Select Page

উৎসব: ছোট জীবনের নিঃশব্দ কার্নিভাল

উৎসব: ছোট জীবনের নিঃশব্দ কার্নিভাল

জীবনটা মাঝে মাঝে এমন এক মঞ্চ হয়ে দাড়ায়, যেখানে উৎসবও কাঁদায়, আনন্দও গলার ভেতর দলা পাকিয়ে বসে। একেকটা স্মৃতি আসে, হাসায় আবার ঠিক পরের মুহূর্তেই বুকটা ভারী করে দেয়। আর ঠিক এমন এক অনুভব থেকে বেরিয়ে আসে তানিম নূরের ‘উৎসব’। যে সিনেমাটা দেখতে দেখতে বুঝলাম, কিছু সিনেমা শুধু দেখা হয় না; পাশাপাশি অনুভব করা যায়।

‘উৎসব’ আদতে চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত ‘A Christmas Carol’ অবলম্বনে তৈরি। কিন্তু গল্পটা আর ইংল্যান্ডে আটকে নেই। পরিচালক সেটাকে নিয়ে এসেছেন মোহাম্মদপুরের শান্তি নীড়ে, চাঁদরাতের ব্যস্ত গলিতে। আর চাঁদরাত মানেই তো মোবারকের সেই চেনা গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। কিন্তু এবারের রাতটা একটু অন্যরকম, কারণ গান শেষ হওয়ার আগেই মোবারক বিদায় নেন, আর আমরা ঢুকে পড়ি এক অদ্ভুত গল্পে।

এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র জাহাঙ্গীর (জাহিদ হাসান)। একটা কমিউনিটি সেন্টার চালান, কিন্তু বোনাস দিতে কৃপণতা করেন, ছুটি দিতে মুখ কালো হয়। এলাকার ব্যান্ডের রিহার্সাল সহ্য হয় না, বিড়ালের দৌড়াদৌড়িও তাঁর অসহ্য! এটাই কি তাঁকে খারাপ মানুষ বানায়? ঠিক জানি না, তবে এতেই এলাকার লোকজন তাঁর নাম রেখেছে ‘খাইষ্টা জাহাঙ্গীর’।

জাহাঙ্গীর খারাপ না, সে কেবল সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এক মানুষ। যার ভেতরে হয়তো ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে।

গল্প মোড় নেয় যখন মোবারকের আত্মা আসে সতর্ক করতে। এরপর একে একে হাজির হয় তিনটি অতিপ্রাকৃত চরিত্র, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান ও অপি করিম। ভূতেরা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে যায় অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সফরে। দেখিয়ে দেয়, মানুষ আসলে কবে ভাঙে, কবে থেমে যায়, আর কোথা থেকে বদলটা শুরু হতে পারত।

তরুণ জাহাঙ্গীর আর জেসমিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌম্য জ্যোতি ও সাদিয়া আয়মান। ওদের ভালোবাসা একদম নিঃশব্দ, না আছে লাইলি-মজনু মার্কা ডায়লগ; না কোনো হঠাৎ নাটকীয়তা। এটা এমন এক প্রেম, যা হয়তো খুব সাধারণ কিন্তু ঠিক সেই কারণেই খুব কাছের লাগে।

আর বড় বয়সে আফসানা মিমির চোখে একটা অসমাপ্ত প্রেমের প্রতিধ্বনি লেগে থাকে, যা দেখে মনে হয় হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো শুধু স্মৃতিতে না, চোখের পাতার নীচেও থেকে যায়।

জাহিদ হাসান নিজের স্বভাবজাত অভিনয়ে আবারও প্রমাণ করলেন, তিনি শুধু বড় অভিনেতাই না বরং গভীর চরিত্রে ডুবে যেতে জানেন। তার ভেতরের অভিমান, গর্ব, রাগ আর অব্যক্ত ভালোবাসা; সবকিছুই খুব সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

চঞ্চল-জয়া-অপি ; তিন ভূতই আলাদা স্বাদ এনেছেন গল্পে। আর সুনেরাহর চরিত্রটা ছোট হলেও চোখে লেগে থাকে, বিশেষ করে যখন বলে, ‘এক কাপ কফির দাম তিনশ পঞ্চাশ টাকা, আপনারা পাইছেনটা কী?’

না, এটা কোনো আইটেম সং-ভরা, অ্যাকশন-প্যাকড ছবি নয়। এখানে গল্পটা ধীরে চলে, কিন্তু একবার ঢুকে গেলে আর বের হওয়া যায় না। এমন এক গতি, যেন পুরোনো চিঠি পড়ার মতো; যা পড়তে পড়তে হঠাৎ চোখ ভিজে যায়।

সিনেমার শেষদিকে জাহাঙ্গীরের মুখে যে প্রশান্তির হাসি দেখি সেটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় অপু ট্রিলজির একটা মুহূর্ত, যেখানে মুখের অভিব্যক্তিই হয় গল্পের শেষ সংলাপ।

শেষদিকে মনে হচ্ছিল, এটা কোনো অস্কারজয়ী সিনেমা নয়, না-ই বা এটা ‘টপ টেন অব দ্য ডিকেড’। কিন্তু এটা এমন এক সিনেমা, যা আত্মার গায়ে হালকা করে হাত রাখে। আর সেটাই তো আসল সিনেমা।

‘উৎসব’ সিনেমা একটা সময়ের গল্প, একটা মন বদলানোর গল্প, একটা মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার গল্প।
পরিচালক তানিম নূরের প্রতি আলাদা করে কৃতজ্ঞতা, কারণ তিনি দেখিয়েছেন; সাদামাটা জীবন থেকেও কীভাবে এক নিখুঁত গল্প বের করে আনা যায়।


About The Author

Leave a reply