Select Page

সিনেমা হলে বসন্তের হাওয়া

সিনেমা হলে বসন্তের হাওয়া

বসন্তকালে বলতে না পারলেও বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুনধারার গল্প বললো ‘হাওয়া’…

মুক্তির আগেই একটা ভয় ছিলো মেজবাউর রহমান সুমনের অকল্পনীয় হাইপ উঠা ‘হাওয়া’ নিয়ে। কারণ আমাদের যে জিনিস বা যার কাছে প্রত্যাশা বেশি সেখানে পান থেকে চুন খসলেই আমাদের মনে হয় আমরা বুঝি খুব ঠকা ঠকলাম! সাথে মন খারাপ হয়, রাগ লাগে… এই কালের রূপকথা ‘হাওয়া’ নিয়ে তাই একটা শংকা তো ছিলোই যে এই সিনেমার অল্প দোষ বা ভুল অনেক বড় হয়ে ধরা দেয় কিনা!

সাধারণ একজন দর্শক হিসেবে ‘হাওয়া’ দেখার পর আমার মনে হয়েছে যে, প্রথম সিনেমা হিসেবে মেজবাউর রহমান সুমন এবং তার টিম পান থেকে চুন খসতে দেননি। বরং পান খাওয়ার নানা উপকরণের মতো এই সিনেমার বিজিএম, সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং, সাউন্ড যেনো সোনায় সোহাগা। শুরু থেকে শেষ প্রতিটা ফ্রেমিং বিশেষ করে সাগরে ভেসে চলা ট্রলার, ট্রলারের মানুষজন, দিনের বেলা এবং রাতে বদলে যাওয়া সুমদ্র, আলো-ছায়া সব মিলিয়ে এই সিনেমা একটা আর্টওয়ার্ক হিসেবেই ধরা দিয়েছে।

‘হাওয়া’য় প্রেম আছে, আছে কমিক রিলিফ, আছে ড্রামা, সাসপেন্স, আছে রহস্য একইসাথে প্রতিশোধপরায়ণা এক নারী সবমিলিয়ে নির্দিস্ট কোনো ঘরানার সিনেমা এটা নয়। তাই বলে জগাখিচুরিও হয় নাই। এ কালের রূপকথা ‘হাওয়া’র সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট যদি মেজবাউর রহমান সুমনের পরিচালনা, কামরুল হাসান খসরুর অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, রাশিদ শরীফ শোয়েবের মনে প্রশান্তি এনে দেয়া ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, কস্টিউম ডিজাইনারদের চরিত্রের সাথে মানানসই কস্টিউমসহ টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট হয় তাহলে এরপরের প্লাস পয়েন্ট প্রতিটি অভিনয়শিল্পীর অসাধারণ সুন্দর চরিত্রায়ন।

একজন বা দুইজন শিল্পীর উপর নির্ভর না করে প্রতিটি চরিত্রই আমাদের মন এবং মস্তিকে জায়গা করে নেয় যা প্রশংসার দাবীদার। চাঁন মাঝি, ইব্রা, নাগু, উরকেস, পারকাস, এজা বা গুলতি তাদের বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় দিয়ে মনে জায়গা করে নেয় খুব সহজেই এবং এই জায়গা করে নেয়াটা সিনেমা শেষ করে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়ে আসার পরেও আমাদের মাঝে ভালোলাগা হিসেবে রয়ে যায়।

‘হাওয়া’ সিনেমার গল্প যে খুব আহামরি তা নয়। সোজাভাবে বলতে বা লিখতে গেলে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া একটি ট্রলারের একদল জেলের গল্প। আটজন পুরুষের মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারে একদিন জালে জড়িয়ে উঠে আসে এক নারী। তারপর ঘটতে শুরু করে বেশকিছু আজব ঘটনা। যেসব ঘটনার মাঝে নানা উত্থান পতন ঘটে।

‘হাওয়া’ প্রথম ভাগে ক্যারেক্টর বিল্ডআপ বা মূল গল্পে ঢোকার প্রস্তুতি হিসেবে কিছু স্লো বা এভারেজ মনে হলেও দ্বিতীয় ভাগ বা বিরতির পর ঘোড়ায় সওয়ার হবার মতো অবস্থা। দ্বিতীয় ভাগ দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে নানা চমক, সাসপেন্স, রহস্য আর সুনিপুণ অভিনয়ের দ্বারা। সিনেমার ক্ল্যাইমাক্স এবং সমাপ্তি আমাদের জন্য অদ্ভুত ভালোলাগা রেখে যায় বলে ‘হাওয়া’ স্রোতের বিপরীতে যেয়ে এক অন্যরকম সিনেমাটিক তৃপ্তি এনে দেয়।

তবে ভালো লাগার মতো আরেকটি বিষয় হলো এই সিনেমায় ক্যামেরার সামনে না থেকেও নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’র গল্পের প্রতিটি দৃশ্যে, প্রতিটি শটে এবং প্রতিটা বাঁকে পরোক্ষ উপস্থিতি। বাংলাদেশে এর আগে আর কোনো সিনেমায় এমন অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, বিজিএম, কালারগ্রেডিং হয়েছে কিনা আমার জানা নাই।  প্রথম সিনেমা হিসেবে মেজবাউর রহমান সুমন চলচ্চিত্র ইতিহাসে নিজের স্বতন্ত্র জায়গা গড়ে নিয়েছেন এই ‘হাওয়া’ দিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

অভিনয়ের দিক থেকে বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি স্ক্রিন টাইম পাওয়া চঞ্চল চৌধুরী বরাবরের মতো এবারো নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে গেলেন। চাঁন মাঝি হিসেবে এই চরিত্রটি চঞ্চল চৌধুরী ছাড়া অন্য কেউ করতে পারতো বলে মনে হয় না। দুর্দান্ত অভিনয় করলেন তিনি এই সিনেমায়। নাসির উদ্দিন খান একটি রত্ন। ওটিটি হোক বা চলচ্চিত্র এই মানুষটি প্রতিটা চরিত্রে এমনভাবে ঢুকে যান যা আসলেই চমকপ্রদ। নাগু চরিত্রটি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। বেদেনী মেয়ে গুলতি চরিত্রে নাজিফা তুষি অসাধারণ। তার সৌন্দর্য্য, গ্ল্যামার এবং অভিনয় সব মিলিয়ে তিনি এক কথায় অনবদ্য।

শরিফুল রাজ যতোটা সময় স্ক্রিনে ছিলেন আমরা ইব্রাকেই দেখেছি রাজকে নয়। একজন অভিনেতা হিসেবে রাজ যে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য উচ্চতায় তার প্রমাণ এই ‘হাওয়া’। সুমন আনোয়ার অভিনেতা হিসেবেও যে অনবদ্য তা আরো একবার প্রমান করলেন ‘হাওয়া’র এজা চরিত্র দিয়ে। চাঁন মাঝির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এজা হিসেবে তিনি সেলুলয়েডে ছিলেন অসাধারণত্ব নিয়েই। তবে একটু খারাপ লাগা দক্ষ অভিনেতা সোহেল মণ্ডলের উরকেস চরিত্রটি নিয়ে। সোহেল উরকেস হিসেবে খারাপ করেছেন ব্যাপারটা তা নয় তবে তার চরিত্রটি নিয়ে আসলে তেমন ভাবে ভিন্নধর্মী কিছু করার ছিলো না। তবে উরকেস হিসেবে সোহেল মন্ডল এবং পারকেস হিসেবে রিজু সিনেমার অন্যতম প্রাণ তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

‘হাওয়া’ দেখার সময় গহীন সমুদ্রের বিশাল জলরাশিতে আমাদের হারিয়ে যেতে হয়। চমকে ভরা প্রতিটা বাঁক আমাদের এরপরে গল্পে কী হয়! কীভাবে হয়! তা জানার জন্য আগ্রহী করে। যা সিনেমার শেষ দৃশ্য পর্যন্ত আমাদের স্ক্রিনে আটকে রাখে। প্রতিটি বিনোদনপ্রেমী বিশেষ করে যারা আমাদের দেশের সিনেমার মান নিয়ে অনেক সময়ই হতাশা ব্যক্ত করেন তাদের অবশ্যই ‘হাওয়া’ প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে দেখা উচিত। এই সিনেমা হলের পর্দায় দেখাটাই আমাদের জন্য এক বিশাল ট্রিট।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন