ইন্ডাস্ট্রির ত্রাতা!
অশ্লীলতার কবলে এ দেশের সিনেমা ধ্বংসের বীজ বপন হয়। ধীরে ধীরে অশ্লীলতা বন্ধ হয়। কিন্তু ততদিনে দেশের ইন্ডাস্ট্রির বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। বড় একটি শ্রেণীর দর্শক হলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
মান্না মারা যান, ফিল্ম রাজনীতির কবলে পড়ে সুস্থ ধারার অভিনেতা রিয়াজ সিনেমা কমিয়ে দেন। এক সময় নিজেদের নামে হিট দেয়া শাবনূর–মৌসুমীও নিজেদের অসচেতনতায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকেন। তখন শাকিবের একার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তিনি ৮০% সিনেমা এক নায়িকার সাথে করা শুরু করলেন। যেগুলোর বেশিরভাগই নকল করা গল্পের দুর্বল মেকিং। ভালো সিনেমার অভাবে এবং শাকিবের স্টারডমে সেগুলো হিট হচ্ছিলো তবে বছর শেষে জ্যামিতিক হারে হল কমেছিল। তখন শাকিব বা এফডিসির কেউই ব্যাতিক্রমী কিছু করার কথা ভাবেননি। নিজেদের স্বার্থে কেবল সিনেমা করে গেছেন।
হৃদয়ের কথা, আকাশ ছোয়া ভালোবাসা, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, মেঘের কোলে রোদ, রানী কুঠির বাকি ইতিহাস, মনপুরাসহ কিছু ভালো সিনেমা নির্মিত হলেও সংখ্যায় পর্যাপ্ত ছিল না। ইমপ্রেস নিয়মিত ভালো কিছু সিনেমা নির্মাণ করে তবে সেগুলো প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি না দিয়ে মুক্তি দিচ্ছিলো তাদের চ্যানেলে। তখন অন্তত ভালো প্রযুক্তি ও নির্মাণের ঝকঝকে কিছু সিনেমা উপহার দেন। তবে সেগুলোতে তাদের দুজনের অভিনয় সমালোচিত হয়।
এই ইন্ডাস্ট্রি যখন এফডিসি আর রাজনীতির কারণে ধুঁকছিল তখন এগিয়ে আসছিল জাজ মাল্টিমিডিয়া! অথচ তাদের কথা অনেকেই এড়িয়ে যায়। তথাকথিত নায়ক-পরিচালকরা একের পর এক বস্তাপচা সিনেমা করে দিন দিন দর্শকদের হলবিমুখী করে আর কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা না করে ইন্ডাস্ট্রির কফিনে একের পর এক পেরেক মেরে দিচ্ছিলেন তখন ত্রাতা হিসেবে আসে জাজ ২০১২ সালে।
তাদের সবচেয়ে ভালো কাজ কী? ভালো কাজ হচ্ছে সিনেমাহল রক্ষা করা ও সিনেমার বাজেট কমানো। তখন ৩৫ মিমিতে দেশের সিনেমা মুক্তি পেত। ৩৫ মিলিমিটার সিনেমা চালানোর নিয়ম হচ্ছে রিলের মাধ্যমে চালানো। এক-একটি সিনেমার প্রতি প্রিন্টে খরচ পড়ত ৫০-৮০ হাজারের মতো। তাও লাল প্রিন্টের সিনেমা। অর্থাৎ আপনি যদি ৬০ হলে সিনেমা মুক্তি দেন কেবল সিনেমার রিলে খরচ পড়ত ৪০-৪৫ লাখ টাকা। তখন জাজ এগিয়ে এলো। এক সাথে অনেকগুলো সিনেমা ডিজিটাল করল। ডিজিটালে সিনেমা চালানো অনেকটাই পেনড্রাইভে করে এক পিসি থেকে আরেক পিসিতে সিনেমা নেয়ার মতো (উল্লেখ্য দেশের প্রথম ডিজিটাল সিনেমা তারেক মাসুদের ‘অন্তর্যাত্রা’)। হল ডিজিটাল হয়ে গেলে আর বেশি প্রিন্ট করাতে তেমন খরচ নেই অর্থাৎ এক লাফে সিনেমা নির্মাণ ব্যায় ৪০-৫০ লাখ টাকা কমে গেল।
অনন্তের সিনেমা ও লালটিপের পর তারাও রেড ক্যামেরা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ শুরু করে। যার ফলে তাদের সিনেমার প্রিন্টও দেখতে ভালো ছিল। তারা সিনেমার গান ও তার চিত্রায়ণেও নজর দিল। অন্যদিকে তাদের আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল অনলাইন প্রচারণা। অনলাইনে জাজের সিনেমাগুলো তুমুলভাবে প্রচারণা পেত। তারা প্রথম ফেইসবুক পেজ খুলে, ইউটিউব চ্যানেল খুলে সিনেমার প্রচারণা করত, ইউটিউব চ্যানেলে একই সাথে সিনেমার প্রচারণা, মুক্তির আগেই গান জনপ্রিয় হওয়া এবং ইউটিউব থেকে গান দিয়ে টাকা ইনকামের পথ খুলে গেল।
জাজ তখন যদি ব্যাপকহারে হল ডিজিটাল না করত ৩৫ মিমি চালাতে গিয়ে অনেক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যেত। তাদের ডিজিটালাইজেশনের ফলে দেশের সিনেমা এই দুর্দিনেও রেকর্ড পরিমাণ হলে মুক্তি দেয়া সম্ভব হলো। তারা বাপ্পীর মতো নায়ককে দিয়ে হিট সিনেমা দিয়েছে। একেবারে প্রথম সিনেমায় বাপ্পী-মাহির মতো নতুন দুজনকে নিয়ে হিট সিনেমা উপহার দিয়েছে তারা। তারা ৪-৫টা সিনেমা একেবারে নতুনদের নিয়ে বানিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর ‘ভালোবাসা আজকাল’-এ শাকিবকে নিয়েছে। তাদের সিনেমা তাদের জন্য হিট হতো নায়ক-নায়িকার জন্য না। মাহির মতো অল্প কয়েকটি সিনেমা করা নায়িকাকে কেন্দ্র করে তারা ‘অগ্নি’র মতো ব্লকবাস্টার উপহার দিয়েছে।
মজার ব্যাপার ২০০৮-১২ সালে বস্তাপচা যে সিনেমা গুলো মুক্তি পেত সেগুলোতে নায়কের উচ্চ বাজেট আর ৩৫ মিমিতে প্রিন্ট করাতে গিয়ে সিনেমায় সর্বমোট যে খরচ হতো তার চেয়ে কম খরচে তখনকার বিবেচনায় অগ্নির মত উন্নত মানের সিনেমা দিতে পেরেছে। একেবারে নতুন সাইমনকে দিয়ে ‘পোড়ামন’-এর মতো সুপার হিট উপহার দিয়েছে তারা। একেবারে নতুন নায়ক-নায়িকা পরিচালক দিয়ে ‘পোড়ামন ২’ এর মতো হিট সিনেমা দিতে পেরেছে তারা।
জাজের কর্ণধার আব্দুল আজিজ সাহেবের টাকার উৎস নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু যে কোন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি টিকতে কালো টাকা লাগেই। জাজ গত দুই যুগের মধ্যে একক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি নায়ক নায়িকা উপহার দিয়েছে। মাহি, বাপ্পী, সায়মন, সারাহ জেরিন, পূজা, সিয়াম, বিপাশা কবির, জোলি, ফারিন, নূসরাত ফারিয়া ও রোশান।
বাপ্পীর অভিনয় নিয়ে যত সমালোচনা করি কিন্তু তারা ২ লাখ টাকা পারিশ্রমিকের এই অভিনেতার সিনেমা ঈদে শাকিবের সিনেমার সাথে মুক্তি দিয়েছে এবং বাজেট বিবেচনায় ভালোও করেছে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনাও ছিল। নিজেদের হলে অন্যদের সিনেমা চলতে না দেয়া কিংবা সিনেপ্লেক্সে তাদের সিনেমা না চালানোয় হুমকি দেয়া।
শাকিব ভক্তরা কিছু হলে শিকারি-নবাবের কথা বলে। শিকারি-নবাবও তো জাজেরই ছবি। শিকারি নির্মাণের আগে জাজ যৌথ রোমিও জুলিয়েট কিংবা বাদশার (শিকারির সাথে একসাথে মুক্তি পায়, আজিজের বক্তব্য অনুযায়ী সে ঈদের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা) মতো হিট সিনেমা দিয়েছে।
শাকিবের লুক যাই কিছুটা চেঞ্জ হয়েছে তাতেও জাজের অবদান ছিল। উনার সাম্প্রতিককালে কিছু ভালোমানের সিনেমাগুলোও সম্ভব হতো না যদি জাজ হল ডিজিটালাইজ না করত কিংবা সিনেমা প্রযোজনা না করত! গত এক দশকে আমরা সবচেয়ে বেশি আর্ট ফিল্ম পেয়েছি এবং সেগুলো টিভিতে মুক্তি না পেয়ে সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে সেটাও হয়তো আজ সম্ভব হতো না। জাজের সিনেমার মাধ্যমে নতুন কিছু দর্শক হলমুখী হয়েছিল বলেই আয়নাবাজি, ঢাকা আ্যটাক, দেবীর মতো সিনেমা এত বেশি আলোচিত হয়েছে। নির্মাণের আগেই তাদের ‘মাসুদ রানা’র নাম মানুষের মুখে মুখে ছিল প্রচারণার স্ট্র্যাটেজির কারণে। তাদের সৌজন্যে ইরফান খানের মতো অভিনেতা বাংলা সিনেমা করেছে।
ইন্ডাস্ট্রি কারও একার জন্য কখনো টিকে না। তবুও কেউ যদি বড় রকমের ক্রেডিট পায় অবশ্যই জাজ পাবে, তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই দেশের ইন্ডাস্ট্রির ত্রাতা হিসেবে কাজ করেছে। তবুও যৌথ প্রযোজনার ভাইরাস এদেশে প্রবেশ করানোর জন্য তাদের প্রতি সবসময় আমার ক্ষোভ থাকবেই!