আলাপে শুধু ‘১৮+’ সিন কেন?
১. ইন্ডিয়াতে সবচেয়ে বেশি ১৮+ কন্টেন্ট তৈরি হওয়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের একটি হল একতা কাপুরের আলতা বালাজি। বালাজিকে এই দৌড়ে পিছে ফেলে দিয়েছে এমএক্স প্লেয়ার আর উল্লু। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এইসব কন্টেন্টের ভিউ অনেক হলেও, কেউ যখন ইন্ডিয়াতে তৈরি হওয়া সেরা ওয়েব সিরিজের নাম জিজ্ঞাসা করে তখন এই তিনটি প্ল্যাটফর্মের একটি ওয়েবসিরিজের নামও আসে না।
আসে স্যাক্রেড গেমস, পাতাললোক, অসুর, দিল্লী ক্রাইম, মেড ইন হেভেনের নাম। যৌনতা এসব সিরিজেও আছে, তবে গল্পের আর চরিত্রের প্রয়োজনে এসেছে, আরোপিতভাবে আসেনি উল্লুর সিরিজের মত। তো কেউ যদি ভেবে নেয় যৌনতা হলেই হিট হয়ে যাব আর যৌনতা দিলেই দেশের সব সেরা কাজের মাঝে আমার নামটা চলে আসবে- ভুল! গল্প, চিত্রনাট্য, অভিনয়, পরিচালনা ঠিকঠাক না হলে কিছুই হবে না, আপনি যত যৌনতাই আনেন না কেন।
২. স্বাধীনতা আর সাহসিকতা শুধুমাত্র স্বল্পবসনে হয় না। প্রশ্নপত্র ফাঁস, খাদ্যে ভেজাল, উঁচু-নিচুর ব্যবধান, ভোটে কারচুপি থেকে শুরু করে এরকম আরও অনেক বিষয় যদি আমরা আমাদের কাজে তুলে আনতে পারি, তাহলে হয়ত সেটাকে সাহসী কাজ বলা যাবে। শুধু কাপড় খুলে বেশিদিন সাহস প্রদর্শন আর দর্শক টানা যাবে না।
৩. ওয়েব, টিভি, ইউটিউব- সব আলাদা প্ল্যাটফর্ম। পরিবার নিয়ে ওয়েবের কন্টেন্ট দেখতে চাইলে আমার মনে হয় আপনার একটু জেনেশুনে বসা উচিত। টিভিকে ড্রইংরুম মিডিয়া বলা হলে, ওয়েবকে সেপারেট মিডিয়া বলা যেতে পারে।
৪.বিকাল বেলার পাখি আর বড় ছেলে- আমার খুব পছন্দের দুটো কাজ। কিন্তু এই দুটো কাজ দেখে বেশিরভাগ নির্মাতা যেভাবে এই দুটো নাটকের রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছিলেন, তাতে একসময় মনে হচ্ছিল অপূর্ব আর এই জীবনে চাকরি পাবে না আর নিশো এই জীবনে প্রেমিকাকে আর পাবে না। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে binge যে নতুন কিছু করার সাহস দেখাচ্ছে বা শিহাব শাহিন যে নিজের পরিচিত জনরা ছেড়ে থ্রিলারে এসেছেন, সেটাকে কি আমরা সাধুবাদ জানাতে পারি না?
একই রকম কন্টেন্ট দেখলে বলব- নতুন কিছু দেন। নতুন কিছু দেয়ার চেষ্টা থাকলে বলব- দেশের সংস্কৃতি নষ্ট করে দিলেন। এরকম করলে, এত বাঁধাধরা নিয়ম থাকলে তো শিল্প হয় না! আর আমার সংস্কৃতি কি এতই ঠুনকো জিনিস নাকি যে ওয়েব সিরিজের কিছু ১৮+ সিন রাখলে সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে? ওয়েব সিরিজ দেখতে আপনাকে কেউ বাধ্য করছে না কিন্তু, সবার জন্য এভেলেবল না। টাকা দিয়ে কিনে দেখা লাগে এটা (যদি অন্য রাস্তা না জানেন) আপনার না পোষালে দেখবেন না।
১৯৮৯ সালের অবুঝ হৃদয় সিনেমার গানে ববিতা আর জাফর ইকবালের কিসিং সিন ছিল, ঐ সিনের জন্য পরিচালক নাকি বেশ কয়েকটা রিটেক নিয়েছিলেন। এত আগে সেই দৃশ্য নিয়ে কোন সমস্যা না হলে আজকে গল্পের প্রয়োজনে এরকম দৃশ্য দেখানো হলে সমস্যাটা কোথায়?
৫. ‘আগষ্ট ১৪’ ভাল লেগেছে। প্রথন থেকেই একদম হুকড ছিলাম আর একবারও বোরিং লাগেনি, এক বসায় শেষ করেছি। নুসরাত ইমরোজ তিশা আর তানজিন তিশা বাদেও তাসনুভা তিশা নামের একজন সুঅভিনেত্রী আছেন, সেটা আবিষ্কার করার জন্য বিঞ্জের শিহাব শাহিনকে ধন্যবাদ। সংলাপে আরও ভাল কিছু আশা করেছিলাম, পাইনি। ঐশীর বাবা মায়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে নির্মিত এই ওয়েব সিরিজের শেষের দিকে তিশা যখন মুনিরা মিঠুর শরীরে ছুরি বসাচ্ছিলেন না মিঠু আর্তনাদ করে বলে উঠলেন- কী করিস? আমি তোর মা! – এই জায়গাটা দেখে ভয়ংকর অসহায় লেগেছিল।
শেষে শতাব্দী ওয়াদুদের কান্নাও মন খারাপ করে দেয়। তবে আমি এই সিরিজে bad parenting এর জায়গাটা আরও বিস্তারিতভাবে দেখতে চেয়েছিলাম দর্শক হিসেবে। তুশি কীভাবে মাদকাসক্ত হল, কীভাবে দিনের পর দিন সে খারাপ পথেই যেতে লাগলো, বাবা-মার কোন কোন আচরণ দিন দিন তাকে এরকমের ভয়ংকর একটি হত্যাকান্ডের প্ল্যান করতে উৎসাহ দিল- এসব আরেকটু দেখালে হয়ত আরও ভাল লাগতো।
তবে ঐশীর ভাই এখনও জীবিত আর সে এই সমাজেই বাস করে। এই ওয়েব সিরিজ তাকে নতুন করে কোন অস্বস্তিতে ফেলে দেয় কিনা বা ঐশী জেল থেকে যাবজ্জীবন সাজা খেটে বের হলে তাকে আবারও নতুন করে মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত করে কিনা আর তাতে তার জীবনটা নতুন করে নরকে পরিণত হয় কিনা- সেই প্রশ্নটা থেকে যায়। তবে এখন পর্যন্ত দেশের দুটো ওয়েবের কাজ আমার বেশ পছন্দ হয়েছে আর দুটোই শিহাব শাহিনের- দ্বিতীয় কৈশোর আর আগষ্ট ১৪।
৬. বিঞ্জ এসে দেশের সংস্কৃতি শেষ করে দিচ্ছে বলা মানুষগুলো কি শুধুমাত্র আগষ্ট ১৪, সদরঘাটের টাইগার আর বুমেরাং-এর ট্রেলার দেখেই এইসব বলেছেন কিনা- আমার জানা নাই। কারণ বিঞ্জে হরর কন্টেন্ট থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু এঞ্জয়েবল কন্টেন্ট আছে। মূর্দা খাট নামের একটা বেশ ভাল হরর কন্টেন্ট আছে। তৌকীর আহমেদের পরিচালিত কাজও আছে। সেলেব্রিটি টক শো – নক নক, হু ইজ দেয়ার আছে যেখানে মিশা সওদাগর এসেছিলেন। শাকিব খানের সিনেমা থেকে শুরু করে সমস্ত টিভি চ্যানেল বিঞ্জে স্ট্রিম করে দেখার সুবিধা আছে। অর্থাৎ একবারে বিঞ্জের সাবস্ক্রাইবার হলে আপনার আর বাসায় আলাদা করে ডিশের লাইন না নিলেও চলবে। এইসব নিয়ে কেউ কিছুই বলছেন না, সবার আলাপ শুধুমাত্র ১৮+ সিন কেন দেখালো সেটা নিয়ে। কারণটা ঠিক বুঝলাম না।
১৮+ সিন নিয়ে আলোচনা করলে বা একটা ভিডিও দিলে বেশি পাত্তা পাওয়া যায়, ক্রাউড পুল করা যায়- এসবই কি কারণ? তাহলে দিনশেষে কি আপনিও বাকিদের মত না?
(দেশের কন্টেন্ট নিয়ে আজকাল কিছু লিখতে ইচ্ছা হয় না। বিশেষ করে গত পরশু হৃদয় সাহার পোস্টে এসে যখন এক নির্মাতা দর্শকের শিক্ষাদীক্ষার পরিচয় নিয়ে খুবই নোংরাভাবে প্রশ্ন তুললেন। নিজের মত প্রকাশের সময় যদি সাথে করে অনার্স-মাস্টার্স আর এসএসসি, এইচএসসির সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরতে হয়, তাহলে না লেখাই উত্তম!)