উজ্জ্বল যে কারণে মেগাস্টার
উজ্জ্বল হলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ‘মেগাস্টার’। দেশি শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে বা চর্চা করতে গেলে তার সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে, কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ৭০ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত উজ্জ্বলের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। অভিনেতা থেকে প্রযোজক ও পরিচালক তিনভাবেই তার অবদান রয়েছে।
আজকের সিনেমা দর্শকরা তামিলের রজনীকান্তকে দেখে বিস্মিত হয়। অথচ আমার কিশোরবেলায় এই রজনীকান্তের চেয়ে উজ্জ্বলকে বেশি ভালো লাগতো। একসময় আমরা যে শান্তশিষ্ট, রোমান্টিক সব চলচ্চিত্রে উজ্জ্বলকে চিনতাম সেই উজ্জ্বল ৮০-র দশকে হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সাদাকালো সিনেমার যুগের উজ্জ্বল আর ৮০-৯০ দশকের রঙ্গিন চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলকে দেখলে কেউই মেলাতে পারবে না।
আমি নিজেও একসময় মনে করতাম বুলবুল আহমেদ ও উজ্জ্বল হলো আপন দুই ভাই, যারা কখনও সিনেমায় মারপিট করতে জানে না ও পারবেও না। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে সেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন পর্দা কাঁপানো ডেয়ারিং/ দুর্ধর্ষ নায়ক যাকে দেখলে ভিসিআরে বম্বের রজনীকান্তের সিনেমা দেখা লাগে না। ৮০-র দশকে মাঝামাঝি সময়ে সিনেমা হলে উজ্জ্বলের সিনেমা মুক্তি পেলেই দর্শকরা বলতো ‘গরম ছবি আইছে’ … অর্থাৎ বিশাল বাজেটে নির্মিত মারমার কাটকাট উজ্জ্বলের সিনেমা হলে আসছে যা দেখতে গেলে হলের ভেতর বা বাহিরে কোন না কোন গন্ডগোল বাঁধবেই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে উজ্জ্বলকে কেন ‘মেগাস্টার’ বলা হয় সেটা আজো অনেকের কাছে পরিস্কার না বা বোধগম্য নয়। সংক্ষেপে সেই প্রশ্নের উত্তরটা দেয়ার চেষ্টা করছি।
১৯৪৬ সালের ২৮ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে জন্ম নেয়া উজ্জ্বল ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএ পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে মঞ্চ নাটক করতেন এবং ১৯৬৭–১৯৭০ সাল পর্যন্ত টেলিভিশনের নাটকেও অভিনয় করতেন। নাটক দেখেই ১৯৭০ সালে সুভাষ দত্ত উজ্জ্বলকে ‘বিনিময়’ চলচ্চিত্রে কবরীর বিপরীতে প্রস্তাব দেন।
কবরী থেকে শুরু করে অঞ্জু ঘোষ পর্যন্ত সে সময় যারা নায়িকা ছিলেন তাদের সবার বিপরীতেই তিনি অভিনয় করেছিলেন। ‘বিনিময়’ কাজ করার জন্য উজ্জ্বলকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে যেতে হয়। সেখানে কবরীর সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। ছবিটি উজ্জ্বলকে অসম্ভব খ্যাতি দিয়েছিল। ছবিতে কবরী ছিলেন বোবা। উজ্জ্বল ভাবতো, লজ্জায় বুঝি মেয়েটি কথা বলছে না। রূপালি পর্দায় উজ্জ্বল ও কবরীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের পরে উজ্জ্বল জানতে পারে কবরী বোবা। তারপর শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এরকম দ্বন্দ্বময় ও জটিল চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকের মনে ভীষণভাবে দাগ কাটেন।
অভিনয় জীবনে দ্বিতীয় নায়িকা হলেন নাসিমা খান। সিনেমাটি ছিলো মোহসীন পরিচালিত ‘মেঘের পরে মেঘ’। ১৯৭০ সালে এই ছবির শুটিংয়ে অংশ নেয়ার জন্য তাকে পাকিস্তানের মারীতে যেতে হয়। পাহাড় ও বরফের মধ্যে শুটিংয়ের দিনগুলো নাকি এখনও উজ্জ্বলকে পুলকিত করে। এ সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, লাহোরের কেএম স্টুডিওতে নাসিমা খানের সঙ্গে দেখা-পরিচয়। ‘মেঘের পরে মেঘ’ ছবির প্রযোজক নাসিমা খান নিজেই ছিলেন। তিনি তখন নায়িকা হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে। একই সঙ্গে উনার ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে ইমেজ ছিল। সেক্স সিম্বলকে সেদিন বাস্তবে দেখে তা মনে হয়নি। মনে হয়েছিল রুচিশীল পরিমার্জিত।
এরপর অভিনয় করেন ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘ইয়ে করে বিয়ে’, ‘স্বীকৃতি’, ‘অনুভব’, ‘বলাকা মন’, ‘সমাধান’, ‘দুটি মন দুটি আশা’, ‘অপরাধ’, ‘অপবাদ’, ‘বেদীন’, ‘অনুরাগ’, ‘মহেশখালীর বাঁকে’, ‘বন্ধু’, ‘সমাধি’, ‘রূপালি সৈকতে’, ‘লাল কাজল’, ‘অচেনা অতিথি’, ‘দাবি’, ‘দোস্তি’সহ দারুণ সব ক্লাসিক চলচ্চিত্রে।
ববিতার বিপরীতে তিনি প্রথম ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’তে প্রথম অভিনয় করেন। ছবিটি ১৯৭২ সালে মুক্তি পায়। পরবর্তী সময়ে শনিবারের চিঠি, অপরাধ, অপবাদসহ আরও কয়েকটি ছবিতে উজ্জ্বল ও ববিতা রোমান্টিক দৃশ্যে অংশ নেন। ওই সময় তাদের জড়িয়ে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন মুখরোচক সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, যা সত্যি কি মিথ্যা এ ব্যাপারে দীর্ঘ ৩৫ বছর পরেও উজ্জ্বল মুখ খুলতে নারাজ। তবে সেদিনের দর্শকরা আজও উজ্জ্বল ও ববিতার রোমান্সের কথা ভুলে যাননি।
যে উজ্জ্বলকে দর্শক প্রায় নিয়মিত মিষ্টি রোমান্টিক ও পারিবারিক গল্পের অভিনয়ে দেখতে অভ্যস্ত সেই উজ্জ্বল যেন ৮০-র দশকের শুরুতেই সম্পূর্ণ বদলে যান। মমতাজ আলী পরিচালিত ও উজ্জ্বল প্রযোজিত ‘নসীব’, ‘নালিশ’, ‘নিয়ত’ ‘ঈমান’সহ টানা ৪টি চলচ্চিত্রে আগের উজ্জ্বলকে দর্শকরা দেখে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে ও ‘ড্যাশিং’, ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ চরিত্রে। নতুন উজ্জ্বলের টানা তিনটি চলচ্চিত্র ছিল মেগাহিট। এরপর থেকেই উজ্জ্বল মানেই বিশাল বাজেটের সিনেমা, উজ্জ্বল মানেই মেগাহিট চলচ্চিত্র এমন একটা ধারণা প্রযোজক, পরিচালক, প্রদর্শক ও দর্শকদের মনে জন্ম নেয়। একে একে মুক্তি পায় ‘আমির ফকির’, ‘কুদরত’, ‘চোর ডাকাত পুলিশ’, ‘আমিই ওস্তাদ’, ‘উসিলা’র মতো দারুণ সফল সব চলচ্চিত্র। উজ্জ্বল নিজেকে রোমান্টিক, সামাজিক ও অ্যাকশন সব ধারার চলচ্চিত্রে নিজেকে প্রমাণ করেন ।
এই সফলতা ও দর্শকদের ক্রেজ দেখে সাপ্তাহিক চিত্রালির সম্পাদক ও চলচ্চিত্রকার আহমেদ জামান চৌধুরী ‘মেগাস্টার উজ্জ্বল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এবং যেখানে আহমেদ জামান চৌধুরী উজ্জ্বলকে ‘মেগাস্টার’ উপাধি দেন যেমনটা তিনি এর আগে রাজ্জাক, সোহেলরানা, ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো তারকাদের ক্ষেত্রে দিয়েছিলেন। সেই থেকে উজ্জ্বল হয়ে ‘মেগাস্টার’ আর মেগাহিট ব্যবসার নিশ্চয়তা দেয়া তারকা।
যে সময়ে আলমগীর, জসিম, কাঞ্চন, সোহেল রানারা যখন পর্দা কাঁপাচ্ছেন সেই একই সময়ে উজ্জ্বল ছিলেন একাই একশো। উজ্জ্বলের চলচ্চিত্রের সাথে যে নায়কের চলচ্চিত্র মুক্তি পাক না কেন উজ্জ্বলের সিনেমা ব্যবসা করবেই এটা ছিল নিশ্চিত। অর্থাৎ উজ্জ্বলের সাথে কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হতো না। তার চলচ্চিত্রের উপর অন্য কারো চলচ্চিত্রের প্রভাব পড়তো না।
৮০-র দশকের শেষ দিকে উসিলা, কারণ, বিশাল চলচ্চিত্রগুলো মেগাস্টার উজ্জ্বলের শেষ সোনালি স্বাক্ষর বহন করে, এর পরে তিনি অভিনয়ে অনিয়মিত হয়ে যান। এখনও আমার চোখে ভাসে উজ্জ্বলের ‘উসিলা’ সিনেমা দেখতে টিকিট কালোবাজারিদের সাথে দর্শকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাটা। উজ্জ্বলের চলচ্চিত্র সিনেমা হলে আসলেই দর্শকরা বলতো ‘গরম ছবি আইছে’ অর্থাৎ দর্শকদের টিকেট পেতে খুব বেগ হবে যা নিয়ে কোন না কোন বিশৃঙ্খলা লাগবেই।
উজ্জ্বলের অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো ‘বিনিময়’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ , ‘ইয়ে করে বিয়ে’ , ‘স্বীকৃতি’, ‘অনুভব’, ‘বলাকা মন’, ‘সমাধান’, ‘দুটি মন দুটি আশা’, ‘অপরাধ’, ‘অপবাদ’, ‘বেদ্বীন’, ‘অনুরাগ’, ‘মহেশখালীর বাঁকে’, ‘বন্ধু’, ‘সমাধি’, ‘রূপালি সৈকতে’, ‘লাল কাজল’, ‘অচেনা অতিথি’, ‘দাবি’, ‘দোস্তি’, ‘আমির ফকির’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘কুদরত’, ‘ঈমান’, ‘নসীব’, ‘নালিশ’, ‘নিয়ত’, ‘নিয়তি’, ‘আমিই ওস্তাদ’, ‘চোর ডাকাত পুলিশ’, ‘উসিলা’, ‘বিশাল’, ‘কারণ’, ‘শক্তিপরীক্ষা’, ‘সতর্ক শয়তান’, ‘পাপের শাস্তি’ ও ‘তীব্র প্রতিবাদ’।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাংস্কৃতিক গ্রুপে বা উইংয়ে যে সকল গুণী মানুষজন এখনও জীবিত আছেন তাদের মধ্য ‘উজ্জ্বল’ নামটি শীর্ষে থাকা তালিকাগুলোর এক নাম। জাসাসের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি তিনি।