ইন্ডাস্ট্রি টিকলে তবেই না সুপারস্টার!
আমরা হলিউড, বলিউড, টালিউডের মতো গল্পের সিনেমা চাই। তাদের মতো নায়ক-নায়িকা চাই। আমাদের নায়ক-নায়িকাদের বেশিরভাগ ওইসব ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের মতোই নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি বা কথা শেয়ার করেন। কেউ কেউ তো ইন্সপায়ার্ড হয়ে কাছাকাছি রকমের পোষাক পরিধান করে ফটোশুটও করে ফেলেন। কিন্তু যে জায়গাটায় অন্য ইন্ডাস্ট্রির শিল্পীদের মতো হওয়া দরকার সেই জায়গাটাতেই পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে অবস্থান তাদের। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ঈদে মুক্তি পাওয়া দুই সিনেমা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও দুই তারকার ভক্তদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কার্যকলাপ।
ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমার মধ্যে নবীন নির্মাতা এম রাহিম পরিচালিত ’শান’ এবং এস এ হক অলিক পরিচালিত ‘গলুই’ ভালোই সাড়া পাচ্ছে। অনেক হলবিমুখ দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ফিরেছেন; যাদের বড় অংশ নারী দর্শক। কঠিন সময় পার করা ইন্ডাস্ট্রি যখন এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর একটা আশা বুকে বাঁধতে যাচ্ছে তখন দুই অভিনেতার ভক্তদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও বিদ্বেষমূলক কর্মকান্ডে অনেকেই আশাহত।
বলিউডে শাহরুখ, আমির, সালমান, হৃত্বিক, অক্ষয়ের মতো তারকারা একে অন্যের সিনেমা দেখার জন্য দর্শকদের আহ্বান জানান। নিজেরাও সেই সিনেমা দেখে ভালো বা মন্দ লাগা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের সাথে শেয়ার করেন। দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে প্রভাস, আল্লু অর্জুন, ইয়াশ, মহেশ বাবু, রামচরন বা জুনিয়র এনটিআর, থালাপতি বিজয়ের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখতে পাওয়া যায়। কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকালেও চিত্রটা একই। প্রসেনজিৎ, দেব, জিৎ, সোহম এমনকি অংকুশ, অনির্বাণ, পরমব্রত, আবির একে অন্যের সিনেমা দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যান; ভক্তদেরও উৎসাহ দেন। অথচ আমাদের চিত্রটা খুবই বাজে এবং নেগেটিভ দিকে চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তবে এক্ষেত্রে একটি ঘটনা শেয়ার করতে যাচ্ছি। রাফসান সাবাবের জনপ্রিয় শো ‘হোয়াট আ শো’-এর একটি এপিসোডে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘শান’ সিনেমার সিয়াম আহমেদ এবং পূজা চেরি। তখন সারাদেশে চলছিল আরিফিন শুভর ‘মিশন এক্সট্রিম’। ওই প্রোগ্রামে অডিয়েন্সের উদ্দেশ্যে সিয়াম প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল, ‘মিশন এক্সট্রিম মুক্তি পেয়েছে, কে কে দেখেছেন? দেখতে হবে তো, আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে যেন দাঁড়ায় সেজন্য দেশের সব মানসম্মত সিনেমাই আমাদের দেখতে হবে প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে।’ একজন অভিনেতা তার সবচেয়ে বড় কম্পিটিশন যে ব্যক্তি তার সিনেমা দেখার জন্য নিজের ভক্ত এবং দর্শকদের আহ্বান জানাচ্ছেন এটা কি তার শিল্পীসত্তার প্রমাণ দেয় না!! উত্তর হলো দেয়। এমনকি বিভিন্ন ইন্টারভিউতে সিয়াম আহমেদ বরাবরই বলে এসেছেন শাকিব খান দেশের একমাত্র সুপারস্টার। তার সাথে প্রতিযোগিতার প্রশ্নই আসে না। শাকিবের সিনেমা দেখে যেন অন্য সবার সিনেমা দেখে সবাই। আজ এমন মনোভাব বহন করা একজন অভিনেতা এবং তার সিনেমাকে নিয়ে যে ধরনের বাজে পলিটিক্স হচ্ছে সেটা আসলেই দুঃখজনক। আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, বিদেশের একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে শাকিব খান ‘মিশন এক্সট্রিম’ দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন দর্শকদের।
একজনের ভক্ত হওয়াটা দোষের কিছু নয়। এবং যার ভক্ত তার কাজ নিয়ে উৎসাহী থাকাটাও দোষের কিছু নয়। তবে নিজের পছন্দের তারকাকে বড় করতে গিয়ে অন্য আরেকজন এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সবার কাজটি নিয়ে মিথ্যাচার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। আপনার বা আমার-আমাদের পছন্দের বাইরের কারো কাজ দেখার ইচ্ছা নাই ভালো কথা, আমরা দেখবো না কিন্তু তাই বলে সেটা কিছুই হয় নাই, অমুক অভিনেতা অভিনয়ের অও জানে না। গল্প নকল (যদিও প্রমাণ করতে পারেনাই কেউ), অ্যাকশন ভালো হয়নি (যেখানে শান সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য বাংলাদেশের সিনেমার মান অনুযায়ী উচ্চমানের সেটা সামান্য জ্ঞান রাখেন তেমন সকলেই স্বীকার করবেন)-সহ অনেক বাজে মন্তব্য করছেন অবলীলায়। অথচ ভেবে দেখছেন না নিজের প্রিয় তারকার সাথে একই সময়ে মাত্র সেদিন ইন্ডাস্ট্রিতে আসা একজন নবীন অভিনেতার ভালো সিনেমাটিকে ভালো বললে আদতে লাভ পুরো ইন্ডাস্ট্রির। কারণ সবার আগে এই ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি টিকে গেলে তবেই না সুপারস্টার, তবেই না নতুন সিনেমা…। আর একজন তারকা বছরে কয়টা সিনেমাই করতে পারবেন! একজন তারকা হোক সে সুপারস্টার একা একটা ইন্ডাস্ট্রি টেনে নিয়ে যেতে পারে না। সেটা উচিতও নয়।
একটা সময় রাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, জসিম, ফারুক, ওয়াসিম, বুলবুল আহমেদ একসাথে কাজ করেছেন এই ইন্ডাস্ট্রিতেই। একের পর এক ব্যবসা সফল এবং নান্দনিক সিনেমা উপহার দিয়েছেন তারা। পরবর্তীতে ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, রুবেল, সালমান শাহ, ওমর সানী, আমিন খানদের সময়েও একাধিক সুপারস্টার নায়ক কাজ করেছেন নিজ নিজ যোগ্যতা দিয়ে। এরপর রিয়াজ, ফেরদৌস এবং শাকিব খান। আরিফিন শুভ ক্যারিয়ারও প্রায় এক দশকের। কিন্তু এরপর কে? নতুনদের মাঝে এই সময়ে সবচেয়ে আশা জাগানিয়া লাইনআপ সিয়াম আহমেদের। তাই তার সিনেমাগুলো ব্যবসা সফল হলে আসল লাভ কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির।
ইন্ডাস্ট্রির ভালোর জন্য এই রেষারেষি এবং বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ হওয়া দরকার অবিলম্বে। ‘গলুই’ এবং ‘শান’ দুটোই মানসম্মত সিনেমা। দুটি সিনেমা দুই ঘরানার। একটি গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে প্রেম কাহিনী অন্যটি মানবপাচারের মতো ইস্যু নিয়ে অ্যাকশন ঘরানার। তাই দুই ধরনের বিনোদনের স্বাদ দিচ্ছে দুটি সিনেমা। কনটেন্ট আলাদা হবার কারণে দর্শকও আলাদা। তাই সুস্থধারার বাণিজ্যিক সিনেমা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর যে স্বপ্ন আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত মানুষগুলো দেখছে তাদের সবার উচিত দুটি সিনেমাই প্রেক্ষাগৃহে দেখা এবং অন্যদেরও দেখার জন্য আমন্ত্রন জানানো। এ নাজুক সময়ে নিজ দেশের নিজ সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সুদিন ফেরাতে অহেতুক এমন হানাহানি বন্ধ হোক এটাই কাম্য।