Select Page

আশা জাগানিয়া ছবি দেশা

আশা জাগানিয়া ছবি দেশা

Desha (3)সিনেমা হলের সামনে এত ভিড় আর ধাক্কা ধাক্কি আমি আগে খুব একটা দেখিনি। হলের সামনে গিয়েই খুব ভালো লাগছিল। বেশ ঠেলা ঠেলি করে হলে ঢুকতে হয়েছিল, টিকেটের মূল্য আবার দশ টাকা বেশী। সৈকত নাসিরের প্রথম ছবি “দেশা দ্য লিডার“, আবার অভিনেতা শিপনের হাতে খড়ি এই ছবিতে – দুজনই নতুন। ছবিটির তিনটি শক্তিশালী ভিত্তি এক চিত্রনাট্য ও নির্মাণ দুই তারিক আনাম খান আর তিন মাহিয়া মাহি। আমি নবাগত শিপনকে সেভাবে সিনেমাটিতে পাইনি।

প্রথমে চিত্রনাট্যের কথা বলি বেশ জমাটে একটা চিত্রনাট্য। এরকম প্লটের বা বক্তব্যের ছবি বাংলাদেশে একেবারে নতুন না হলেও গল্পের বুননে আর দৃশ্যের সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্ট এ বেশ নতুনত্ব আছে। গল্পের ধারাবাহিকতা কে বেশ সফলভাবেই ধরে রাখে চিত্রনাট্য, বেশ চড়াই উতরাই আছে গল্পে। তাই পরিচালনার চেয়েও চিত্রনাট্যকারকে আমি একটু এগিয়ে রাখব। নির্মাতা সৈকত নাসিরের প্রথম চলচ্চিত্র দেশা, আমি এতটা আশা করিনি যতটা পেয়েছি, গল্প এবং দৃশ্যের ধারাবাহিকতা, দৃশ্যের বিভাজন ইত্যাদি নির্মাণের সকল ক্ষেত্রেই সৈকত নাসির যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে গল্পের পরিণতিটা বেশ প্রেডিক্টেবল। আমার পাশে বসা অনেক দর্শকই কানাঘুষো করছিল “আসলে অমুকই ভিলেন, তমুকই যত নষ্টের মূল”। দর্শকেরা এখন বেশ ক্লাইমেক্স সচেতন বুঝা যায়, আগাম ধরে ফেলে সবকিছু, কিন্তু গৎবাঁধা গল্প এরকমটা কখনই না বরং শেষ পরিণতি দেখার জন্য হল ভর্তি দর্শক অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে।

দুই নম্বর আর তিন নম্বর ভিত্তি নিয়ে বলার আগে মাঝ খানে কিছু কথা বলে নেই, সিনেমাটির শিল্প নির্দেশনার প্রশংসা না করলেই নয়। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ, প্রটোকল, টেলিভিশন চ্যানেলের সেটআপ, গানের দৃশ্যায়নের সেট, সিনেমায় ব্যবহার করা প্রপ অত্যন্ত বাস্তবিক মনে হয়েছে। শিল্প নির্দেশকের প্রতি সাধুবাদ। সঙ্গীত, আবহ সঙ্গীত, শব্দ সংযোজন প্রশংসার দাবিদার। আবহসঙ্গীতের ব্যবহার অত্যন্ত দৃশ্য সংবলিত এবং ছবিটির আবহকে সার্থকতার সাথে সিনেম্যাটিক করে তোলে। সব গুলো গানই শ্রুতি মধুর। আসছে দেশা আসছে গানটি যখন শুরু হয় দর্শক রীতিমত চিৎকার দিয়ে গাওয়া শুরু করল আর সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছিল জেমসের নাম। মনে হচ্ছিল জেমসের একটা গানই অনেক দর্শক টানতে সক্ষম।

চিত্রগ্রহণ ভালো। আমাদের দেশে ক্যামেরার ফ্রেমের ভিতরে বিশাল ক্রাউড নিয়ে কাজ করতে গেলে প্রায় সময়ই তালগোল পাকিয়ে যায় তাই অনেক পরিচালককেই দেখি যেখানে একটা বড়সড় রকমের ক্রাউডের দরকার সেখানে ঝামেলা এড়াতে বা টাকা বাঁচাতে দশ বিশ জন লোক দিয়েই দৃশ্য ধারণ সম্পন্ন করেন। এ ক্ষেত্রে নির্মাতা সৈকত নাসির বেশ সাহসীই বলতে হবে। পরিচালক যেখানে যত বড় ক্রাউডের প্রয়োজন পড়েছে সেখানে সেরকমটিই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবে কিছু দৃশ্যে ফ্রেমের ভিতরের ক্রাউড ম্যানেজমেন্টে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন এবং কৃত্রিমতা ছিল।

দুই নম্বর ভিত্তি তারিক আনাম খান সিনেমাটির প্রাণ শক্তি। তার দক্ষতা নিয়ে বলবার মত কিছু নেই। তার জাত তিনি চিনিয়েছেন। একেকটা এক্সপ্রেশন, একেকটা ডায়লগ থ্রো অসাধারণ। সম্পূর্ণ ছবিটির মূল ফোকাসই ছিল তার উপর। নবাগত শিপন কিছুটা হতাশাজনক, অভিনয়ে যথেষ্ট অপরিপক্বতা। তার এক্সপ্রেশন, উচ্চারণ, ডায়লগ থ্রো এমনকি এক্সপ্রেশনের টাইমিং সেন্সও হতাশাজনক। তার আরও গ্রুমিং এর অবকাশ ছিল। তাই হয়ত পরিচালক খুব সচেতন ভাবেই শিপনকে বেশ এড়িয়ে গেছেন গোটা ছবিতে। শিপনের প্রবেশ ছবির প্রথম দিকে হলেও শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা ক্যামেরায় তাকে দেখা গেলেও তার এক্সপ্রেসিভ বা এ্যক্টিং প্রেজেন্স উল্লেখ করার মত ছিলনা বরং গোটা ফ্রেম জুড়েই ছিলেন তারিক আনাম খান। তবে শিপনকে নিয়ে আমি আশাবাদী, নায়কোচিত চেহারার এই অভিনেতাকে গ্রুমিং করা গেলে ভবিষ্যতে ভালো কিছু আশা করা যেতে পারে।

তৃতীয় ভিত্তি মাহিয়া মাহি। আমার দেখা তার ছবিগুলোর মধ্যে তিনি সবচেয়ে ভালো করেছেন দেশাতে। অভিনয়ে পরিপক্কতা ছিল। একজন টিভি উপস্থাপিকা এবং রিপোর্টারের চরিত্রে অভিনয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি তিনি ভালোই রপ্ত করেছেন। গ্ল্যামার নিঃসন্দেহে ষোল আনা এ ক্ষেত্রে তার পোশাক এবং মেকআপ যারা করেছেন তারাও প্রশংসার দাবিদার। যদি এক কথায় বলি, মাহি আগের চেয়ে অনেক বেশী পরিণত। ছবিটির শেষ দৃশ্যটি নিয়ে অনেকের একটু আফসোস রয়েছে। অনেকে বলছেন আরও একটু ডিটেইলিং দরকার ছিল, আবার শোনা গেছে দৃশ্যটি নাকি সেন্সর বোর্ডের কাঁচির কবলে পড়েছিল। তবে আমার কাছে ভালোই লেগেছে ওপেন এন্ডেড ফিনিশিং। শেষ দৃশ্য দেখে এটাও মনে হতে পারে, হয়ত ছবিটার সিকোয়াল নির্মিত হবে ।

দেশা

গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব মূলক শাসন ব্যবস্থায় জনগণও একেকটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপাদান তাই যে কোন দেশের অগ্রগতিতে জনগণের অবদান বা অন্তর্ভুক্তি মানে কিন্তু এক দিক দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা রাজানীতিবিদদের ও অন্তর্ভুক্তি।

 

রাজনৈতিক বক্তব্য নির্ভর সিনেমা দেশা। কিন্তু কতটা রাজনৈতিক বক্তব্য ছবিটি দিয়েছে নাকি এক পেশে রাজনীতির বিরোধিতা করে গেছে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। পৃথিবীর সব পেশাতেই ভালো খারাপ দুটোই আছে রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবিতে সাধারণত দুটো দিকই দেখা যায় ভালো আর খারাপ, পরিচালকেরা হয়ত খারাপ দিকটার দিকে আঙ্গুল তুলেন আর ভালো দিকটা গ্রহণ করতে বলেন কিন্তু সেটাও রাজনৈতিক ভাবেই। দেশা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সিনেমাটিতে রাজনীতির শুধু খারাপ দিকটাই তুলে ধরা হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি রাজনীতিতে ভালো মানুষও আছেন তা না হলে কোন দেশই টিকে থাকতে পারেনা। গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব মূলক শাসন ব্যবস্থায় জনগণও একেকটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপাদান তাই যে কোন দেশের অগ্রগতিতে জনগণের অবদান বা অন্তর্ভুক্তি মানে কিন্তু এক দিক দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা রাজানীতিবিদদের ও অন্তর্ভুক্তি। তবে ভালো খারাপ দুটোই আছে সে দিক দিয়ে যদি চিত্রনাট্যে দু একটা ভালো বা অপেক্ষাকৃত ভালো রাজনৈতিক চরিত্র রাখা যেত তাহলে ছবিটা আরও যৌক্তিক হত।

সিনেমা আসলে ডিরেক্টরস মিডিয়া পরিচালক তার বিশ্বাসে যা দেখাতে চান সিনেমা সেটাই। পরিচালক সৈকত নাসির হয়ত রাজনীতির এই দিকটাই দর্শক কে বেশী করে দেখাতে চেয়েছেন। বক্তব্য যেটাই হোক বাংলাদেশের সিনেমা বিচারে দেশা এ বছরের শেষে পাওয়া দর্শকদের কাছে একটি উপহার স্বরূপ। সারা বছরের বিভিন্ন রকম সিনেমার মধ্য থেকে দেশা কে আলাদা ভাবে মনে রাখা যাবে সন্দেহাতীত ভাবে, দেশা এমন একটি সিনেমা যা আশা জাগায় নতুন বছরেও দেশে আরও ভালো ভালো ছবি হবে। আশা জাগানিয়া ছবি দেশা


Leave a reply