Select Page

উৎসর্গ হুমায়ূন ফরীদি

উৎসর্গ হুমায়ূন ফরীদি

মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়
অতীতের থেকে উঠে এসে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে
-মানুষের মৃত্যু হলে,জীবনানন্দ দাশ

কবি যা বলছেন তাতে একথা পরিষ্কার মৃত্যু সব মানুষের জীবনে এলেও কারো কারো জীবন এতটাই মহিমান্বিত হয়ে ওঠে যে মৃত্যু তাকে শুধু কেড়ে নিতে পারে যেখানে চোখের দেখাটা আর থাকে না কিন্তু মনের দেখাটা থাকে চিরদিন। একজন হুমায়ুন ফরীদি, কোথ্থেকে শুরু করব তাঁকে নিয়ে? ফরীদিকে নিয়ে বলতে গেলে কীভাবেই বা শুরু করতে হয় বোঝা মুশকিল। তারপরও শুরু করলাম নিজের মত করেই। খালি চোখে সামনাসামনি আমরা আর দেখতে পাই না প্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদিকে। তিনি অসাধারণ,অপূর্ব। বিশ্বমানের অভিনেতা। তাঁকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব। আমরা কী হারিয়েছি তা টের পাই তাঁর মৃত্যুর পরেই। অবশ্য আমাদের দেশে এমনটা নতুনও নয়। আমরা আগে হারাই তারপর আফসোস করি এটাই আমাদের চিরদিনের অভ্যাস।

যা বলছিলাম, একজন হুমায়ুন ফরীদিকে শুরু করা যায় কীভাবে। নাটক থেকেই শুরু করাটা ভালো। তিনিও যে কোনো সাক্ষাৎকার শুরুর আগে দেখতাম নাটক দিয়েই শুরু করতেন। প্রথম ভালোলাগাার একটা আলাদা মূল্য থাকে তাই হয়তো। বিটিভি যখন ছিল ভরসা। তখন এক একটা নাটকের জন্য লোকে তীর্থের কাক হয়ে প্রতীক্ষায় থাকতেন। সেভাবেই যখন শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস থেকে (সংশপ্তক) নাটকটি বিটিভিতে দেখানো হত তখন হুমায়ুন ফরীদির রমজান চরিত্রটি প্রতাপশালী হয়ে ওঠে। জমিদার খলিল-এর সাথে তাঁর নিজস্ব তুলনাহীন অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শক-সমালোচককে। তারপর সেই যে নাটকগুলি – ভাঙনের শব্দ শুনি, বকুলপুর কতদূর, একদিন হঠাৎ, পাথর সময়, শীতের পাখি, কোথাও কেউ নেই, সবুজ সাথী, সমুদ্রে গাঙচিল। মঞ্চ নাটকেও ছিলেন অসাধারণ। কেরামত মঙ্গল, মুনতাসির ফ্যান্টাসি, কীর্তনখোলা। সেলিম আল দীনও তাঁর কাজের ভক্ত ছিলেন। নাটকে পরীক্ষামূলক কাজ কিংবা প্যাকেজ নাটক দুজায়গাতেই ছিলেন অনবদ্য। মঞ্চ নাটক (কোথাও কেউ নেই ) এর ফরীদির সাথে (আরমান ভাই দ্য জেন্টেলম্যান) এর কোনো মিল নেই। এভাবেই ভাঙতে পারতেন নিজে।

সময়কে তিনি শাসন করেছেন সিনেমা দিয়ে। ফরীদির ইতিহাস সিনেমা থেকে নতুন করে লিখতে হয়। ফরীদির ভিলেন চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়কে যারা বের করে নিয়েছেন বা নিতে পেরেছেন তেমন পরিচালক অনেক আছেন। তবে সব থেকে এগিয়ে থাকবেন বোধ হয় শহীদুল ইসলাম খোকন। তাঁর সিনেমা মানেই একসময় ফরীদি ছিল মাস্ট। পালাবি কোথায় সিনেমার সেই যে অফিসের বস যে মেয়েদের দেখলেই খাতির জমাতে চায় তাকে কি আমরা ভুলতে পারি। বাংলার কমান্ডো সিনেমায় দুর্ধর্ষ ডাকাত চরিত্রে তাঁকে দেখে রীতিমত ভয় লাগত। সমুদ্রের ধারে আলীরাজের জিভ কেটে নেয়ার ভয়ঙ্কর সিকোয়েন্সটি দেখে পরপর কদিন ঘুমাতে পারিনি। সন্ত্রাস, ঘাতক, পলাতক আসামী, দোলা, শাসন, বিশ্বপ্রেমিক, আত্ম-অহংকার, অধিকার চাই, লাট সাহেবের মেয়ে, ভণ্ড, ম্যাডাম ফুলি, বীরসৈনিক, মিথ্যার মৃত্যু, হিংসা, নরপিশাচ, ঘৃণা, ত্যাগ এ সিনেমাগুলোতে ভিলেনের ক্যারেক্টারাইজেশনে ফরীদি আলাদা আলাদা এবং সবগুলোকে চেনা যায় এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। নরপিশাচ, পলাতক আসামী, ঘৃণা সিনেমাগুলোতে রুবেলের সাথে ফরীদির অভিনয় ছিল অপূর্ব। একটা সময় ছিল যখন রুবেল ও ফরীদি জমত দারুণ। জমত জসিম, মান্নার সাথেও। সিনেমাগুলোতে অ্যাকশনের পরেও অ্যাকশন ছিল। দোলা সিনেমার প্রেমিক আর বিশ্বপ্রেমিক সিনেমার প্রেমিক এক নয়। দোলা-র প্রেমিক খুবই মাথা গরম আর বিশ্বপ্রেমিক-এর প্রেমিক মাথা গরমের পাশাপাশি অনেক যুক্তিও দেয়। লাট সাহেবের মেয়ে সিনেমায় সন্তান অদল বদল করে লাট সাহেবের ঘরে নিজের মেয়েকে মেীসুমী প্রতিষ্ঠা করা আর লাট সাহেবের ছেলেকে (ওমর সানি) চাকর বানানোর বুদ্ধি দেখে দর্শক ভালো একটা প্রতিযোগিতার গন্ধ পায় যেখানে ফরীদি তাঁর অভিনয় দেখানোর একটা গ্রেট অপরচুনিটি পায়। আর এই অপরচুনিটি যখন আনন্দ অশ্রুর মত সিনেমায় যায় সেটা যেন স্ফূরণ ঘটায়। নানাশাহকে বলা সেই সংলাপ – “টনিসাহেব, দেওয়ান খসরুকে (সালমান শাহ) সারাজীবন পাগল হয়ে থাকতে হবে …. বদ্ধ উন্মাদ হয়ে থাকতে হবে, নইলে ওকে মরতে হবে”  বলার সময় যে অগ্নিমূর্তি দেখতে ভালো লাগে এই ভেবে যে একজন প্রকৃত অভিনেতাই পারেন এই অভিনয়কে জীবন্ত করতে। ভণ্ড সিনেমায় এটিএম শামসুজ্জামানের সাথে পাল্লা দিয়ে দারুণ ফানি কিছু অভিনয় দর্শককে বিনোদন দেয়। ম্যাডাম ফুলি সিনেমায়ও তাই। ভণ্ড ওঝার সঙ্গে প্রেমিক ফরীদি ছিল দুর্দান্ত। পরে শেষের দিকে পুলিশ যখন নিয়ে যাচ্ছিল এটিএম কে দেখে বলে – “আমি একা জেলে যামু না তোমারেও নিয়া যামু” এটিএম অস্বীকার করে – এরকম মজার দৃশ্যগুলোতে ফরীদি ছিল চরিত্র ভেঙে চরিত্র গড়ার কারিগর।

ভিলেনের গান দেখতে কার না ভালো লাগে। সে গানে দর্শক যেমন আনন্দ পায় তেমনি সিনেমার বাড়তি একটা আনন্দ যোগ করে। ফরীদি সেখানে অসাধারণ। পালাবি কোথায় সিনেমায় শাবানা, সুবর্ণাা, চম্পার সাথে জাদুরে সোনারে ও খুকুমনিরে আমাকে ভালোবাসোরে,  বিশ্বপ্রেমিক সিনেমায় মৌসুমীর সাথে তোমরা কাউকে বোলো না, ত্যাগ সিনেমার তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া কিংবা মায়ের অধিকার সিনেমার পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন ও সোনারে গানগুলো আমাদের সিনেমার মাইলফলক। এমন গান আমাদর সিনেমায় আর হবে কিনা সন্দেহ আছে।

ভিলেন হিশেবে রাজসিক সাফল্যের পাশাপাশি নিজেকে ভাঙার জন্য যে পজেটিভ ক্যারেক্টার ফরীদি করেছেন সেটাও ইতিহাস। মায়ের অধিকার সিনেমায় সালমান শাহর মামা চরিত্রে সেই যে সংলাপটগুলো – “জীবনের এই পর্যায়ে আইসা একটা হিশাব কিছুতেই মিলাইতে পারতাছি না, ভাগ্নে। যাই হোক তোমার মা খুব অসুস্থ, যদি ইচ্ছা হয় একবার দেখতে যাইও। নিরাময় হাসপাতালে ৩০১ নাম্বার কেবিনে মৃত্যরে সাথে পান্জা লড়ছে” মনে দাগ কাটে সংলাপগুলো। ব্যাচেলর সিনেমায় ইলোরা গহরের প্রেমে পড়ার সময় তাঁর বেশি বয়সের যে প্রেমিক চরিত্রের অভিনয় তা কি ভোলা যায়!! তার ওপর আবার ঐ হিট গানটি – “আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে”। অসাধারণ গান। পজেটিভ চরিত্রে পাহারাদার সিনেমায় চাকরের ভূমিকায় ফরীদির অভিনয় ছিল চোখ জুড়ানো, চোখে পানি আসে। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় অনবদ্য কাজ একাত্তরের যীশু, শ্যামল ছায়া, জয়যাত্রা। আমার বিস্ময় কাটে না একাত্তরের যীশু দেখে। কী সাদামাটা একজন লোক মুক্তিযোদ্ধাদের আগলে রাখছেন। আর নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ফরীদির কাছ থেকে বের করে নেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ইমেজের ক্যারেক্টারাইজেশন। ঠিক একই কাজটি বের করে নেন হুমায়ূন আহমেদ (শ্যামল ছায়া) সিনেমায়। এ সিনেমায় “কোন বা পথে নিতাইগণ্জ যাই” গানটিতে গানের দলের ভূমিকায় ফরীদি মিশে যান। অভিনয় তো একেই বলে যদি চরিত্রে মিশেই না যাওয়া গেল তো চরিত্র নিজেই নিজেকে ক্ষমা করে না। ফরীদি চরিত্রকে শাসন করতে জানতেন।

কবিতায় আছে –

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এ পৃথিবীর সাথে কোনোদিন
-পাখি হয়ে যায় প্রাণ,আবুল হাসান

এত রঙিন কর্মময় জীবনের পরেও হুমায়ুন ফরীদি শেষ পর্যন্ত একা……..যাকে জীবনে সব থেকে ভালোবেসেছেন সেই সুবর্ণা যখন তাঁকে ছেড়ে চলে যান এবং তিনি কবির কথামতই যদি বলি এ পৃথিবীর সাথে আর নিজেকে একাত্ম করতে পারেননি এবং সেখানেই অচেনা ও একা হয়ে যান চিরতরে………যেদিন সুবর্ণার দ্বিতীয় বিয়ে হয় এখনো মনে আছে আমাদের বিভাগে বড়আপুরা ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে লিখেছিল ….(সুবর্ণা, আজকের পর থেকে তোমাকে আর শ্রদ্ধা করি না…..শুধুই ঘৃণা করি)…..তারাও তো নারী ছিল অথচ দেখুন নারী হয়ে আর একজন নারীকে তারাও সেদিন সাপোর্ট করতে পারেনি……ফরীদি তাহলে কোথায় ছিলেন,দর্শকেন মনে কীভাবে ছিলেন,কতটা জুড়ে ছিলেন সেটি আমাদের অনায়াসেই বোঝা যায়…………. যেদিন মারা যান চ্যানেলে ইমদাদুল হক মিলনের একটা সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম।তিনি ফরীদির খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।মিলন বললেন (যেদিন আমি শেষবারের মত আমার বন্ধুকে দেখতে যাই দেখি আমার বন্ধু অসহায়ের মত সোফায় বসে আছে…তাঁর মুখের রং পাল্টে গেছে…চামড়া ঝুলে গেছে…আমার বন্ধুকে এত অসহায় আমি কখনো দেখিনি)….কথাগুলো শুনে বুকটা ভেঙে যায়….

ফরীদিকে প্রথম দেখি জাহাঙ্গীরনগরে সেলিম আল দীনের মৃত্যুবার্ষিকীতে। ফুল দিতে এসেছিলেন সমাধিতে। কথা বলার সেীভাগ্য হয়নি। শুধু দেখছিলাম তিনি একদৃষ্টিতে সেলিম আল দীনের সমাধির দিকে তাকিয়ে আছেন। আর শেষবারের মত দেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তাঁকে চেনা যাচ্ছিল না। মৃত্যুর পরে অনেককেই চেনা যায় না। মৃত্যু পাল্টে দেয় গায়ের রং। মৃত্যু পাল্টাতে পারে না জীবনের আয়োজন….সে আয়োজনে একজন হুমায়ুন ফরীদি ইতিহাস…..আমরা সে ইতিহাসে আমৃত্যু ডুবে থাকতে চাই……..আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে অসীম শ্রদ্ধা সেই শিল্পীকে…


Leave a reply