একদিনে ঈদের চার ছবি দর্শন: ভালো-মন্দ
এবারের ঈদুল ফিতরে প্রেক্ষাগৃহে আসা সিনেমা কনটেন্টের দিক থেকে লক্ষণীয়ভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভৌতিক, রহস্য থ্রিলার, গ্রামীণ আর রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও অ্যাকশন।
যতই স্টার সিনেপ্লেক্সের ভক্ত হই না কেন, আমি কখনই একসাথে একদিনে বিভিন্ন সিনেমার শো টাইম মিলাতে পারি নাই। আবার সিনেপ্লেক্সের এক ব্রাঞ্চে সব সিনেমার শো থাকে না, তার ওপর আমার বাসা থেকে স্টার সিনেপ্লেক্সের দূরত্বও বেশ ভালোই। এজন্য আমার ভরসা যমুনার ব্লকবাস্টার সিনেমাস। সিনেমা হলের পিকচার ব্রাইটনেস একটু কম আর টিকিটের দাম একটু বেশি হলেও ব্লকবাস্টার আমার বাসা থেকে কাছে আর এখানে একসাথে মোটামুটি সব সিনেমার শো পাওয়া যায় আর সময়ও ঠিকঠাক মতো মিলানো যায়।
তাই তো, একদিনেই ঈদের ৪টি সিনেমা ব্লকবাস্টারে দেখেছি। বার বার যাওয়ার চেয়ে একবারে গিয়ে দেখা আমার জন্য সুবিধাজনক।
আমার সিনেমাময় দিনের শুরু ছিলো ‘জ্বীন’ দিয়ে, বেলা পৌনে ১২টার শো দিয়ে। জাজ মাল্টিমিডিয়া অনেক চেষ্টা করেছে ভয় পাওয়ানোর জন্য। কিন্তু যে-ই আমি অলরেডি টার্কির ডাব্বে আর সিজ্জিন সিরিজের জ্বীনের সিনেমা দেখেছি, আমার কাছে এই বাংলাদেশি ‘জ্বীন’ মোটেও ভয়ের ছিলো না।
ভয় দেখানোর জন্য বারবার যে কর্কশ সাউন্ড ব্যবহার করা হয়েছে তা মাথা ধরিয়ে দেওয়ার মতো। আবার জ্বীনের চোখ দিয়ে দৃশ্য দেখানোর জন্য বারবার যে স্ক্রিন ঘোলা করে দেওয়া হচ্ছিলো তা চোখের শান্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। যে রকম জাম্প স্কেয়ার শট রাখা হয়েছে তা অন্যান্য দেশের ভৌতিক সিনেমায় ৩০ বছর আগেই ব্যবহার করে ফেলা হয়েছে, তাই নতুনত্ব লাগেনি। ‘জ্বীন’ ভর করা পূজা চেরির সাদা চোখের ডিজাইন খুবই সাদামাটা ছিলো। গানগুলো ছিলো গড়পড়তা।
গল্পের কথা বলতে গেলে বলতে হয় হুট করে জ্বীন কেন এলো পূজা চেরির পরিবারের ওপর তার কোনো ব্যাখ্যা নেই, তার ওপর বাংলাদেশের গ্রাম থেকে আসা জ্বীন কেন উর্দুতে কথা বলে তাও একটা বিস্ময়। আমার মনে হয় ইসলামের সাথে জ্বীনের বিষয়টির সংযোগ ঘটানোর জন্য উর্দু ভাষার অবতারণা করা হয়েছে, কিন্তু যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে উর্দুর চেয়ে আরবি ভাষা ব্যবহার করা যেতো। এছাড়া ছবিতে দুষ্ট জ্বীনের বাদশাহকে সাদা শিংওয়ালা ঘোড়া হিসেবে দেখানো হয়েছে যা বোধগম্য ছিলো না। খারাপ জ্বীনের বাদশাহকে কালো কিছু দেখালে ভালো হতো। এই সিনেমার একটা গানও মনে ধরার মত না। ‘ঢঙ্গি ছেলে’ গানের চিত্রায়নের কনসেপ্টের সাথে ২০০৩ সালের বলিউড সিনেমা ‘খুশি’র ‘হায় রে হায় রে’ গানের সাথে মিল আছে আর ‘জ্বীন ভূত নাই’ গানটির চিত্রায়নের কনসেপ্ট মাইকেল জ্যাকসনের জনপ্রিয় ‘থ্রিলার’ গান থেকে নেওয়া হয়েছে। মানে হলো একটা গানেরও আইডিয়া মৌলিক নয়, অন্য স্থান থেকে ধার করা।
বাংলাদেশি ভৌতিক সিনেমা হয় না বললেই চলে, তাই এই প্রচেষ্টা নেওয়ার জন্য সাধুবাদ দেওয়া যায় কিন্তু এক্সিকিউশন দুর্বল। তবে ছবিতে একটা দিক ভালো লেগেছে সেটা হলো শয়তানি বা দুষ্ট জ্বীন বা মানুষ যেকোনো অপশক্তি যে অন্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্ত করে ধোঁকায় ফেলে ক্ষতি করতে চায় – এই ব্যাপারটার সঠিক প্রতিফলন দেখানো হয়েছে।
জাজ মাল্টিমিডিয়ার আরেক ছবি ‘পাপ-প্রথম চাল’ এর শো ছিলো দুপুর ২টা ২০ মিনিটে। এখানে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে একটা রহস্য ভাব আনার জন্য কিন্তু এক্সিকিউশন খুবই দুর্বল ছিলো। ছবির প্রথমেই একটা খুন দেখানো হয়, কে খুনের আইডিয়া দিয়েছে, কে খুন করেছে, কীভাবে খুন করেছে, সব এক নিমিষেই দেখিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আসে ডিবি পুলিশের কর্ম তৎপরতা যাদের কাজ দেখে খুবই দায়সারাগোছের মনে হয়েছে। এরপর খুনের জের ধরে একটা ব্ল্যাকমেইলিং প্লট গল্পে প্রবেশ করানো হয় যেখানে ব্ল্যাকমেইলারকে ছবির মাঝপথেই দেখিয়ে দেওয়া হয়, মানে রহস্য আর থাকল না।
ছবিতে একটা অবাস্তব ব্যাপার রয়েছে – একটা চরিত্র এক কোটি টাকার ব্যাগ নিয়ে ছাদ-ছাড়া খোলা গাড়িতে করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাস্তবে কারো কাছে এক কোটি টাকার ব্যাগ থাকলে সে আরও সাবধানতা অবলম্বন করতো।
ছবির কাস্টিং দুর্বল। রোশান তার চরিত্রে মোটামুটি ছিলো, ববিকে দেখে ডিবি পুলিশ অফিসার মনেই হয়নি, মনে হয়েছে উনি ডিবি পুলিশ অফিসে মডেলিং করছেন। অন্য যে দুজন নায়িকা নেওয়া হয়েছে, তাদের দেখে মনে হয়েছে জাজ মাল্টিমিডিয়া তাদের সুবিধা নিয়েছে কম কাপড়ের গেটআপ দিয়ে আর বিদঘুটে মেকআপ দিয়ে। তাদের অভিনয়ের ‘অ’ও হয়েছে কিনা সন্দেহ।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিছু কিছু জায়গায় অনেক লাউড ছিলো যা শ্রুতিকটু; বিশেষ করে গাড়ি চালানোর সিনগুলোতে। ছবির একটা গানও সুন্দর না। ছবির শেষে একটা নতুন চরিত্রকে দেখিয়ে টুইস্ট আনার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু তা ছিলো বৃথা চেষ্টা। কারণ বলা নাই, কওয়া নাই, কোথা থেকে নতুন একজনকে দেখিয়ে ছবি শেষ করে দেওয়া হয়েছে।
চারটা সিনেমার মধ্যে এই ‘পাপ-প্রথম’ চাল ছিলো সবচেয়ে দুর্বল।
আদমের শো ছিলো বিকাল ৫টা ১০ মিনিটে। অনেকেই বলেছিলো এই গ্রামীণ গল্প নিয়ে নির্মিত ছবিটি বড় পর্দায় দেখার মত সিনেমা না, এটা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দিলে ভালো হতো। তবে ‘জ্বীন’ আর ‘পাপ-প্রথম চাল’ থেকে ‘আদম’-এর শোয়ে বেশি দর্শক ছিলো।
ছবির প্রথম ভাগে গ্রামের সহজ-সরল জীবন-যাপনের মাটির গল্প রয়েছে আর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে সেই সহজ-সরল স্বভাবের সুযোগ নিয়ে প্রতারণা আর হেরে যাওয়ার গল্প। ছবির সমাপ্তিতে ভালো চরিত্রগুলোর পরাজয় আর শয়তান চরিত্রগুলোর কোনো বিচার না হওয়া মেনে নেওয়াটা কষ্টকর, হয়তো পরিচালক এভাবেই ছবিটা শেষ করতে চেয়েছেন, কিন্তু শয়তানদের বিচারটা দেখালো একটু শান্তি লাগতো।
‘আদম’-এর গল্প চির-চেনা-পরিচিত হলেও শক্তিশালী দিক ছিলো শক্তিশালী অভিনয়। ইয়াশ রোহান, ঐশী, এলেন শুভ্র, শহীদুজ্জামান সেলিম, মুনিরা মিঠু, রাইসুল ইসলাম আসাদ – সবাই যার যার চরিত্রে একদম মানানসই ছিলো। বিশেষ করে নির্জন দ্বীপে ইয়াশ রোহান আর বোবা চরিত্রে এলেন শুভ্রের বেঁচে থাকার সংগ্রামের দৃশ্যগুলো রবিনসন ক্রুসোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
গ্রামের লোকেশন ছিলো চোখের দেখার শান্তি। ‘জ্বীন’ ও ‘পাপ-প্রথম চাল’ সিনেমার গানগুলো আশাহত করার পর আদমের গানগুলো ছিলো ব্রেথ অব ফ্রেশ এয়ার অর্থাৎ স্বস্তিদায়ক। বিশেষ করে ‘রঙ্গিন প্রাণ সজনী’ সিনেমার কালজয়ী গান ‘আমার কাঙ্খের কলসি’র নতুনরূপে চিত্রায়নের সাথে বাংলাদেশের যেকোনো দর্শক নিজেকে রিলেট করতে পারবে আর ‘আদম সন্তান’ গানটির কথাগুলো মনে দাগ কাটার মতো।
ছবির নেগেটিভ দিক বলতে গেলে এর প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো রান-টাইম উল্লেখ করা যেতে পারে। ছবিটির যে গল্প তা আরও কম সময়ের মধ্যে দেখানো সম্ভব।
সব শেষে রাত সাড়ে ৮টার শোতে দেখলাম ‘লোকাল’। পুরো ছবির শুটিং করা হয়েছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যা দর্শকরা রিলেট করতে পারবে।
ছবিতে আদর আজাদের রাফ অ্যান্ড টাফ লুক আর বুবলির অভিনয় সন্তোষজনক ছিলো। এছাড়াও ছিলো এক-ঝাঁক ভিলেনের মেলা – মিশা সওদাগর, শিবা শানু, ডন ও আহমেদ শরীফ। বাংলাদেশের সিনেমায় সব ভিলেনদের অভিনয়ের ধরন প্রায় একই রকম। তাদের বিরুদ্ধে নায়কের প্রতিশোধ নেওয়া আর প্রতিপক্ষ হিসেবে নতুন শক্তি দাঁড় করানোর মাধ্যমে এগিয়ে গেছে ছবির কাহিনী।
অ্যাকশন দৃশ্যগুলো এবং সেগুলোতে নায়কের বোপর আলো দিয়ে তাকে হাইলাইট করার চিত্রায়ণ ভালো ছিলো। ছবিতে একটা মিষ্টি প্রেমের গান আছে আবার একটা আপ-বিটের ‘খেলা হবে’ আছে যেটার কোরিওগ্রাফিতে কিছুটা ইন্ডিয়ান দক্ষিণী সিনেমার প্রভাব লক্ষণীয় ছিলো, তবে তা দেখতে খারাপ লাগেনি। ছবিতে বেশ কিছু ভালো সংলাপ রয়েছে। এই ছবিতে পুলিশের কিছু চরিত্র ছিলো যাদেরকে শো-পিস ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি।