
ইনসাফ: শরিফুল রাজের ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভ!
‘ইনসাফ’ আসলে কতটা ফিল্ম হতে পারলো, এর চাইতে কেন বলছি শরিফুল রাজের জন্য এটা একটা প্রিম্যাচিউর প্রোডাকশন…
[স্পয়লার সংক্রান্ত রিজার্ভেশন থাকলে আমার ফিল্ম বিষয়ক লেখালিখি পড়তে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করছি]
২০৩১ সালে যে কমার্শিয়াল ফিল্মটি নির্মিত হওয়ার কথা শরিফুল রাজকে লিড ক্যারেক্টারে রেখে, সেটি যদি ২০২৫ এ রিলিজ পেয়ে যায়? অথবা ২০২৫ সালে যে ছেলেটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে ৬ বছর পরে তার ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কথা, এটা ধরে যদি কোনো আপাত শৌখিন অথচ অর্বাচীন পিতা তাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেয়?
বাস্তবে এমন ঘটে না, তবে থিওরিটিকাল ফিজিক্সে এর সম্ভাব্যতা স্বীকার করে নাম দিয়েছে ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভ (সিটিসি)।

রাজের নামেই সিনেমা চলার দিন আসেনি এখনো, আরো অন্তত ছয় বছর প্রাসঙ্গিক থাকতে পারলে তখন হয়তোবা তার নামের ওপর অর্থলগ্নি করবে প্রডিউসাররা, বাড়বে ফিল্মের বাজেট, তার প্রভাব পড়বে লুক অ্যান্ড ফিলে! বাংলা ফিল্মে বর্তমানে যারা লিড রোলে অভিনয় করে (শাকিব খান বাদে) কাউকেই বড়স্ক্রিনে দেখে নায়কোচিত লাগে না, অরাটা মিসিং: হিউমারাস দৃশ্যে শাকিবের অভিনয় এখনো দুর্বল, উচ্চারণ আরোপিত। শরিফুল রাজ সবদিক দিয়েই পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ, বাড়তি সংযোজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ফলে শাকিবের পরে যদি বাংলা ফিল্ম কমার্শিয়ালি সফল করতে হয়, রাজই সবচাইতে আগানো অপশন।
তার আগ পর্যন্ত দারিদ্রের দুষ্টচক্রে পড়ে সে গোত্তা খেতে থাকবে। সস্তার তিন অবস্থা মেনে তাকে কাজ করতে হবে নিম্নমেধার ও চটুলচিন্তার পরিচালকদের সাথে, মূলত মার্কেটে ফেসভ্যালু জারি রাখতে!
একটা ফিল্মকে কমার্শিয়ালি সফল বানানো আর্ট-কালচারের দুরূহতম কাজ। এনজিওর পয়সায় ফিল্ম বানিয়ে বিদেশি ফেস্টিভ্যালে যাওয়া ফিল্মগুলোর টপিক-আর্টিকুলেশনের অলিখিত গাইডলাইন থাকে, যদি লবি শক্তিশালী হয় ফেস্টিভালে ফিল্ম পাঠানোও সম্ভব হতে পারে। কিন্তু কী কারণে একই সুপারস্টারের একটা ফিল্ম ১৩ কোটি অন্যটা ৪৩ কোটি আয় করে অথবা রিলিজের সময়ই ফোরকাস্ট করা এর থেকে কত আয় হতে পারে— কখনোই ফরমুলেশন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশি অধিকাংশ ফিল্ম ডিরেক্টরের চিন্তায় ক্লারিটি নেই, কমার্শিয়াল শিল্পজ্ঞান অতি সীমিত, এবং লাইফস্টাইলে ফিল্ম ব্যাপারটাই বহুলাংশে অনুপস্থিত। প্রিয় ডিরেক্টরের প্রশ্নে তারা গোদার্দ-স্ট্যানলি কুবরিক-হিচককের নাম বলে, প্রিয় ফিল্ম টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান-দ্য গডফাদার, কিন্তু নিজেরা ডেলিভার দেয় এফ আই মানিক কিংবা দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর চাইতেও নিম্নমানের কালচারাল প্রোডাক্ট। তারা থাকে কোরিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ বা তেলুগু ফিল্ম দেখে মূলত কপি-পেস্টের ধান্ধায়।
যদি প্রশ্ন করি ফিল্মের মূল অ্যাট্রাকটিং পয়েন্ট কী; কাহিনী, ক্যারেক্টার, নাকি মেকিং?
তিন নম্বর পয়েন্টকে নিউট্রাল পজিশনে রাখি, কারণ ভিজুয়ালিটিই ফিল্মকে বই থেকে আলাদা করে। বাকি দুটোর মধ্যে কোনটি এগোনো বুঝবার ক্ষেত্রে আমরা কয়েকটা রেফারেন্স ব্যবহার করতে পারি।

— বাংলাদেশে ১৫ উর্ধ্ব একজন অক্ষরজ্ঞানী মানুষও হয়ত পাওয়া যাবে না যে এই গল্পটা শুনেনি, বহুকাল আগে এক কচ্ছপ এক খরগোশকে দৌড়ের চ্যালেঞ্জ জানায়। তারপর কী ঘটে সবাই জানে। এই গল্পটার নাম অনেকেরই অজানা, শুধু বললেই হয় খরগোশ-কচ্ছপের গল্প, পুরোটা শোনার বা বলারও দরকার পড়ে না। অর্থাৎ সময় যত এগিয়েছে কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা কমতে কমতে কোড নেম তথা ক্যারেক্টারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এবং প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে ক্রেজি ফিল্মের নাম ‘বেদের মেয়ে জোছনা’। নায়ক সোহেল রানা ও ইলিয়াস কাঞ্চন পৃথক দুটি ইন্টারভিউতে এ দুই ফিল্মের ক্রেজ বর্ণনা করেছিলেন। সে সূত্রে জানা যায় আট মাস ধরে চলেছিল ফিল্মটা, সেসময় দেশে ১২ শতাধিক সিনেমা হল, বছরে ফিল্ম রিলিজ হয় ৮০-৯০টি! কম্পিটিশনের লেভেল বুঝুন। এই ফিল্ম দেখতে প্রসূতি মা হলে গেছে, হলের ভেতরে বাচ্চা ডেলিভারি হয়েছে, ফিল্ম না দেখানোয় সংসার ভেঙে গেছে, গরুর গাড়ি-ঘোড়ার গাড়িতে করে লোকজন হলে এসেছে! সেই ফিল্মের স্টোরিলাইন ভুলে গেছি অনেকেই, শুধু মনে আছে অঞ্জু ঘোষের নাম জোছনা, যে রাজকন্যা হয়েও পালিত হয় বেদের আশ্রয়ে!
আমার থিসিস হলো দর্শক ফিল্ম দেখতে ট্রিগার্ড হয় কাহিনীর টানে, অ্যাটাচড বা এনগেজড হয় ক্যারেক্টারের সম্মোহনে।
বাংলা এবং তেলুগু-তামিল ভাষার শত শত ফিল্ম দেখেছি। ড্রামা ক্যাটেগরিতে ইংরেজির জোগানও নগণ্য নয়। হিন্দি-জাপানিজ-চাইনিজ-স্প্যানিশ-ফ্রেঞ্চ-ইরানি-রাশিয়ান-জার্মান ভাষার অন্তত কয়েকটি ফিল্ম দেখতে সময় দিয়েছি। তাতে আপাত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি মেধাবি ফিল্মমেকার মাত্রই ক্যারেক্টার স্টাডি করে, স্টোরিটেলিং আবর্তিত হয় ক্যারেক্টারকে কেন্দ্র করেই।
ক্লারিটি কনটেক্সটে আমাদের ডিরেক্টরদের মেজরিটি অংশকে কেন অসৎ বলা উচিত, ‘ইনসাফ’ রেখে গেল তার পর্যাপ্ত উইটনেস।
— একসময় নাটক বা ফিল্মের ডায়লগ তৈরি করত পাবলিক পারসেপশন, কিছু ক্ষেত্রে লাভ করত বিপুল জনপ্রিয়তা। আমাদের শর্টকাটবৃত্তির প্যানডামিক ঘটে গেছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল কনটেন্টকে ফিল্মে ফিট করতে হচ্ছে দর্শকের তালির লোভে। ‘মুরুব্বি মুরুব্বি’-এর দ্বারস্থ হয়েছিল ‘তাণ্ডবে’ রায়হান রাফী, ‘ইনসাফে’ও বেইনসাফি হলো না। গুনে দেখলাম ‘ইনসাফে’ মুরুব্বি শব্দটা উচ্চারিত হয়েছে সর্বমোট ১৬ বার! ‘শাহীন নটীর পোলাকে ধরে ফেল’ ডায়লগের ভাইরালিটি কাজে লাগাতে মিশা সওদাগরের ক্যারেক্টারের নাম রাখা হয়েছে শাহীন, যে নিজেকে পরিচয় দেয় ‘সুশীল শাহীন, থাকি নিকেতন’, যদিও তাকে মোট তিনবার নটীর পোলা সম্বোধন করা হয়েছে। ‘ক্ষণিকের ছেলে’ গালিটাও সোশ্যাল মিডিয়া উদ্ভাবিত। আগ্রহবশত কেউ যদি ‘ডিআইজি মিজানের নারী কেলেংকারি’ লিখে গুগল সার্চ করেন, দেখবেন ২০১৮ সালে পুলিশের একজন ডিআইজি গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে ইস্যুতে ভাইরাল হন, এবং অবৈধ আয়ের মামলায় জেলেও যান। প্রায় প্রতিটি ফিল্মের শুরুতে ডিসক্লেইমার দেয়া থাকে সব চরিত্র কাল্পনিক, বাস্তবের কোনো ব্যক্তির সাথে মিল নেই, অথচ রিয়েল লাইফ ক্যারেক্টার তো নিলেনই, নামটুকুও বদলে দেয়ার আবশ্যকতা বোধ করলেন না!
— দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা ও হিন্দি সিনেমায় নায়ক মানেই মহামানবের অবতার। সে যদি আপাত অন্যায় কর্মকাণ্ড করত তার নেপথ্যেও থাকত মহতী উদ্দেশ্য। আমরা অনেকেই একঘেয়েমিতে ভুগতাম। সাহিত্যে প্রটাগনিস্টের চরিত্রে যত শেড থাকে ফিল্মে কেন ওয়ান ডিরেকশনাল; নায়ক কি অন্যায় করতে পারে না? তেলুগু-তামিলে তীব্র ম্যাসকুলিনিটি প্রাধান্য পায়, সেটাকে লঘু করতে পরতে পরতে থাকে কমেডি। ভয়ংকর খুনিও কমেডি করে। কোরিয়ান অ্যাকশন ফিল্মে ভায়োলেন্সের আধিপত্য থাকে। সর্বশেষ কয়েক বছরে বাংলা ফিল্মগুলো সব তেলুগু আর কোরিয়ানের ব্যর্থ আর অন্ধ অনুকরণ কেন হচ্ছে, প্রশ্নটা সিরিয়াসলি করা উচিত। নায়ক মানেই রক্তারক্তি, সেটা ভিডিও গেম স্টাইলে। ফিল্মকে শিক্ষামূলক হতে হবে বা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে হবে, এসব থিওরিকে গার্বেজ মনে করি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার চিন্তাও শিশুতোষ এবং দরিদ্র মানসিকতার। সিনেপ্লেক্সে যারা ফিল্ম দেখতে যায় তারা মূলত এন্টারটেইনমেন্ট খুঁজে, সময়টা সুন্দর কাটুক প্রত্যাশা রাখে। সিনেপ্লেক্সে প্রবেশকালীন ৭০ শতাংশ দর্শকের হাতে থাকে পপকর্ণ! তারা পপকর্ণ খেতে খেতে কোরিয়ান রক্তারক্তি দেখতে যায়, মনে হয় না আমার।
আমাদের ফিল্মমেকারদের উল্লেখযোগ্য অংশই ফিল্ম থেকে দূরে, এরাও ৯ট-৬টা চাকরি স্টাইলে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের চাকরি করে, ইউটিউবে ভিউ আর ফেসবুকে লাইক-কমেন্ট গুনে। কথিত প্রডিউসারদের ইন্টারেস্ট অবশ্য এখনো নিশ্চিত না। কালো টাকা সাদাকারণ, মানি লন্ডারিং, কিংবা শুক্রের অতি তাড়না— নানারকম ফ্যাক্টরই কাজ করতে পারে।
— ছোটবেলায় ফিল্ম দেখার সময় একটা ক্যাপশন পেতাম ‘অতিথি চরিত্র’, হিন্দিতে ‘স্পেশাল অ্যাপিয়ারেন্স’। পরিচিত বা জনপ্রিয় আর্টিস্ট কোনো ফিল্মে অল্প সময়ের জন্য স্ক্রিন প্রেজেন্স পেলে এই ট্যাগগুলো ব্যবহৃত হতো। স্বল্পসময়ের উপস্থিতি হলেও ওই ক্যারেক্টারগুলো গল্পের ইন্টেগ্রাল পার্ট, তারা না থাকলে গল্পটা অসম্পূর্ণ। শাহরুখ খান এবং সালমান খান একে অপরের বহু সিনেমায় এ ধরনের গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দিয়েছে ক্যারিয়ারের পিকে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘কুচকুচ হোতা হ্যায়’তে সালমানের ক্যারেক্টারটা। তাকে বাদ দিয়ে গল্পটা গন্তব্য পেত? কালক্রমে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্সের নাম বদলে হলে ‘ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্স’। এগুলো কখনো আগের মতোই ইন্টেগ্রাল পার্ট হয়, কখনোবা নিছকই ফেসভ্যালু ব্যবহার করে দর্শককে তাক লাগানোর শর্টকাট কৌশল। যেমন ‘জাওয়ানে’ দীপিকা পাডুকোনের চরিত্রটা গল্পের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল, একই ফিল্মে সঞ্জয় দত্তের প্রেজেন্সটা নিছকই ফেস ব্যবহার। ইদানিংকালের বাংলা ফিল্মেও ক্যামিও প্রেজেন্স সেই ফেস দেখানো চটকদার আইটেম হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। গল্পের সাথে কোনোরকম ইনভলভমেন্ট নেই, ‘তাণ্ডবে’ হাজির হয়ে গেল আফরান নিশো, ‘ইনসাফে’ চঞ্চল চৌধুরী। অচিরেই ক্যামিও ফাতরামি মুখ থুবড়ে পড়ার অনিবার্য সম্ভাবনা।
— তুফানের পরে কমার্শিয়াল ফিল্মগুলোতে নায়ক উচু জায়গায় দাঁড়িয়ে কমান্ড দিচ্ছে, অনুসারীরা শুনছে- দৃশ্যায়ন ট্রেন্ড হয়ে উঠছে। ফিল্ম নির্মাণ কালচারাল প্রোডাক্টের মধ্যে দুরূহতম কাজ। একটা ১০০ কর্মীর কোম্পানি চালানোর মতো কাজ। আমাদের ফিল্মমেকাররা এমন অথর্ব আর হোমওয়ার্কহীন কেন হয়ে পড়লো, তারও এক সোশিও পলিটিক্যাল অ্যানালিসিস হওয়া উচিত। করব কখনো, আজ থাকুক।
‘ইনসাফ’ আসলে কতটা ফিল্ম হতে পারলো, এর চাইতে কেন বলছি রাজের জন্য এটা একটা প্রিম্যাচিউর প্রোডাকশন, ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
বাবার প্রতি পজেসিভ তরুণ দেখলো সততার কারণে বাবা জুতার মালা পেল ভরা মজলিশে, সে প্রতিশোধ নিল, সে প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হলো কুখ্যাত মাফিয়ায়। প্রতিপক্ষরা বাবাকে খুন করলো, তার আগে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরিচ্যুত হলো। সে প্রভাব খাটিয়ে বাবার খুনের প্রতিশোধ নিতে পারত, রাষ্ট্রের চোখে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারত না। তাই সে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়, আইডেন্টিটি লুকিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে বিয়ে করে যার মাধ্যমে বাবার কেসটা রি-ওপেন করা যেতে পারে— সোশ্যাল ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে প্লট চলনসই। যদি রাজ একজন সুপারস্টার হতো, এই প্লটকে স্ক্রিনপ্লে তে রূপ দেয়ার সময় অ্যামেচারিতা পাল্টে যেত। ক্যারেক্টারের বিল্ডআপ হতো অর্গানাইজড, আর্ট ডিরেকশন এবং সিনেমাটোগ্রাফিতে আরো ক্যাপাবল মানুষ হায়ার করা হতো। শট ডিভিশনে আরো মুন্সিয়ানা দেখা যেত। সেসব কিচ্ছু নেই। শূন্য দশকের শুরুর দিকে কাজী হায়াৎ টিপিক্যাল এফডিসি প্রোডাক্ট ক্যাটেগরিতে নির্মাণ করেছিলেন ‘ইতিহাস’, আমি বলবো ‘ইনসাফ’ সেই লেভেলেরও ধারেকাছে পৌঁছুতে পারেনি।

নায়কের সাথে প্রায় সমান্তরাল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তাসনিয়া ফারিণকে কোন ভাবনা থেকে কাস্ট করা হয়েছে, জীবনে তিনটা ফিল্ম দেখা মানুষও বলে বসবে ‘বালের ডিরেক্টর’। অ্যাকশন দৃশ্যে মনে হয়েছে নয় বছরের শিশু বড়দের সাথে ঢিশুম ঢুশুম খেলছে, আসামীকে টর্চার দৃশ্যে মনে হচ্ছিল হাতের লাঠিটার ওজন ৪১ কেজি, উঁচু করতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। টাবু পুলিশের চরিত্রে বেশ কিছু ফিল্মে কাজ করেছে, শুধু তাকে দেখলেও এ ধরনের ক্যারেক্টারে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে কী ধরনের টাফনেস থাকে আইডিয়া নিতে পারত, নিদেনপক্ষে মিমি চক্রবর্তী। গানের দৃশ্যে মনে হচ্ছিল নায়কের সাথে আজই প্রথম দেখা হলো, এবং সর্বশেষ আইটেম সংয়ে যে নাচটা দেখা গেল- বডি মাসল এতখানি স্টিফ হলে সেটা আর যাই হোক ড্যান্স হয়ে উঠতে পারে না। ওদিকে কফি খেতে খেতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার দৃশ্যগুলোতে খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। এর ভিত্তিতে ইমপ্রেসন জন্মে— মেলোড্রামাটিক রোমান্টিক প্লটের ফিল্ম যেখানে নাচানাচি কম, সেখানে হয়তবা তাকে দিয়ে চলতে পারে, মাসালা ফিল্ম ডুবানোর জন্য সে একাই যথেষ্ট। বাংলাদেশে এ ক্যারেক্টারটা করার মতো সম্ভাব্য নায়িকা হতে পারত বিদ্যা সিনহা মিম, ‘পরাণে’ রাজের সাথে তার কেমিস্ট্রিও দারুণই ছিল। পরীমণির সাথে অতীত তিক্ততার কারণে মিমকে ভাবা হলো না, নাকি বাজেট ইস্যু— কে জানে! তবে ক্যারেক্টার সম্পর্কে ন্যূনতম স্টাডি থাকলে কোনো পরিচালক ফারিণকে কাস্টিং করত না, এটা কনফিডেন্টলি বলতে পারি।
তেলুগু অভিনেতা ব্রহ্মানন্দন সহস্রাধিক ফিল্মে অভিনয় করে গিনিজ বুকে নাম উঠিয়েছেন। বেশিরভাগ ফিল্মেই তিনি ক্যামিও ক্যারেক্টার হিসেবে কমেডি করে যান। মোশাররফ করিমকে বানাতে চাওয়া হলো গল্পের এক্স-ফ্যাক্টর, পরিচালকের অযোগ্যতায় সে চিত্রায়িত হলো কমেডিয়ান ব্রহ্মানন্দন রূপে! তার হাইট, গেশ্চারে ব্রহ্মানন্দনের সাথে মিলও পেলাম। বাংলাদেশে চঞ্চল চৌধুরীর মতো ভার্সেটাইল ক্যারেক্টার আর কোনো অভিনেতার ভাগ্যে জুটেনি। শেষ দৃশ্যে এই মিনিংলেস ক্যামিও প্রেজেন্স তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সামান্য ডিজিট বদলের বাইরে আরো কোনো ভ্যালু যুক্ত করলো? সে তো স্ট্রাগলিং আর্টিস্ট নয়, এভাবে নিজের ভ্যালুহানি করা, এখানেই আমাদের আর্টিস্টরা হেরে যায়। বলতে পারেন ‘ইনসাফের’ সিক্যুয়েল আসবে। ডাহা ফ্লপ ফিল্মের কিসের সিক্যুয়েল! ফেসভ্যালুকে এমন আলু-রসুন পর্যায়ে নামানো নিদারুণ গ্লানিকর!
তবে আড়াই ঘন্টা সময় পুরোপুরি অপচয় হয়নি। কিছু প্রাপ্তিযোগ আছে—
এক. হিউমার দৃশ্যে রাজের অভিনয় দেখার সুযোগ হলো। অনবদ্য। ‘আমি চা-কফি খাই না, লাঞ্চও করেছি’ ফারিনের সাথে এই সিকুয়েন্সটাই তার দক্ষতাকে দারুণভাবে পোরট্রে করেছে। কিংবা আপনাকে বিয়ে করার চাইতে স্বীকার করে নেব আমি ইউসুফ। আবার ফ্লার্টিং সিকুয়েন্সেও খুবই ন্যাচারাল মনে হয়েছে। রিমান্ডে চরম নির্যাতিত হয়ে রাগী অফিসারকে পোরট্রেট উপহার দিয়ে বলা আপনাকে শাড়িতে দারুণ মানাবে— এমন ক্লাসিকাল ফ্লার্টিং অন্য বাঙালি অভিনেতারা নষ্ট করে ফেলত। তবে পরিচালক তাকে ভীষণ আনাড়িভাবে ব্যবহার করেছে। টেনশন এবং অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে ম্যানারিজম দেখানোর একমাত্র টুলস চুরুটের ধোঁয়া ছাড়া।
দুই. আমাদের সামাজিক কাঠামো লেডি রকস্টার তৈরির পথে ভয়ংকর রকম প্রতিবন্ধক। শৈশবে পিলু মমতাজকে পছন্দ করতাম। ততদিনে সে গানে অনিয়মিত। একটু বড় হওয়ার পরে পেলাম কানিজ সুবর্ণাকে। তার গলাও হাইস্কেলে লাগেনি তেমন। বাংলাদেশের পরিপূর্ণ লেডি রকস্টার মনে করতাম মিলা ইসলামকে। এমন হাইস্কেলের গানে স্টেজ পারফর্ম করা অভাবনীয় এক স্কিল। উশৃংখলতায় পথচ্যুত হয়েছিল সেও। ‘ইনসাফ’ সূত্রে মিলার কামব্যাক পেলাম। তার ‘আকাশেতে লক্ষ তারা’ গানটা যখন স্ক্রিনে শুরু হয় দর্শক হল ছাড়তে শুরু করেছে, একমাত্র সেই সময়টাতেই আমার মনে হয়েছিল হলে আসাটা মিনিংফুল।
তিন. মিশা সওদাগর মনতাজুর রহমান আকবর বা এফ আই মানিকের ফিল্মগুলোতে যে ধাঁচে অ্যাক্টিং করত, এখনকার ফিল্মগুলোতে ভিলেন হিসেবে সে আসলে কোন মেথডে আগাবে, এ নিয়ে কনফিউজড মনে হলো। শিবলু মৃধা স্বল্প উপস্থিতিতে যে অরা দেখিয়েছে তাতে আগামীতে আরো বেশি স্ক্রিন টাইম ভিলেন হওয়াটা ডিজার্ভ করে।
রাজের স্ক্রিপ্ট বাছাইয়ে আরো যত্নশীল হতেই হবে। কারণ সে যদি সুপারস্টার হতে ব্যর্থ হয়, ক্ষতিগ্রস্ত সে একাই হবে না, শাকিবোত্তর ফিল্ম ব্যবসাতেও তার প্রভাব পড়বে। শুনেছি কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। টাকার অভাব পড়লে ওয়েব সিরিজ করুক, কিন্তু অ্যামেচার স্ক্রিপ্টে নো-কম্প্রোমাইজ!