একজন খালেদা আক্তার কল্পনা
আমরা যারা নব্বই দশকীয় শৈশব-কৈশোর পার করা প্রজন্ম শুক্রবারের পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির সময়গুলোতে মায়েদের ভূমিকায় যাদেরকে দেখে বড় হয়েছি তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুপরিচিত মুখ ছিলেন অভিনেত্রী খালেদা আক্তার কল্পনা। তিনি অসংখ্য ছবিতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছেন। মায়ের প্রতি বাস্তবে আমরা যে চিরন্তন বন্ধন অনুভব করি তাঁর অভিনয়ের মধ্যে সে অনুভূতি পাওয়া যেত। মনে হত তিনি পর্দায় মায়েদের একজন প্রতিনিধি।
জন্ম ৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৩ সালে, কক্সবাজারে। তাঁরা তিন বোন চার ভাই। বাবার উৎসাহ ছিল তাঁর প্রতি অভিনয়ের জন্য। পরিবারে বাবার নিজের থেকেই উৎসাহ দেয়ার ঘটনা খুব কম দেখা যায়। একবার গ্রামে একটা প্রোগ্রামে শিশুশিল্পী পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁর বাবা এসে বললেন কাজটা করবে কিনা। মেয়ে উৎসাহ বোধ করল। কাজটা করার পর পুরস্কার পেয়ে যান। তখন তাঁর মধ্যে অভিনয় করার চিন্তা আরো প্রবল হয়ে উঠল। তিনি মনে করলেন অভিনয়টা তাঁকে দিয়ে হবে।
বড় হয়েছেন কক্সবাজারে। সেখানে মাট্রিক পাশ করেছেন। সমুদ্রসৈকতে যেতেন বন্ধুদের সাথে নিয়ে। স্বাধীনতা ছিল অনেক। পড়াশোনায়ও খুব ভালো ছিলেন। স্কুল, কলেজে শিক্ষকদের খুব উৎসাহ পেতেন পড়াশোনায়, সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে একটা বিশেষ প্রয়োজনে অনুষ্ঠান ঘোষিকারই একটা কাজ করতে হয়েছিল মহেশখালীতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য কাজটা করেছিলেন। এজন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ আছে কিনা। দিনের বেলা বোমা ফেলা হত জাহাজ থেকে। বোমা ফেলার সময় তিনি মাটিতে শুয়ে পড়তেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মিশনে ওখানকার পাকবাহিনী প্রতিহত হয়। তখন আনন্দ করেছিলেন সবার সাথে।
চট্টগ্রাম বেতারে অনুষ্ঠান ঘোষিকা ছিলেন। রেডিওতে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। তখন বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। আশির দশকের কথা সেটা। ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটে গেল। ১৯৮৪ সালে এফডিসি থেকে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ ঘোষণা করা হলো। অ্যাপ্লাই করার পরে অডিশনের দিনও যাননি। একজন খুব উৎসাহ দেন সাড়ে চার হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি টিকবেন। বিশ্বাস করেননি কথাটা কিন্তু হয়েছিল সেটাই। নির্দিষ্ট তারিখের পর তাকে যোগাযোগ করিয়ে অডিশনে পাঠানো হয়। অডিশনে গিয়ে ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেন। ইন্টারভিউ কার্ড লেটে আসছে বলে দেন। অডিশন নেয়া হলো এবং তিনি প্রশংসিত হন। তখন অডিশনে বিচারকের একজন বললেন-‘আমরা নায়ক-নায়িকা বেশ পেয়েছি কিন্তু ক্যারেক্টার আর্টিস্টের ভীষণ অভাব। আনু আপা (অভিনেত্রী আনোয়ারা) একা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে পারছেন না। আপনাকে আমরা পেয়েছি। ইন্ডাস্ট্রি আরেকজন মা পেল।’ সুযোগ এলো নিজেকে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রে প্রমাণ করার।
স্যুটিং শুরু করেন ইবনে মিজানের ‘পাতাল বিজয়’ ছবির কিন্তু মুক্তি পায় মতিন রহমানের ‘রাধাকৃষ্ণ’ ছবিটি। প্রথম দিন স্যুটিং-এ ভয়ও পাননি কারণ তিনি মঞ্চে কাজ করতেন। প্রথম ছবিতেই দর্শক গ্রহণ করেন তাঁকে। এনজি শট হত না তাঁর। পাশের সেটে সিনিয়র শিল্পীর শট এনজি হত কিন্তু তাঁর হত না। সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী তাঁকে বিভিন্ন ছবির জন্য পরিচালকদের অ্যাসাইন করতেন। তাঁর অবদান আছে ক্যারিয়ারে বলে তিনি মনে করেন।
মায়ের চরিত্রে প্রথম অভিনয় ‘তিনকন্যা’ ছবিতে। ছবিতে সবচেয়ে বেশি মা হয়েছেন নায়ক রুবেলের। রুবেল তাঁকে মা ডাকে। এর পাশাপাশি সেই সময়ের ব্যস্ত সব নায়কের পাশাপাশি বর্তমানের শাকিব খান পর্যন্ত মায়ের ভূমিকায় তিনি ছিলেন। ‘রকি’ ছবিতে কিছুটা চ্যালেণ্ঞ্জিং চরিত্রে ছিলেন। একই ছবিতে জসিমের মা ও স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ছবির গল্পটা মর্মস্পর্শী ছিল।
উল্লেখযোগ্য ছবি :
পাতাল বিজয়, রাধাকৃষ্ণ, তিনকন্যা, ঢাকা ৮৬, সন্ধি, আগমন, দায়ী কে, রকি, বীরপুরুষ, মায়ের কান্না, ডন, ববি, পদ্মা মেঘনা যমুনা, সন্ত্রাস, লক্ষীর সংসার, চাকর, দোলা, অন্ধ প্রেম, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, পালাবি কোথায়, আনন্দ অশ্রু, শিল্পী, সতর্ক শয়তান, জিনের বাদশা, অচেনা, মহাগুরু, ফাঁসি, পাগল মন, অচল পয়সা, অচেনা মানুষ, বিদ্রোহী প্রেমিক, বাঘা বাঘিনী, বাঁশিওয়ালা, শেষ আঘাত, বাবার বাবা, কাসেম মালার প্রেম, লাভ, আয়না বিবির পালা, জিদ্দি, প্রেমের নাম বেদনা, নারী আন্দোলন, খুনের পরিণাম, বেপরোয়া, ফাঁসির আসামী, চাঁদকুমারী চাষার ছেলে, লাল সবুজ, মোহনমালার বনবাস, আঁখি মিলন, হৃদয় শুধু তোমার জন্য, নয়া বাইদানি, কান্দ কেন মন, গুণাই বিবি, ফাইভ রাইফেলস, গহর বাদশা বানেছা পরী, আখেরি হামলা, দুঃখিনী মা, ও আমার ছেলে, ঠাণ্ডা মাথার খুনি, বিচ্ছু বাহিনী, সাহসী মানুষ চাই, ভালোবাসা কারে কয়, লাল বাদশা, মেঘের পরে মেঘ, আমার প্রাণের প্রিয়া, ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না, গহীনে শব্দ, কুসুম কুসুম প্রেম, ডন নাম্বার ওয়ান।
আনোয়ারা, রোজী আফসারী তাঁর প্রিয় অভিনেত্রী। প্রচুর ছবি আসত তাঁর কাছে। প্রয়োজনের জন্যই করা হত কারণ মা চরিত্র সব ছবিতেই কোনো না কোনোভাবে থাকত। দর্শকরা তাঁকে দেখলে মা বলে ডাকতেন। জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন যাদের মা নেই। তিনি সেগুলো গ্রহণও করতেন।
‘ফুলেশ্বরী’ ছবি মুক্তির পরে ‘আনন্দ বিচিত্রা’ পত্রিকায় তাঁর অভিনয় নিয়ে তখনকার চলচ্চিত্র সমালোচক মাহমুদা চৌধুরী লিখেছিলেন-‘এ ছবির পার্শ্ব চরিত্রে নতুন মুখ খালেদা আক্তার কল্পনা-র অভিনয় আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান শিল্পীদের কথা মনে করিয়ে দেয়।’ লেখাটা তাঁর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি সংখ্যাটা যত্ন করে রেখেছিলেন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত ‘জিনের বাদশা’ ছবিতে ১৯৯০ সালে। এ ছবিতে বাপ্পারাজের বড়মার চরিত্রে ছিলেন।
তাঁর মায়ের ভূমিকার অভিনয় জীবন্ত ছিল। হাসি, কান্না সব ধরণের পরিস্থিতিতে মিশে যেতেন। সন্তানের জন্য ব্যাকুল যেমন হতেন তেমনি আবার কঠোরতাও দেখাতেন চরিত্রে।
নাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন। নাটকে অভিনয় করার পাশাপাশি স্ক্রিপ্টও লেখেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক – ঠুয়া, বউ, পাণ্ঞ্জা, ভাত দে, রোদেলা, প্রতিশ্রুতি, লাকি থার্টিন, ব্যাচেলরের বউ।
খালেদা আক্তার কল্পনা চলচ্চিত্রে মায়ের মতো সম্মানজনক অভিনয়ে নাম করেছেন। তিনি আমাদের বাণিজ্যিক ছবিতে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হয়েই থাকবেন।
বি. দ্র. লেখাটি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগৃহীত হয়েছে মাছরাঙা টেলিভিশনের ‘রাঙা সকাল’ অনুষ্ঠান থেকে।