আলোচনার টেবিল না পাওয়া শাহনাজ
ঢালিউডের বাণিজ্যিক ছবিতে নব্বই দশক ও তার পরের উল্লেখযোগ্য নায়িকা /অভিনেত্রী শাহনাজ। কিছু তারকা আছে যারা বেশ কাজ করার পরেও চলচ্চিত্র আলোচনাতে সেভাবে টেবিল সরগরম করে আসে না বা তাদের নিয়ে তেমন কথা হয় না। শাহনাজ তাদেরই একজন। চলচ্চিত্র একটা সম্মিলিত অবদানের ফসল তাই উল্লেখযোগ্য সবাইকে নিয়ে কথা বলা উচিত।
শাহনাজের জন্ম – ১৫ জুন, ১৯৬৯ সালে। কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার ভাগলপুর গ্রামে। তার মূলনাম – ফাতেমা আক্তার রিক্তা। এসএসসি – ১৯৮৬, এইচএসসি – ১৯৮৮।
কিশোরগঞ্জের কালিয়াচাপড়া চিনিকল কোয়ার্টারের লোকজনদের কাছে শাহনাজ রিতা নামেই পরিচিত ছিল। তার বাবা চিনিকলে ফোরম্যানের কাজ করত। শাহনাজ কালিয়াচাপড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। স্কুলের নাচ, গান, আবৃত্তি সব ধরনের কালচারাল প্রোগ্রামে তাকে দেখা যেত।
শাহনাজ অভিনীত প্রথম ছবি ১৯৯৩ সালে গাজী হুমায়ুন কবির পরিচালিত ‘পদ্মার চর।’ প্রথম ছবিতে তার নাম থাকে খুশবু। শাহনাজ নাম দেন পরিচালক মোতালেব হোসেন ও এম এ আউয়াল পিন্টু দুজনই পরামর্শ করে।
উল্লেখযোগ্য ছবি : জ্যোতি, পদ্মার চর, সত্যের মৃত্যু নেই, দেশের মাটি, মায়ের কসম, বিদ্রোহী কন্যা, বিদ্রোহী সন্তান, মৃত্যুদাতা, দুরন্ত প্রেমিক, রুটি, হিংসা, আশার প্রদীপ, আত্মত্যাগ, বাংলার মা, মহৎ, চাঁদাবাজ, চালবাজ, হুলিয়া, দুনিয়ার বাদশা, বিশ্বনেত্রী, আত্মরক্ষা, মোনাফেক, আসামী গ্রেফতার, পলাতক আসামী, ওস্তাদের ওস্তাদ, বাবা মাস্তান, ঠাণ্ডা মাথার খুনি, হারামখোর, জোর যার মুল্লুক তার, তুমি কত সুন্দর।
শাহনাজের একক নায়িকার ভূমিকায় প্রথম ছবি ‘জ্যোতি।’ লেডি অ্যাকশনধর্মী এ ছবিটিতে তারই প্রাধান্য ছিল বেশি এবং নাম ভূমিকাতেও সে ছিল। স্টাইলিশ সব গেটআপ নিয়ে তাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। অমিত হাসানেরও একক নায়ক হিসেবে প্রথম ছবি ছিল এটা। লেডি অ্যাকশনধর্মী ছবিতে তাকে আর তেমনটা দেখা না গেলেও ‘হুলিয়া’ ছবিতে কিছুটা ছিল। এ ছবিতে ওমর সানী প্রথমদিকে খুব বোকা থাকে শাহনাজ তাকে ক্যাম্পাস পলিটিক্সের হাত থেকে বাঁচায়, ফাইট করে। অ্যাকশনে ‘জ্যোতি, বিশ্বনেত্রী, দুনিয়ার বাদশা’ উল্লেখযোগ্য।
শাহনাজকে বাণিজ্যিক ছবিতে বৈচিত্র্য রেখেই কাজ করতে দেখা গেছে। ফ্যামিলি ড্রামার মধ্যে ‘আত্মত্যাগ’ ছবিটি ছিল অসাধারণ। এছাড়া ‘বাংলার মা, তুমি কত সুন্দর’-ও উল্লেখযোগ্য। রোমান্টিক ফ্যামিলি ড্রামাতে ‘মহৎ’ ছবিটি চমৎকার ছিল। ক্যারিয়ারের প্রথমদিকের ছবি এটা। ‘প্রেম কখনো মধুর’ গানটি তাকে অমর করে রাখবে। গানে ইলিয়াস কাঞ্চন, ওমর সানী-দের সাথে তাকে দেখা যায়।
শাহনাজের সেরা ছবি অবশ্যই ‘সত্যের মৃত্যু নেই।’ অমর নায়ক সালমান শাহ-র সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। একটা সাক্ষাৎকারে সালমান সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিজেকে ‘লাকি’ বলেছিল। এ ছবিতে সালমানের সাথে তার রসায়ন চমৎকার ছিল। সালমান যখন তাকে ফিরিয়ে দেয় রেললাইনে আত্মহত্যা করতে যাবার সময় সালমান পেছন থেকে ‘আই লাভ ইউ’ বললে শাহনাজের পেছন ফিরে বলা সংলাপ ‘আবার বলো জয়’ শুনতে অসাধারণ লাগে। সালমানকে তাঁর মা শাবানা যখন ভুল বোঝে শাহনাজই বাড়ি বয়ে এসে তাঁর মাকে জানায় সালমান সম্পর্কে। শাবানা ও শাহনাজের কথোপকথনে শাহনাজের অভিনয় অসাধারণ ছিল। যখন বলে ‘আমি যতটুকু আপনার ছেলেকে চিনি আপনি নিজেও হয়তো চেনেন না।’ সালমান এসে তাকে চড় মারলে শাহনাজ আরো একটি টাচি সংলাপ বলে- ‘যে ছেলে কোনোদিন মেয়েদের গায়ে হাত তোলেনি সে আজ আপনার জন্য তাঁর ভালোবাসার গায়ে হাত তুলেছে। কত মহৎ ছেলে আপনি জন্ম দিয়েছেন একবার দেখে নিন।’ শাহনাজের সংলাপগুলো শুনতে শুনতে সালমানের মা-বাবা শাবানা-আলমগীরের বিস্মিত চোখ দেখার মতো ছিল। সালমানের ফাঁসির আদেশ হবার পর শাহনাজ এক সিকোয়েন্সে আঁচল পেতে শাবানার কাছে সালমানকে ভিক্ষা চায় এবং বোঝায় সাক্ষী দিলে সালমানকে বাঁচানো যাবে না। তখনও শাহনাজের অভিনয় চমৎকার ছিল। শাহনাজের ‘আশার প্রদীপ’ ছবিটিও অন্যতম সেরা। স্যাক্রিফাইসিং রোলে অসাধারণ ছিল।
শাহনাজের স্ট্রং জুটি ছিল অমিত হাসানের সাথে। তাদের জুটির ছবিগুলো হচ্ছে – জ্যোতি, হিংসা, আত্মত্যাগ, আশার প্রদীপ, বিদ্রোহী সন্তান, আসামী গ্রেফতার, হারামখোর, জোর যার মুল্লুক তার। প্রথম ছবিতেই দুজনের রসায়ন দারুণ ছিল। দুজন দুই ভূমিকার ছিল। শাহনাজ দেশপ্রেমিক আর অমিত দেশদ্রোহী। একসময় তাদের প্রেম হয়। এ ছবির ‘পৃথিবীর জন্ম যেদিন থেকে’ গানটি খুবই জনপ্রিয়। ‘আত্মত্যাগ’ ছবিতেও তাদের রসায়ন দেখার মতো। এ ছবিতে তাদের ‘ষোলো থেকে সতেরো পার হয়েছি আঠারো’ গানটি অনবদ্য। ‘হিংসা’ ছবিতে ‘তুমি আমার বাড়ি’ গানটিও খুবই জনপ্রিয়। এছাড়া ‘বিদ্রোহী সন্তান’ ছবির ‘জীবনে প্রথম প্রেম তুমি প্রথম ভালোবাসা আমার’ গানটিও উল্লেখযোগ্য। ‘আসামী গ্রেফতার’ ছবিতে ‘এইতো আমি এখানে’ গানটিও জনপ্রিয়। তাছাড়া এ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতির ‘আমার এ গান তোমারই জন্য’ গানে অমিত-শাহনাজকে পারফর্ম করতে দেখা যায়। সবগুলো গানই রেডিওতে জনপ্রিয় ছিল।
শাহনাজের পরের জুটিগুলো গড়ে উঠেছিল মান্না ও ওমর সানী-র সাথে। মান্না-র সাথে ‘দেশের মাটি, মৃত্যুদাতা, রুটি, মায়ের কসম, শান্ত কেন মাস্তান, লাঠি, ঝড়, টোকাই রংবাজ, ধ্বংস, বাবা মাস্তান, ঠাণ্ডা মাথার খুনি’ উল্লেখযোগ্য ছবি। ‘ঠাণ্ডা মাথার খুনি’ ছবিতে মান্না-র ডাবল রোল থাকে। শাহনাজ বাবার ভূমিকায় থাকা মান্না-র স্ত্রী। দুজনের মধ্যে কথার যুদ্ধ চলে সবসময়। একটা সিকোয়েন্সে খুব রহস্য করে কথা বলে মান্না ও শাহনাজ। শাহনাজের গেটআপ ও স্লো ডায়লগ ডেলিভারি দারুণ ছিল ছবিটিতে। পরে মান্না শাহনাজকে হত্যার নির্দেশ দেয়। ওমর সানী-র সাথে জুটিটা ঠিক সেইভাবে গড়ে ওঠেনি তবে সম্ভাবনা ছিল। তাদের ছবিগুলো হচ্ছে – মহৎ, চালবাজ, হুলিয়া। এর মধ্যে ‘মহৎ’ ছবিতে ‘প্রেম কখনো মধুর’ কালজয়ী গান।
শাহনাজ সফল নায়িকা/অভিনেত্রী। তার ক্যারিয়ারে ফ্লপ ছবি তেমন নেই। ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ঢালিউডের অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল ছবি।
শাহনাজের ছবির জনপ্রিয় গানগুলো :
প্রেম কখনো মধুর – মহৎ
পৃথিবীর জন্ম যেদিন থেকে – জ্যোতি
সুখের আরেক নাম – সত্যের মৃত্যু নেই
নয়নের কাছে থেকো – সত্যের মৃত্যু নেই
ষোলো থেকে সতেরো – আত্মত্যাগ
খুলো না ঢাকনা – আত্মত্যাগ
তুমি আমার বাড়ি – হিংসা
তুমি এই হৃদয়ের যন্ত্র আমার – দুনিয়ার বাদশা
আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে – আশার প্রদীপ
জীবনে প্রথম প্রেম তুমি প্রথম ভালোবাসা আমার – বিদ্রোহী সন্তান
তুমি যদি ভালোবাসো স্বর্গে আমি যাব না – বাংলার মা
প্রেম করেছি আমি এমন লোকেরই সাথে – বিদ্রোহী কন্যা
চিরদিন তুমি যে আমার – চালবাজ
এই তো আমি এখানে তোমারই কাছাকাছি – আসামী গ্রেফতার
সজনী গো সজনী – দুরন্ত প্রেমিক
প্রতি নিঃশ্বাসে রয়েছ তুমি – শান্ত কেন মাস্তান
লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ এসেছে – লাঠি
শাহনাজ তার ক্যারিয়ারে ২০০০ পরবর্তী অশ্লীলতায় দুঃখজনকভাবে জড়িয়ে যায়। অশ্লীল দৃশ্যে খুব অ্যাকটিভ না থাকলেও নিজেকে আবেদনময়ী করে উপস্থাপন করেছে বেশকিছু ছবিতে ও গানে। এজন্য তার ক্যারিয়ার অনেকটাই সমালোচিত।
প্রথমদিকের বা নব্বই দশকের সুইট লুক ও ন্যাচারাল অভিনয়গুণে শাহনাজ ভালো মানের অভিনয়শিল্পী ছিল বাণিজ্যিক ছবিতে। তার ক্যারিয়ার হয়তো আরো লম্বা হতে পারত সিরিয়াস থাকলে।
তাকে খবরের কাগজে বা টিভিতে দেখাই যায় না। ইউটিউবেও নেই কোনো সাক্ষাৎকার। সেদিক থেকে প্রচারবিমুখ বলেই মনে হয়।
শাহনাজকে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম একজন নায়িকা/অভিনেত্রী হিসেবে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে এ আয়োজন। আলোচনার টেবিল পাক সে অন্যান্যদের সাথে।