ছবির প্রায় ৫০% দৃশ্য মনে হয় হাতির ঝিলের আশে পাশে শুট করে নিয়েছে ।
খাইছে! এ আমি করতেছি কি!! দেবাশীষ বিশ্বাস আমাকে তার ছবি দেখিয়েছে বিনামূল্যে। আমার অতি অবশ্য কিছু দায়িত্ব থেকে যায় ছবির ভালো দিকগুলো তুলে ধরা। আমি এখন প্রশংসা করিব।
ভালোবাসা জিন্দাবাদের ভালো দিক সমূহ —
১/ নায়ক হিসেবে আরেফিন শুভ প্লাস। খুব সম্ভবত এটিই শুভ’র একেক নায়ক হিসেবে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি। সে হিসেবে একক নায়ক হিসেবে নিজেকে সে যথাযথ ভাবে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। সম্পূর্ণ ছবিতে একমাত্র শুভ’র সাবলীল অভিনয়, গেট আপ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ডায়ালগ ডেলিভারি মোটামুটি সবকিছু আপনার কাছে পয়সা উশুল মনে হবে।
যেহেতু উপমহাদেশের চলচ্চিত্র নায়ক নির্ভর, সেখানে নায়কের অভিনয়কে এখনো মূল আকর্ষণ হিসেবে ধরা হয় সেই হিসেবে ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ ছবিটি নায়ক উপস্থাপনায় সফল ।
২/ নতুন হিসেবে র্যাম্প মডেল আইরিন খারাপ নয়। কোমলতা আছে। আছে অভিনয়ের ইচ্ছা। সে চেষ্টা করেছে। জড়তার জন্য চেষ্টাটা ততটা ফুটে ঊঠেনি। নতুন হিসেবে এটা স্বাভাবিক ধরে নেয়া যায়। পাশের সিটের ভদ্রলোক বেশ কয়েকবার ভারী গলায় বলেছেন — “মেয়ের তো কোমর কিন্তু দুলে না”। ভদ্রলোকের কথা মিলিয়ে দেখার জন্য আমি চোখ পাকিয়ে গানগুলোতে নায়িকার নাচ দেখার চেষ্টা করে বুঝলাম কথা কিছুটা সত্য। ছবিতে শুভ‘র কোমর আইরিনের চেয়ে বেশি দুলেছে। যা দেখতে অস্বস্তিকর। দুজনার সমান সমান দুললে দেখতে ভালো লাগতো।
তবে আইরিন মেয়েটা কিউট। জড়তা কেটে গেল বাংলা চলচ্চিত্র একজন আকর্ষণীয় নায়িকা পেতে পারে।
৩/এই ছবির সবচেয়ে মজবুত সেক্টর ছবির গানসমূহ। শওকত আলী ইমনের সংগীত প্রযোজনায় শ্রুতিমধুর গানগুলোর প্রায় প্রতিটির পিকচারাইজেশন ছিল বেশ ভালো। লোকেশন নির্বাচনে নির্মাতা ফরেন কান্ট্রি না বেছে দেশের বাতিক্রমী দর্শনীয় কিছু স্থান সিলেক্ট করেছেন যা দেখতে ভালো লেগেছে। গানগুলো দেখে যখন আমি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম তখন আবার শুনতে পেলাম — “ঐ জামান “
৪/ছবিতে সচেতনভাবে ভাঁড়ামোর অংশ যুক্ত করা হয়েছে। এইটা তামিল ছবির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। অধিকাংশ ভাঁড়ামো বড্ড দুর্বল হলেও কিছু কিছু ভাঁড়ামোতে দর্শক মজা পেয়েছে। হাততালি পড়েছে বেশ।
৫/ সুনির্মাতা দিলীপ বিশ্বাসের পুত্র দেবাশীষ বিশ্বাস একজন গুণী পরিচালক। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র “শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদে” তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তবে কথা হল, যুগ পাল্টাইছে। দর্শক এখন অনেক বেশী সচেতন। তারা ছবিতে ভালো গল্প দেখতে চায়। কোন টুইস্ট ছাড়া কি গল্প জমে?
দর্শকরা মেকিং এ ভিন্নতা আশা করে। চায় আধুনিকতার ছোঁয়া। আমরা কিন্তু বাংলা ছবি দেখতে চাই। শুধু এই কয়টা বিষয় নির্মাতারা মাথায় রাখলেই ছবি হয় ব্যবসা সফল (আজকে এই ছবি মুক্তির প্রথম দিনে আমি হল ভর্তি দর্শক দেখেছি। সুতরাং বোঝা যায় মানুষ বাংলা ছবি ভালোবাসে। শুধুমাত্র তারা কিছু পরিবর্তন চায়)
অবশ্য এখানে এককভাবে নির্মাতাকে দায়ী করা হয়তো যুক্তি সঙ্গত হবে না। আমাদের চলচ্চিত্রে অর্থ লগ্নি থাকে খুব কম। হয়তো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নির্মাতাদের অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ‘ ভালোবাসা জিন্দাবাদ ‘ ছবির প্রযোজক ছিলনে রাজনীতিবিদ মাহি বি চৌধুরী। সুতরাং কিছুটা দায়ভার উনার কাঁধেও এসে যায়। আরেকটু বাজেট বাড়ালে হয়তো আরও ভিন্ন কিছু দেখার সুযোগ আমাদের হতো ।
তবে শেষ কথা হিসেবে বলা যায় দেশের প্রায় অর্ধশত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ ‘ নামের স্বল্প বাজেটের রোম্যান্টিক এই ছবি। নতুন নায়ক নায়িকা নিয়ে কাজ করায় যথেষ্ট রিস্ক থাকে। সেই রিস্ক হাতে নিয়েই প্রযোজক নির্মাতারা সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসচ্ছেন — এইটা অবশ্যই আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য আশীর্বাদক ।
ছবি শেষে বের হয়ে আসার মুখে আবার শুনলাম “ঐ জামান ” পাশে তাকিয়ে দেখি আমার পিছনের সারির ঐ ছেলে আরেক ছেলের কাঁধে হাত রেখে দুষ্ট হাসি হেসে বলছে — মামা, তুই তো নায়িকার নিচের সারিতেই ছিলি , কি দেখলি মামা ? “
ছেলে বলল — ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ ‘