Select Page

আলমগীর কবিরই রূপালি সৈকতের নায়ক, অভিনেতারা বাহানা মাত্র

আলমগীর কবিরই রূপালি সৈকতের নায়ক, অভিনেতারা বাহানা মাত্র

এক.

রূপালি সৈকতে অপেক্ষা করে লাবণ্যময়ী নারীরা। চাঁদনী রাতে ফিরে আসে প্রিয়জন… না, ফিরেও যায় কেউ কেউ। কিন্তু এই দুই পুরুষই আলাদা কেউ নয়, একজনই। একটু হয়তো আশ্চর্য হবেন, পাগলামীও মনে হবে— আলমগীর কবিরেররূপালি সৈকতে’ সিনেমায় বুলবুল আহমেদ ও আনোয়ার হোসেন মূলত একই মানুষ। একই সত্তার দুই পিঠ। তিনি আলমগীর কবির স্বয়ং।

সিনেমা সম্পর্কে ‘লার্জার দেন লাইফ’ বলে একটা কথা অনেক শোনা যায়। কবির নিজেকে আরও দীর্ঘ করে তুলেছেন ‘রূপালি সৈকতে’ সিনেমায়। এক নারীকে কেন্দ্র করে সমান্তরাল দুই প্রোটোগনিস্ট যে অতীত আর বর্তমান ভাগাভাগি করে (যাদের প্রায় কখনোই দেখা হয় না)। ক্যামেরার পেছনের রক্ত-মাংসের কবিরের রাজনৈতিক চিন্তা গড়ে উঠার স্থান-কালকেই তারা বর্ণনা করছেন। ব্যক্তিগত প্রেম-বিরহ ও দ্বিধা-দ্ব্যর্থতা।

জীবনের কাছে দ্বিতীয়বার সুযোগ চাওয়ার আর্তিই মূলত ‘রূপালি সৈকতে’র আশ্রয়। সিনেমায় স্বঘোষিত ‘অস্তিত্ববাদী’ ও সম্পর্কের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত লেনিন বারবার শরমিনের কাছে গিয়েও ফিরে আসে। শেষে অ্যানার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চায়। যদিও জানে না, তবুও হয়তো অ্যানা শরমিনের বোন বলেই এ টানটা অনুভব করে। মহাজাগতিক লীলা! এ সম্পর্ক আগে থেকে দর্শক অনুমান করতে পারলেও লেনিন পারে না। অ্যানা ও শরমিনকে লেনিন এমন জায়গা থেকে দেখে সেখানে দুইই এক অর্থাৎ, কবিরের লাবণ্যময়ী নারীরা একের ভেতর প্রকাশে পরিপূর্ণ নয়। দুইয়ে মিলে ধরা পড়ে একটা পূর্ণ রূপ। যার একজন প্রিয়তমকে পায়, আরেকজন অন্য কারো হাত ধরে। এখানে কবিরের পুরুষেরা যেভাবে একটা চৌহদ্দিতে বাধা (ভবিষ্যত তো উন্মুক্ত), নারীরা ক্রমশ নিজেকে ছাড়িয়ে যান। কবিরের নারীরা তাই এক হয়ে এক নন— বহু। যাদের ধরা যায় আবার যায় না। বা পরিপূর্ণ সত্তার দিক থেকে মানুষের আদর্শিত রূপ মাটির পৃথিবীর মাঠ-ঘাটে আপতিত হয় অপূর্ণতায়। তাই রূপালি সৈকত এক বিভ্রম। আসলেই তো! লেনিন বা আনোয়ারের যুদ্ধ-জরাময় পৃথিবী এই সৈকতকে স্পর্শ করে না। যার কিছু দুঃসহ স্মৃতি আছে যা অন্য কোথাও ঘটে, কিন্তু এখানে তুলনামূলকভাবে স্বস্তি তৈরি করে। যেখানে তারা ফিরে আসে বিপ্লবের স্মৃতি, প্রেমের স্মৃতি বা জীবনের ক্লান্তি নিয়ে।

দুই.

ইউটিউবে ‘রূপালি সৈকতে’ দেখতে হলো বেশ ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে। অফিসিয়াল রিলিজ নয়। খুবই ঝিরঝিরে প্রিন্ট, রাতের দৃশ্য একদম অন্ধকার, আর কিছু দৃশ্য হয়তো নেই। সে কারণে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর বেখাপ্পা লাগে। একরাশ বিরক্তি ঘিরে ধরলেও সিনেমা শেষতক দেখার আগ্রহ তেমন মরে না, এর কারণ ছবির বিষয়, উপস্থাপন ও এত বড় ক্যানভাসে ১৯৭০ এর দশকে তেমন ছবি দেখা যায় না, অন্তত এই ঘরানার।

আলমগীর কবির ‘পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রে’ বিশ্বাসী ছিলেন, এই পদের মধ্য দিয়ে ফিকশন ও ডকুমেন্টারির এক ধরনের যুথবদ্ধতা চাইতেন। যদিও দেখি নাই, শুনেছি তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘ধীরে বহে মেঘনা’ও এই ধারার, ‘রূপালি সৈকতে’ও ডকুর দেখা মেলে। মিশর বা ভিয়েতনামের দৃশ্যগুলো কতটা দ্যোতনা তৈরি করে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে— তা বোঝা যাবে না এখন। তারপরও বিস্ময় তো থাকে! চোখে ধাক্কা মারে! ‘জীবন থেকে নেয়া’র সেটে গিয়ে জহির রায়হানকে উপস্থাপনের ধরন। ষাট বা সত্তরের ঘটনা আমাদের কাছে যতটা না জীবন্ত আজকাল, রূপালি পর্দার জহির রায়হান চট করেই আকর্ষণ করে। এ জায়গাটা ছবির বাস্তবতাকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে। হয়তো বন্ধুর প্রতি কবিরের নিবেদনও। হঠাৎ করে যেন পর্দার বাইরে এনে ধরে দর্শককে। জহিরকে নিয়ে যখন তারা আপ্লুত হন, তখন ভেসে উঠে ‘বিরতি’। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা। ইউটিউবের দর্শক হিসেবে আমি বিরতিতে যাইনি। কিন্তু ‘বিরতি’র মানসিক অভিঘাতটি অনুভব করেছি।

তিন.

বাংলা সিনেমায় দর্শন সংক্রান্ত আলোচনা বেশ দুর্লভ হয়তো। এখানে তা আবার ‘জীবন দর্শন’। লেনিন অস্তিত্ববাদী দর্শনের অনুসারী। অবশ্য ‘অস্তিত্ববাদ’ বললে একাট্টা বোঝা কঠিন। লেনিন জাঁ পল সার্ত্রের ভক্ত। সরকারি তদন্ত কর্মকর্তাকে লেনিন সার্ত্রের নাম বললে জিজ্ঞাসা করে, উনি কি ফিল্ম অ্যাক্টর? এটা একটা ভালো কৌতুক, কিন্তু চিন্তা করলে (আমাদের) দর্শনের দুনিয়ার সার্ত্রে আমাদের এখানে ফিল্ম অ্যাক্টরদের মতোই তো জনপ্রিয়। যেমন; চে গুয়েভারাও বটে! অস্তিত্ববাদী হিসেবে নিজেকে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ বলেও দাবি করেন বুলবুল। যদিও ভেতরে ভেতরে গোপন সশস্ত্র দলের সঙ্গে যুক্ত, যা আবার ভীষণ জনবিচ্ছিন্ন! সার্ত্রকেও আমরা দেখি রাজনীতির সঙ্গে থেকেও আবার সরে পড়তে। বাস্তবের আলমগীর কবির আর সিনেমার লেনিন ও আনোয়ার বিপ্লবের জন্যই আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন, বৈরুত ও কিউবায় গেছেন।

সম্ভবত শরমিনকে বিয়ের ব্যপারে লেনিনের দুদল্যমান অবস্থাকে কিয়েরকেগার্ড ও রেজিন ওলসেনের ঘটনার সঙ্গে তুলনা আনা যায়! কিন্তু সেখানে লেনিন সংকটকে সমাজতান্ত্রিক মুক্তি অর্থে হাজির করে, তা মোটাদাগের ভাবনারই। অথবা গভীর অন্তর্দ্বন্ধকে চাপা দেয় মাত্র। সেখানে লেনিন মানব অস্তিত্বের কোনো সারসত্তা ধরে টান দেয় বলে মনে হয় না! বক্তব্যগুলো এ সময়ে ক্লিশে মনে হলো- তখন হয়তো না। ওই বোঝাপড়াটার রূপালি সৈকত পর্যন্ত আমাদের যেতে হয়। শরমিন বলে, লেনিন নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারে না! একি অস্তিত্ববাদীর আয়না। মনে হয় না। এ কারণে অন্য চরিত্রগুলোর কাছে লেনিন বরাবরই অবোধ্য। দর্শকের কাছেও। এক জায়গা সার্ত্রের একটা উদাহরণের সুন্দর সুর পাওয়া যায়। কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থের ভেতর প্রায় একই রকম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা থাকে না লেনিনের। কারণ চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন; সার্ত্রে বলে বৃদ্ধ মায়ের সেবা বা দেশের জন্য যুদ্ধ দুইটার মধ্যে একটারে ফিক্সড করে বেছে নেওয়ার কোনো নির্দিষ্ট তরিকা নাই। তেমনি আপসকামী সাংবাদিক যখন পরিবারের দোহাই দেয়- লেনিন এর কোনো সমাধান দেওয়া তার কাজ না বলে সাফ সাফ জানায়। কারণ এর জন্য পূর্ব নির্ধারিত কোনো ছক তৈরি নেই তার কাছে। (একই ধরনের সিদ্ধান্তের জটিলতা দেখি রুবাইয়াত হোসাইনের ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ সিনেমায়)

চার.

বর্ণিত স্থান-কালের এক দশক পর নির্মিত ওই সিনেমায় অল্প কিছু ক্রিটিক আছে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশ ও বিভাজনের। এই সুযোগের ভালো ব্যবহার করেছেন আলমগীর কবির। এটা ‘রূপালি সৈকতে’র বৃহত্তর ক্যানভাসের বড় দিক। বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রম পর্যায়, এর নানান বাঁক তুলে এনেছেন আলমগীর কবির। এর জন্য এই সিনেমার সতর্ক পর্যবেক্ষণ হয়তো দরকার। বিশেষ করে হাল আমলের এক কেন্দ্রিক ইতিহাস নির্মাণের ধারণা ও আত্মসমর্পণের কারণে অনেক বৈপ্লবিক চিন্তা ও ইস্তেহার ধরা পড়ে না। সে দিকগুলো এ সিনেমায় আসছে। বিশেষ করে আজকাল নানান ধারায় সেল্যুলয়েডে স্বাধীনতার প্রশ্নগুলো আসলেও নির্দিষ্ট বর্ণনার বাইরে যাওয়ায় মুশকিল। আইন-আদালত-ভিন্নমত নানান বিষয় তো থাকে। … এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল- রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত হাজির না হওয়া। সব কিছু দেখানোর এই লোভ সামলানো আলমগীর কবিরের পরিমিতিবোধ ও ফোকাস ধরে রাখার সামর্থ্যকে চিহ্নিত করে।

সিনেমাটা বেশ আগে দেখা। এবং উপরের অংশের নির্যাস তখনই লেখা… দীর্ঘ অসুস্থতা জনিত কারণে পরে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আপাতত আবার দেখে লেখাও মুশকিল বটে। মজার একটা বিষয় নিয়ে শেষ করা যাক। পুরো ছবিতে শরমিনকে আমরা শাড়ি পরতে দেখি। অন্যদিকে তার মা ও সৎবোন অ্যানাকে স্কার্ট ও টপসে দেখি। এর কারণ হিসেবে বোঝা যায় অ্যানার মা একজন খৃস্টানকে বিয়ে করেছিলেন। ধর্মের সঙ্গে পোশাকের এই পরিবর্তন অদ্ভুত। হয়তো টুইস্টই বলা যায়। বা উদারতাও হয়তো। কিন্তু মুসলমানিত্বের ব্যাপারগুলো কই। হয়তো বাঙালিত্ব আর মুসলমানিত্ব (প্র্যাকটিসিং অর্থে না) একই ব্যাপার। যাই হোক, এ পোশাকের কাছে বাঙালিত্ব হার মানবে কেন? তাই অ্যানার কাছে প্রেমিকের আবদার… শাড়ি পরে সে হাজির হবে ‘রূপালি সৈকতে’। যেটা মনে করিয়ে দেয় এই শতকের জনপ্রিয় স্লোগান- ‘তুমি কে আমি কে- বাঙালি বাঙালি’।

কথা অনেক দূর ছড়িয়েছে। পুরোনো কথা দিয়েই শেষ করি, ‘রূপালি সৈকতে’ ধরে যতটা এগিয়েছি আলমগীর কবিরকেই যেন বারবার দেখছিলাম।

*মূলত নোকতা আকারে তুলে রাখা। ভবিষ্যতে সম্ভব হলে বিস্তারিত লেখার আশা রাখি।


Leave a reply