আমি পাগল হবো
আমি নেতা হবো
পরিচালনা : উত্তম আকাশ
অভিনয়ে : শাকিব খান, বিদ্যা সিনহা মিম, ওমরসানী, মৌসুমী, কাজী হায়াৎ, শিবা শানু, সাদেক বাচ্চু, ডিজে সোহেল, সেলিম খান, উত্তম আকাশ, কাবিলা, আমির সিরাজী, সিরাজ হায়দার ও কমল পাটেকর।
রেটিং : ১.৫/ ৫
শাকিব খান পর্দায় ফিরেছেন প্রায় ৫ মাস পর। বিদ্যা সিনহা মিম শাকিব খানের জুটি হয়ে ফিরেছেন প্রায় ৯ বছর পর। মৌসুমীকে বোন এবং ওমরসানীকে দুলাভাই হিসেবে শাকিব খান একসঙ্গে পেয়েছিলেন ২০০৯ সালে, ‘সাহেব নামে গোলাম’ ছবিতে। সে ছবিটি মুক্তির ৯ বছর পর আবারো এক হলেন শাকিব খান-ওমরসানী-মৌসুমী। ছবির নাম ‘আমি নেতা হবো’।
শুধুমাত্র এই তিনটি কারণই যথেষ্ট ছিল শাকিব খান ভক্তদের জন্য। বাড়তি পাওনা হিসেবে রয়েছে ব্যংককে চিত্রায়িত গান। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তির প্রথম দিন ‘আমি নেতা হবো’ দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নামবে- এটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে দর্শকের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করেছেন নির্মাতা উত্তম আকাশ এবার আমরা সেটিই আবিষ্কার করবো।
‘আমি নেতা হবো’ ছবিতে একটি সংলাপ আছে— রাজনীতি হলো সব বুদ্ধি ও প্যাচের খেলা। এই সংলাপকেই আদর্শ মেনে গল্প সাজিয়েছেন উত্তম আকাশ। বলা হয়েছে ‘আমি নেতা হবো’ রাজনৈতিক গল্পনির্ভর ছবি। তবে সত্যি বলতে, এ ছবিতে গল্পটা যে প্রকৃত অর্থে কী, আমি খুঁজে পাইনি।
চাঁদপুরে এক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে ছবির গল্প, যে গল্পে কোনো চমক নেই, চিত্রনাট্যের কোনো বালাই নেই, সংলাপেও কোনো ধার নেই। আছে উচ্চকিত ফাঁকা বুলি। ২০১৮ সালে এসেও যদি ছবির শেষ দৃশ্যে পুলিশের সেই ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’ দেখতে ও শুনতে হয়-এর চেয়ে বড় আফসোস বুঝি আর কিছুই হতে পারে না।
মজার বিষয় হলো, শুধু আমরা দর্শকরাই কাহিনির খেই হারিয়ে ফেলিনি, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক উত্তম আকাশও আমাদের দলে ছিলেন। নয়তো সাক্কু (শাকিব খান) হাজতে যাবার পর গল্প বোঝাবার জন্য পর্দায় লিখে কেন দর্শককে জানাতে হবে, ৩ বছরে সাক্কু সাতবার জেলে গিয়েছে? হাজত থেকে বেরিয়ে সাক্কু যখন আক্কাস ব্যাপারির (সাদেক বাচ্চু) নির্দেশে কমল পাটেকরকে গুলি করে হত্যার অভিনয় করেন, সে মুহূর্তে কমল বেঁচে আছে কি মরে গেছে- তা দেখারও বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয়নি আক্কাস ও তার দলের। কারণ তারা তখন ‘লাল লিপস্টিক’ নিয়ে ব্যস্ত। অবশ্য শুধু ‘লাল লিপস্টিক’ই বা কেন ‘বিলাই চিমটি’ ছিল ছবির গল্পের অন্যতম বিশেষ অনুষঙ্গ। কাহিনীকার ভুলে গিয়েছিলেন ২০১৮ সালের দর্শকরা এ ধরনের কমেডি দৃশ্যে এখন হাসেন না।
একজন নিম্ন আয়ের দর্শকেরও যে রুচি বদল হয়েছে এটি আমরা প্রায়ই ভুলে যাচ্ছি। তাছাড়া দর্শকদের নির্মাতারা খুব বেশি বোকা ভেবে ফেলেন প্রায়শই। এ ছবিতেই দেখুন, শাকিব খান অভিনীত চরিত্রের নাম সাদেকুর রহমান সাক্কু। অথচ ছবির শেষ দিকে সাক্কুর জন্য পোস্টার ছাপা হয়, যেখানে লেখা সাকিব খান (সাক্কু)-কে ভোট দিন। গল্পে সাকিব খান কে? এ নামে তো কোনো চরিত্র ছিল না। বড় বড় হরফে লেখা পোস্টারগুলো সব দর্শকই খেয়াল করেছেন। অথচ নির্মাতারা খেয়াল করলেন না?
নায়ক গুলি করবার আগেই শব্দ বেরিয়ে আসা কিংবা খল চরিত্রের গায়ে হাত ওঠার আগেই রক্ত ঝরে পড়া-এসব দৃশ্য দেখে সংশোধন করার একজন মানুষও ছিলেন না ‘আমি নেতা হবো’ ইউনিটে? এ ছবিতে নির্বাচন কমিশনার বলে কেউ নেই। সাংবাদিক নিজেই বলেন, নির্বাচনের ফল কিছু সময়ের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হলো। এ দায়িত্ব কি সাংবাদিকের?
ছোট ভাই শিবা শানুর কাছে সাদেক বাচ্চু অনুমতি চায়, শিবা চাইলে শাকিব খানকে তার দলের হয়ে কাজ করার সুযোগ দেবেন। শিবা কিছু শর্ত মাফিক সম্মতি দেন। কিন্তু একটা সময় পর শিবাই বলেন, তার ভাইকে তিনি আগেই নিষেধ করেছিলেন শাকিব খানকে দলে অন্তর্ভুক্ত না করবার জন্য। কাহিনীকার ভুলে গিয়েছিলেন শিবাই তার ভাইকে অনুমতি দিয়েছিলেন।
কাহিনীকার ও নির্মাতা অবশ্য আরো বেশ কিছু অদ্ভুত ক্যারিশমা দেখিয়েছেন ছবিতে। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক অফিসে বসে রোদচশমা পড়ে কথা বলেন। নায়ক-নায়িকার সাথে বিএফডিসি’র শিল্পী সমিতির সামনে দাঁড়িয়ে প্রেম করেন। বিএফডিসি’র অলি-গলি, খাল-বিলে শুটিং করা যেতেই পারে। তাই বলে পেছনে শিল্পী সমিতির সাইনবোর্ড ঝুলছে, স্টাডি রুম দেখা যাচ্ছে আর নায়ক-নায়িকা দেদারসে প্রেমের সংলাপ দিয়ে যাচ্ছে, বিষয়টা একটু কৃত্রিম ও হাস্যকর হয়ে গেল না?
অবশ্য এ ছবির শুরু থেকে শেষ এরকম আরো অসংখ্য অসঙ্গতি হজম করতে হয়েছে কোমলমতি দর্শকদের। এ কারণেই ছবির শেষ দৃশ্যে যখন বলা হয়, খল চরিত্র তার পাপের শাস্তি পেয়ে গেছে। তখন দর্শকরা আমার পাশ থেকে চিৎকার করে বলেন, আক্কাস ব্যাপারি নয়, আমরা আমাদের পাপের শাস্তি পেয়ে গেছি। ‘আমি নেতা হবো’ দেখে আমি/আমরা পাগল হবো। জীবন থেকে আড়াই ঘন্টা ছিনিয়ে নেয়ার অপরাধে টিকেটের পয়সা ফিরিয়ে দেয়া হোক।
প্রযোজক শাপলা মিডিয়া ‘আমি নেতা হবো’ নির্মাণ করতে গিয়ে বাজেটের কোনো কমতি রাখেননি। বহু তারকার সমাবেশ থেকে দেশের বাইরে চিত্রায়িত গান-সবকিছুতেই অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। তবে পরিচালক উত্তম আকাশের কারণে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে গিয়েছে। স্থুল গল্প, দুর্বল চিত্রনাট্য, সেকেলে পরিচালনা দর্শককে একটি মনে রাখার মতো ছবি উপহার দিতে পারেনি। জলের মত অর্থ খরচ হয়েছে, তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীর অপব্যবহার হয়েছে এ ছবিতে। এটা ঠিক, শাকিব খানকে ঘিরেই এ ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে। তবে শাকিব খানের সাক্কু চরিত্রটিরও সঠিক চিত্রায়ণ হয়নি। শাকিব খানের এন্ট্রি থেকে শুরু করে বোনকে খল চরিত্রের হাত থেকে উদ্ধার করার দৃশ্য, এমনকি শেষ ক্লাইমেক্সে দর্শক মুহুর্মূহু তালি দিয়েছেন ঠিক।
তবে এই তালি শুধুমাত্র শাকিব খানকে ভালোবেসে দিয়েছেন দর্শক। ছবিকে ভালোবেসে নয়। শাকিব খান মেধাবী অভিনেতা, আমার সন্দেহ নেই। তবে শিকারী, নবাব ছবিতে শাকিব খান নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারলে রংবাজ, অহংকার এবং সর্বশেষ আমি নেতা হবো ছবিতে তিনি তার নামের প্রতি সুবিচার করতে কেন পারছেন না-ভাববার বিষয়। দায়টা আসলে কার? শাকিব খানের নাকি বাংলাদেশি নির্মাতাদের?
আমি বলবো, বাংলাদেশের অনেক নির্মাতা শিল্পীকে তার সঠিক মূল্যায়নটাই করেন না। নইলে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী মৌসুমী ও বিদ্যা সিনহা মিমের চরিত্রের প্রতি এত অবহেলা কেন? মৌসুমী কিছু দৃশ্যে অভিনয়ের সুযোগ পেলেও তার চরিত্রের কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। গভীরতা ছিল না। বিদ্যা সিনহা মিমকে তো এ ছবির ‘ক্ষণিকের অতিথি’। গান গাইবার আগের দৃশ্যে হাজিরা দেন, নেচে গেয়ে আবার হারিয়ে যান।
সামান্য একজন নতর্কী হয়েও মিম বারবার ব্যংককে ছুটে যান গান করতে। অধিকাংশ পোশাকে তাকে নর্তকীও মনে হয়নি। ‘সুন্দরী’ চরিত্রে নতুন যে কেউ অভিনয় করতে পারতেন। কেন মিমকে প্রস্তাব করা হলো, মিমও বা কেন এ চরিত্রে অভিনয় করতে সম্মতি জানিয়েছেন-বিস্মিত হয়েছি।
শাকিব খান-বিদ্যা সিনহা মিম জুটি ৯ বছর পর ফিরে এসে পর্দায় কোনো রসায়নই সৃষ্টি করার সুযোগ পাননি। যেমনটি পাননি ওমরসানী-মৌসুমী জুটি। যে সময়ে বক্স অফিসে এ জুটি ঝড় তুলতেন সে সময় এখন আর নেই, এটা যেমন সত্যি। ঠিক তেমনি সে সময়ে বলিউডে ঝড় তোলা শাহরুখ খান-কাজল জুটি যদি এখনো দিলওয়ালে’র মত ছবিতে অভিনয় করতে পারেন, আমরা কেন আমাদের অভিনেতাদের বয়স উপযোগী চরিত্রে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না?
সাদেক বাচ্চু, কাজী হায়াত, শিবা শানু, কাবিলাসহ চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অনেক শিল্পীও এ ছবিতে আছেন। তবে কারো চরিত্রের প্রতিই যথার্থ ধ্যান দেয়া হয়নি। বিশেষ করে অন্যান্য ছবির মতো ডি জে সোহেলের কিছু সংলাপ বুঝেছি, কিছু বুঝতে পারিনি। তার উচ্চারণ স্পষ্ট নয়। কাবিলার কণ্ঠস্বরও ছিল তার সম্পদ। দর্শক আনন্দ পেতেন। তবে এখন কাবিলার ডাবিং ভালো হচ্ছে না। পরিচালক উত্তম আকাশ, প্রযোজক সেলিম খান, এমনকি সহকারী পরিচালক সবাই এ ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কাজী হায়াতের মত তারাও ইস্পাত কঠিন পাথরের মত সংলাপ প্রক্ষেপণ করেছেন।
তবে অনেক খারাপের মাঝে এ ছবির অন্যতম ভালো দিক ছবির গানগুলো। বিশেষ করে ‘লাল লিপস্টিক’ ও ‘চুম্মা’ আমজনতা দু হাত ভরে গ্রহণ করেছেন। শিস, তালি, আনন্দোল্লাসের শব্দে আমি প্রেক্ষাগৃহে গানগুলো শুনতেই পারিনি। এটি অবশ্য ভালো দিক।
শাকিব খান-বিদ্যা সিনহা মিম দুজনকে দেখতে ভালো লেগেছে, নেচেছেনও ভালো। শুধুমাত্র ‘চুম্মা’ গানে ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’এর ক্যাটরিনার নাচের মুদ্রা নকল না করলেও পারতেন নৃত্য পরিচালক বাবা যাদভ। ‘ঘুরছি আজো পথে পথে’ গানটির দরকার ছিল না ছবিতে।
তবে এ ছবির আরেকটি হাস্যকর দিক হলো শিরোনাম গানের চিত্রায়ন। পর্যাপ্ত ফুটেজ না থাকলে নির্মাতা গানটিই ব্যবহার না করতে পারতেন কিংবা এ ছবির ফুটেজ ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি ২, সত্তা, রাজা ৪২০-সহ শাকিব খানের অন্য ছবির অংশ বিশেষ ব্যবহার করার কারণে পুরো গানটিই হাসির খোরাক যুগিয়েছে।
এ ছবির আবহ সংগীত যিনি করেছেন, তিনিও সস্তার মধ্যে দিল তো পাগল হ্যায় সহ হিন্দি ও ইংরেজি গানের বহুল ব্যবহৃত গানের সুর ব্যবহার করেছেন।
তার মানে ‘আমি নেতা হবো’ ছবিতে কাজের প্রতি মায়া, সততা, আন্তরিকতা, দর্শকের প্রতি দায়বদ্ধতা পরিচালকের তো ছিলই না, কলাকুশলীদের অনেকে একই পথ অনুসরণ করেছেন। বিষয়টি হতাশার, ভেবে দেখবার। প্রশ্ন জাগে মনে, এভাবে আর কতদিন?