Select Page

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে প্রাণহীন বাণিজ্যিক ছবি ‘এই তো প্রেম’

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে প্রাণহীন বাণিজ্যিক ছবি ‘এই তো প্রেম’

এই তো প্রেম বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেন পুত্র সোহেল আরমান নির্মিত বহুল প্রতিক্ষিত চলচ্চিত্র। পরিচালক তার প্রথম ছবির জন্য মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বেছে নিয়েছেন এবং একে বাণিজ্যিক কাঠামোর মধ্যে রেখে বাংলাদেশের প্রথম (সম্ভবত) মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাণিজ্যিক ফর্মূলার ছবি নির্মানের চেষ্টা করেছেন। এভাবে ”চেষ্টা করেছেন” বলার কারন হলো এই যে পুরো ছবিতে পরিচালকের এই বানিজ্যিককরন চেস্টা খুব বেশী চোখে পড়েছে। তবে সে চেষ্টায় তিনি কতটুকু সফল কিংবা ব্যার্থ হয়েছেন সে বিষয়ে পরে বলি।

ছবির গল্প সূর্য এবং মাধবীকে নিয়ে। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ভিন্ন জাতের এ দুটো তরুণ ছেলেমেয়েকে দেখা যায় প্রেমময় খুনসুটিতে লিপ্ত হতে। ভালোবাসায় আচ্ছন্ন এ দুটো ছেলেমেয়েকে যুদ্ধ স্পর্শ করে না। সূর্যের মুক্তিযোদ্ধা বাবা চায় ছেলে এসব বাদ দিয়ে দেশের জন্য লড়ুক। অন্যদিকে মাধবীর পরিবার (হিন্দু ধর্মালম্বী) দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। সূর্য আর মাধবী পরিবারকে না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে। মাধবীর পরিবার তাকে রেখে দেশ ত্যাগ করে এবং সূর্যের পরিবার (বাবা – মা, ছোট বোন) মিলিটারীর হাতে খুন হয়। সূর্য আর মাধবীর উচ্ছল জীবনে যুদ্ধ নিয়ে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়।

গল্পটা শুনতে একেবারে খারাপ লাগে না। তবে সমস্যা হলো নির্মাতার গল্প বলার ঢং এতোটাই সাদামাটা এবং সেকেলে যে পর্দায় এই গল্প কোনভাবেই দর্শককে আকৃষ্ট করে না। তার উপরে আছে বিচ্ছিন্ন সব সাব-প্লটের অনুপ্রবেশ। ছবির প্রথমার্ধে গল্প একেবারেই এগোয় না ফলে সময় যত এগোয় ছবির প্রতি দর্শক হতাশা ততোই বাড়ে। দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য গল্প ভালো গতিতে চলে এবং দর্শক কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।

অতি সাদামাটা চিত্রনাট্যে অল্প কয়েকটি বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া ভালো বলার মত কিছুই নেই। তবে হ্যাঁ, সেই অল্প কিছু বিশেষ মুহূর্তগুলো সত্যিকারার্থেই বিশেষ এবং এগুলো দর্শকদেরকে খানিক সময়ের জন্য হলেও চমৎকৃত করে। উদাহরনস্বরূপ নিপুণ অভিনীত ছোট্ট চরিত্রটি অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং দর্শক এই টুইষ্টটি বেশ উপভোগ করে।

ছবির সবচেয়ে দুর্বল এবং বিরক্তিকর দিক হচ্ছে ছবির সংলাপ। এতো সাদামাটা, দায়সাড়া গোছের সংলাপ সাধারণ বানিজ্যিক বাংলা ছবিতেও খুব বেশী দেখা যায় না। সংলাপ শুনে ঘুম চলে আসে আর চরম বিরক্তে হল ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছে করে। সংলাপগুলো না রিয়েলিস্টিক, না ড্রামাটিক। এর চেয়ে ভালো মশার গুনগুনানি কিংবা মাছির ভনভনানি শোনা। তবু তাতে কিছু ছন্দ কিংবা সূর আছে। একটি চলচ্চিত্রে সংলাপ যে কত গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা কি তা জানেন না ? এ বিষয়টিতে আমার অভিযোগের শেষ নেই। চলচ্চিত্র এবং যাত্রাপালার মধ্যকার পার্থক্যটুকু সম্পর্কে কি নির্মাতার ধারণা নেই? ঘুম কাতুরে সংলাপে যাত্রার লাউড টান কি সহ্য করা যায়!

ছবির এডিটিং এবং সিনেমাটোগ্রাফি আহামরি না, তবে সাধারণ বাংলা ছবি গুলোর চেয়ে ভালো। বিশেষ করে সিনেমাটোগ্রাফিতে ভালো করার চেষ্টা ছিলো। চেষ্টাটাই চোখে পড়েছে, খুব ভালো কোন রেজাল্ট চোখে পড়েনি। তারপরও সিনেমাটোগ্রাফির জন্য থাম্বস আপ। গানগুলো এবং বিশেষ বিশেষ কিছু দৃশ্যের চিত্রায়ন মোটামুটি ভালো হয়েছে।

ছবির সবচেয়ে ভালো দিক এর গান। এক কথায় অসাধারণ গানগুলোই ছবির একমাত্র আকর্ষণীয় দিক। এ ছবির প্রত্যেকটি গানই শুনতে ভালো লাগে। পরিচালক গানগুলোকে চিত্রায়নও করেছেন যত্ন নিয়ে। হাবিব ওয়াহিদের মিউজিকের ব্যাপারে যত প্রশংসা করবো ততোই কম হবে। ”আমি তোমার মনের ভিতর” তো অনেক আগেই মানুষের হৃদয় জয় করেছে তবে দেশের গানটি হলের দর্শকদের কাঁপিয়ে দিয়েছে। আধুনিক মেলোডিতে দেশোত্ববোধক কথা সত্যিই অন্য রকম অনুভূতি দেয়। সুন্দর গানের সাথে সুন্দর লোকেশন এবং শাকিব-বিন্দুর পারফরমেন্স, লুক, সবই মনোহর ছিলো। গানের জন্য ছবি ১০ এ ১০ পায়।

ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যগুলো অত্যন্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও মোটামুটি ভালোভাবেই নির্মিত হয়েছে।

সোহেল আরমান পরিচালক হিসেবে চেষ্টা করেছেন এবং তার চেষ্টাটা নজড়ে আসে। গানগুলোর চিত্রায়ন এবং অ্যাকশন দৃশ্যায়নে তার চেষ্টার তারিফ করতে হয়। তবে চেষ্টা চোখে পড়লেও সব মিলিয়ে সুন্দরভাবে ছবিটি নির্মাণ করতে তিনি মোটামুটি ব্যার্থই হয়েছেন ।

শাকিব খান অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা এবং এখনও তাকে দেখতে বেশ সুদর্শন লাগে। পাশাপাশি শাকিব যে অভিনয়টাও খারাপ করেন না তা এ ছবি দেখলে বোঝা যায়। শাকিব চরিত্রানুযায়ী ভালোই করেছেন। বিন্দু শাড়িতে অত্যন্ত সুন্দর লাগে তবে তার কর্কশ কন্ঠ বিরক্তির চরম মাত্রা অতিক্রম করে যায়। গানগুলোতে শাকিব-বিন্দুকে বেশ ভালো লেগেছে। তাদের পর্দা রসায়ন ভালোই ছিলো। অমিত হাসানের চরিত্রটি মোটামুটি ইন্টারেস্টিং এবং চরিত্রানুযায়ী সে ভালো ছিলো। নিপুণ তার পাঁচ মিনিটের উপস্থিতি পর্দা কাঁপিয়ে দিয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে এ ছবির ছোট ছোট চরিত্রে বড় মাপের যে সব অভিনেতারা ছিলো তাদের কেউওই জ্বলে উঠতে পারেনি। এটা যে পরিচালকের কত বড় ব্যর্থতা তা বলে বুঝানো যাবে না। এতো ভালো ভালো অভিনেতাদের এভাবে ওয়েস্ট হতে আমি খুব কমই দেখেছি।

সবমিলিয়ে এইতো প্রেম বাণিজ্যিক ছবি হিসেবে জঘন্য না হলেও, খুব ভালো কিছুও হয়নি। শিল্পগুণের বিচার করলে এ ছবি মোটামুটি ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবেই চিহ্নিত হয়। আর মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসেবে এটা কেবলই হতাশ করে। ছবির প্রথম অর্ধ বড় জোর ঘুমের ওষুধের বিকল্প হতে পারে আর কিছুই না। তবে দ্বিতীয় অর্ধ মোটামুটি বিনোদনমূলক। ছবির গানগুলো খুব খুব ভালো এবং ক্লাইমেক্সটা মোটামুটি চলে। ভালো বলতে ছবির এটুকুই। আর খারাপ বলতে বাকি সবকিছুই। অখাদ্য সংলাপ, খুব বেশী লাউড এবং প্রাণহীন আবহ্‌, অপরিচ্ছন্ন চিত্রনাট্য, ইত্যাদী, ইত্যাদি।

খুব প্রত্যাশা নিয়ে হলে গেলে হতাশ হতে হবে। তবে শুধুমাত্র গান দেখতে গেলে পয়সা উসুল হতে পারে।

আমি ছবিটিকে ৫ এ ২.৫ দিবো।

— রমিজ (১৫ মার্চ, ২০১৫)


About The Author

Leave a reply