আহমেদ রুবেল একজনই
আহমেদ রুবেল বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত, জনপ্রিয় অভিনেতা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে তাঁর ভালো অবস্থান আছে। বলিষ্ঠ এ অভিনেতার সবচেয়ে বড় দিক তাঁর ভয়েস। ডায়লগ ডেলিভারির সময় কবিতা আবৃত্তির মতো বলিষ্ঠ লাগে। তাঁর অভিনয় যারা পছন্দ করে ভয়েসের জন্যই বেশিরভাগ করে থাকে। ব্যক্তিত্বও চমৎকার। ফিটনেসের দিক থেকেও দেখার মতো।
মূলনাম আহমেদ রাজিব রুবেল ওরফে আহমেদ রুবেল। জন্ম ১৯৬৮ সালের ৫ অক্টোবর, চাঁপাইনবাবগণ্ঞ্জ জেলার রাজারামপুর গ্রামে। মা-বাবা দুজনেরই বাড়ি চাঁপাইনবাবগণ্ঞ্জ। একসময় গাজীপুরে বসবাস ছিল। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল অভিনেত্রী তারানা হালিমকে। তাদের সংসার বেশিদিন টেকেনি।
নাটকের দলের অর্গানাইজার ছিলেন তার বাবা। শিল্পকলা একাডেমির সেক্রেটারিও ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারও করতেন। আহমেদ রুবেল ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর প্রতিষ্ঠাতা সেলিম আল দীনের সাথে পরিচিত হবার পর সেলিম আল দীন তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগে ভর্তি হবার পরামর্শ দেন। কিন্তু রুবেল রাজি হয়নি কারণ ততদিনে অন্য জায়গায় তার অনার্সের দেড় বছরের মতো প্রায় চলে গিয়েছিল। ‘ঢাকা থিয়েটার’-ই ছিল তার অভিনয়ের হাতেখড়ি। মামুনুর রশীদের কাছে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল একবার। তিনি রুবেলকে অভিনয়টাকে সিরিয়াসলি নিতে বলেন এবং তার ভেতরে প্রতিভা আছে বলেন। ঢাকা থিয়েটার থেকেই তাঁর অভিনয়জীবন শুরু। মঞ্চের পেশাদার অভিনেতা ছিল বলেই অভিনয়টা পাকাপোক্ত আহমেদ রুবেলের। সেলিম আল দীনের ‘হাত হদাই, বনপাংশুল, যৈবতী কন্যার মন’ নাটকগুলোতে মঞ্চে অভিনয় করেছিল রুবেল।
টিভিতে তার প্রথম নাটক প্রচারিত হয় শ্রদ্ধেয় আতিকুল হক চৌধুরী-র পরিচালনায়। আর প্রথম টিভি নাটকে কাজ করেন গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নযাত্রা’-তে।’ টিভি নাটকে তার একটা শক্ত অবস্থান ছিল। হুমায়ূন আহমেদ ও মুহাম্মদ জাফর ইকবাল দুই ভাই-ই আহমেদ রুবেলের ক্যারিয়ারের জন্য বড় একটা ভূমিকা রেখেছিল। হুমায়ূন আহমেদের ‘পোকা’ নাটকের ‘ঘোড়া মজিদ’ চরিত্রটি তাকে রাতারাতি জনপ্রিয়তা দেয়। এরপর মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ভৌতিক থ্রিলার উপন্যাস ‘প্রেত’-এর রুমি চরিত্রটি একুশে টিভিতে প্রচারের পর তার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস থেকে নাটকটি পরিচালনা করেছেন আহির আলম। পরিচালক ছিল অভিনেত্রী সাবেরী আলমের ভাই যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এছাড়া বিটিভির আরেক জনপ্রিয় থ্রিলার ‘বিশ্বাস’-এ আহমেদ রুবেল শক্তিশালী চরিত্রে ছিল। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নযাত্রা’ নাটকে আফসানা মিমির বিপরীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে ছিল।
অন্য উল্লেখযোগ্য নাটক/ধারাবাহিক – স্বপ্নযাত্রা, একতারা দোতারা, পুষ্পকথা, মায়েশা, খোয়াবনগর, ৬৯, কাবুলিওয়ালা, সবাই গেছে বনে, বৃক্ষমানব, বলবান জামাতা, মায়েশা, লি, শত্রু, অতিথি, দ্বন্দ্ব সমাস, যমুনার জল দেখতে কালো, মৃত্তিকার মন, স্বপ্নমানুষ, স্বপ্ন ও বাস্তবতা, অচিন রাগিনী, ওপেনটি বায়োস্কোপ, ছায়া ও কায়া, শার্ট, দ্বিতীয় জীবন, তুমি শুধু আমার, কবি ও কবিতা, সাহিত্যিকের বউ, দূর পাহাড়ের বাতাসেরা, সিঁদ কাটা চোর, ভুলে ভেসে কূলে আসা, শূন্যস্থান পূর্ণ, বারোটা বাজার আগে, নকশীপাড়ের মানুষেরা, রঙের মানুষ, এফএনএফ, রাজুর সাগর দেখা, এ জার্নি বাই বোট, জোছনা ও রহিমের কিছু দৃশ্যকল্প, স্বরে অ, স্বপ্ন ও বাস্তবতা, খুন, মেঘরঙ মেয়ে, কাছের খুব দূরে, ঢাকা, শত্রু, চেয়ার, স্বর্ণকলস, পাথর, অতল, আয়েশার ইতিকথা, দ্বিতীয় জীবন, বদলি সুরত।
এবছর তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় ওয়েব সিরিজ ‘ফেলুদা’-তে অভিনয় করতে যাচ্ছে আহমেদ রুবেল। ‘ফেলুদা’-র চরিত্রে থাকছে রুবেল এবং জটায়ু চরিত্রে আজাদ আবুল কালাম।
ঢালিউডের মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয় খলনায়ক হিশেবে। ১৯৯৪ সালে ‘আখেরি হামলা’ ছবিতে অভিনয়ের অফার আসে। এরপর টানা ১২/১৪ টি ছবিতে অভিনয় করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘কে অপরাধী, আজকের ফয়সালা, রঙিন রংবাজ, মুক্তির সংগ্রাম, সাবাশ বাঙ্গালী’ ইত্যাদি। ‘কে অপরাধী’ ছবিতে শাবনূরকে বিয়ে ও খুন করার পেছনে খলনায়ক হয়ে অসাধারণ অভিনয় ছিল তাঁর। এ ছবিতে ডলি সায়ন্তনী-র হিট গান ‘বিষম পিরিতি’ ব্যবহার হয়েছিল। গানে ছবির সাইড নায়িকা তৃষ্ণা-র সাথে আহমেদ রুবেলকে নাচতে দেখা গেছে।
‘মুক্তির সংগ্রাম’ ছবিতে ছিল সাইকোলজিক্যাল সমস্যায় ভোগা এক প্রেমিকের চরিত্রে। খলনায়ক হবার একটা সমূহ সম্ভাবনা ছিল তাঁর মধ্যে যদি সিরিয়াস থাকত। এরপর একটা বিরতির পরে আবার অভিনয় শুরু। তার একটা ইন্টারভিউতে বলতে দেখা যায় ‘ আমি যখন নব্বই দশকে আমাদের ছবিতে কাজ করতাম তখন কলকাতার ইন্ডাস্ট্রির থেকে আমরা অনেক এগিয়ে ছিলাম। আমাদের এখানে কোটি টাকায় ছবি নির্মিত হলে ওখানে ৩০/৪০ লাখ টাকায় ছবি নির্মিত হত।’ কথাটা সত্য। যারা জানে না এবং নাক সিঁটকায় আমাদের তখনকার ছবি নিয়ে তাদের জানা উচিত। তখন বরং আমাদের ছবির স্যুটিং বাইরের দেশেও হত টলিউডের ক্ষেত্রে এঘর-ওঘর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি অফট্র্যাকেও তার জুড়ি ছিল না। যেমন -‘মেঘলা আকাশ, ব্যাচেলর, চন্দ্রকথা, দ্য লাস্ট ঠাকুর, গেরিলা, জোনাকির আলো, পারাপার, পৌষ মাসের পিরিতি।’
‘ব্যাচেলর’ ছবিতে ‘কেউ প্রেম করে’ শিরোনামে এস. আই. টুটুলের জনপ্রিয় গানটির মূল অভিনয়শিল্পী আহমেদ রুবেলই। বিপরীতে ছিল অপি করিম। ‘চন্দ্রকথা’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয় ছিল। ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’ নামে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে একটি আধিপত্যভিত্তিক বাহিনীর ছবিতে তাঁর অভিনয় ও গেটআপ ছিল দুর্দান্ত। ছবিতে একটি বংশীয় ঠাকুরকে শেষ করার মিশনে শক্তিমান চেয়ারম্যান চরিত্রে অভিনয় করেছিল। ছবিটি ২০০৯ সালে দক্ষিণ এশীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি বোর্ডের বিচারে সেরা মিউজিক শাখায় পুরস্কার জেতে। ২০১৪ সালে টলিউডে ঋতুপর্ণা ও পাওলি দামের বিপরীতে ‘পারাপার’ ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। ঋতুপর্ণা নিজে বলেছিল-‘আহমেদ রুবেল একজন অসাধারণ পারফর্মার।’ ছবিটি তাকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করায় কারণ ছবিটি বিদেশেও প্রদর্শিত হয়েছিল।
স্যামুয়েল বেকেট রচিত বিখ্যাত নাটক ‘ওয়েটিং ফর গডো’-র থিম থেকে নির্মিত ‘হাম্পটি ডাম্পটি’ ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছে আহমেদ রুবেল। ছবিটি মুক্তি পায়নি। ‘চন্দ্রকথা’ ছবিতে আমিন চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সমালোচক শাখায় ২০০৪ সালে মেরিল প্রথম আলো-তে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিল। তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তি অনুসারে আরো পুরস্কার প্রাপ্য ছিল এমনকি আরো অনেক ছবিতে তাকে কাজে লাগানো যেত। তার অসাধারণ ভয়েস নিয়েও কাজ করা যেত।
বাণিজ্যিক ছবিতে যখন কাজ করছিল একবার নিজের ছবি দেখতে সিনেমাহলে গিয়েছিল আহমেদ রুবেল। টিকেট কাউন্টারে হাত ঢোকাতে গিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয় সিরিয়াল নিয়ে। সেদিন আর দেখা হয়নি। বাড়ি চলে আসতে হয়েছিল। কয়েকদিন পর আবার গিয়েছিল। এটা তার স্মরণীয় ঘটনা ছিল।
আহমেদ রুবেলের ক্যারিয়ার যতটুকুই এসেছে তাতে অসাধারণত্ব আছে। কিন্তু তাঁর প্রতিভার বিচারে তাঁর আরো সুযোগ প্রাপ্য ছিল। তাঁর অভিনয়শক্তি অনুযায়ী অনেক জরুরি চরিত্র তাঁকে আমরা দিতে পারিনি। এজন্য তাঁকে নিয়ে আফসোস হয় অনেক। যদিও আফসোস করাই আমাদের নিয়তি। আমাদের হাতের কাছেও বলিষ্ঠ অভিনেতা থাকতেও আমরা চোখে দেখি না। ইগনোর করি। এই কালচার পরিবর্তন হওয়া জরুরি।
আরেকজন আহমেদ রুবেল আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি! বা আদৌ কি পারব! অনেক অভিনেতার মধ্যেও নিজের ব্যক্তিত্ব, অভিনয়ক্ষমতায় বিপুল দর্শকের মনে জায়গা করে নেয়া একজন অভিনেতা তিনি। তাকে একবাক্যে পছন্দ করা দর্শকের সংখ্যাই বেশি। তাই দেশের অনেক অভিনয়শিল্পীর ভিড়েও তাঁর ক্ষেত্রে কথা একটাই ‘আহমেদ রুবেল একজনই।’
বি. দ্র. লেখাটি তৈরিতে স্মৃতি ও ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ বাদে তথ্যের জন্য গুগল, ইউটিউব ইন্টারভিউ-এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।