এক গীতিকবি আখ্যান
‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়
অতীতের থেকে উঠে এসে আজকের মানুষের কাছে প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে’
– জীবনানন্দ দাশ
একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল দৈহিকভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, রয়ে যাবেন মানসিকভাবে। তাঁর বর্ণাঢ্য সৃষ্টির জগতে তিনি অমর হয়ে থাকবেন চেতনা হয়ে।
এ মাসেই তিনি তাঁর ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন- ‘আমাকে যেন ভুলে যেও না তোমরা।’ কথায় বলে-‘মানুষ মৃত্যুর আগে বুঝতে পারে তাঁর সময় শেষ।’ সম্ভবত তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন। ঘাতক হৃদরোগ তাঁকে কেড়ে নিল আমাদের কাছ থেকে।
জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে, ঢাকায়। মৃত্যু ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ঢাকায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং দেশের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও গর্বিত করেছেন নিজেকে। পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে ২০০০ পরবর্তী সময়ে সেকাল-একাল বিশাল এক সময়ের সাক্ষি তিনি।
গানের মানুষ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন চলচ্চিত্রে সত্তরের দশক থেকে। সঙ্গীত পরিচালনায় তিনি একাধারে গীতিকার ও সুরকার। প্রথম সঙ্গীত পরিচালনার ছবি ‘নাগরদোলা’, দ্বিতীয় ‘মেঘ বিজলি বাদল’। এরপর অনেক ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় দেশের কিংবদন্তি প্রায় সব শিল্পী যেমন; রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, এ্যান্ড্রু কিশোর, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সুবীর নন্দী, খালিদ হাসান মিলু গেয়েছেন।
সঙ্গীত পরিচালনায় অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যেমন :
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – দুইবার : প্রেমের তাজমহল (২০০১), হাজার বছর ধরে (২০০৫)
বাচসাস পুরস্কার রেকর্ড পরিমাণ ১১ বার পেয়েছেন।
এছাড়া একুশে পদক, সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক পেয়েছেন।
সঙ্গীত পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য ছবি :
মেঘ বিজলি বাদল, আঁখি মিলন, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, রঙিন রাখালবন্ধু, দুনিয়া, জীবনধারা, পাতাল বিজয়, নয়নের আলো, দায়ী কে, দাঙ্গা, অবুঝ হৃদয়, মরণের পরে, সহযাত্রী, লোভ লালসা, ছেলে কার, অন্ধ প্রেম, আনন্দ অশ্রু, বিক্ষোভ, তোমাকে চাই, চাওয়া থেকে পাওয়া, মায়ের অধিকার, মহা মিলন, আত্ম অহংকার, লক্ষ্মীর সংসার, বন্ধন, সিপাহী, অনেক দিনের আশা, জ্যোতি, হুলিয়া, সুখের ঘরে দুখের আগুন, অন্ধ ভালোবাসা, লাভ স্টোরি, মুক্তি চাই, অবুঝ দুটি মন, তেজী, আম্মাজান, কষ্ট, ধর, সমাজকে বদলে দাও, মিনিস্টার, আব্বাজান, মাতৃভূমি, বিয়ের ফুল, নারীর মন, প্রেমের তাজমহল, মন মানে না, কাজের মেয়ে, ভালোবাসি তোমাকে, বিদ্রোহ চারিদিকে, না বোলো না, মা যখন বিচারক, প্রেমের জ্বালা, দুই নয়নের আলো, আজ গায়ে হলুদ, লাভ ইন থাইল্যান্ড, ইতিহাস, অন্ধকার, প্রেম কেন কাঁদায়, আমার অন্তরে তুমি, ভালোবাসার শত্রু, কপাল, মা আমার স্বর্গ, মাটির ঠিকানা, মিয়া বাড়ির চাকর, সন্তান আমার অহংকার ও গুরুভাই।
সুরারোপিত উল্লেখযোগ্য গান :
ও বন্ধুরে প্রাণ বন্ধুরে – মেঘ বিজলি বাদল
আমার সারা দেহ – নয়নের আলো
আমার বাবার মুখে – নয়নের আলো
আমার বুকের মধ্যেখানে – নয়নের আলো
আমি তোমারই প্রেম ভিখারি – চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা
আমার গরুর গাড়িতে – আঁখি মিলন
তুমি আমার জীবন – অবুঝ হৃদয়
হে মাতৃভূমি কি দিলে প্রতিদান – দাঙ্গা
পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই – সহযাত্রী
কত মানুষ ভবের বাজারে – লাভ স্টোরি
তুমি মোর জীবনের ভাবনা – আনন্দ অশ্রু
তুমি আমার এমনই একজন – আনন্দ অশ্রু
উত্তরে ভয়ঙ্কর জঙ্গল – আনন্দ অশ্রু
ভালো আছি ভালো থেকো – তোমাকে চাই
একাত্তরের মা জননী – বিক্ষোভ
বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয় – বিক্ষোভ
আমায় অনেক বড় ডিগ্রী – বিক্ষোভ
তুই ছাড়া কে আছে আমার – মায়ের অধিকার
একদিন দুইদিন তিনদিন পর – মহা মিলন
পৃথিবী তো দুদিনেরই বাসা – মরণের পরে
তোমার জন্মদিন – সুখের ঘরে দুখের আগুন
পৃথিবীর জন্ম যেদিন থেকে – জ্যোতি
আমার সুখেরও কলসি – জ্যোতি
আমার একদিকে পৃথিবী – আত্ম অহংকার
জাগো জাগো প্রিয়তমা – আত্ম অহংকার
আম্মাজান আম্মাজান – আম্মাজান
স্বামী আর স্ত্রী বানাইছে – আম্মাজান
ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে – আব্বাজান
মোরা নিরন্ন বড় ক্ষুধার্ত – বিদ্রোহ চারিদিকে
জীবন ফুরিয়ে যাবে – বিদ্রোহ চারিদিকে
তোমায় দেখলে মনে হয় – বিয়ের ফুল
ঐ চাঁদ মুখে যেন – বিয়ের ফুল
জীবনে বসন্ত এসেছে – নারীর মন
ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী – নারীর মন
এই বুকে বইছে যমুনা – প্রেমের তাজমহল
পড়ে না চোখের পলক – প্রাণের চেয়ে প্রিয়
যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে – প্রাণের চেয়ে প্রিয়
কি আমার পরিচয় – প্রাণের চেয়ে প্রিয়
অনেক সাধনার পরে আমি – ভালোবাসি তোমাকে
তোমার ঐ মুখের হাসি – দুই নয়নের আলো
তুমি সুতোয় বেঁধেছ শাপলার ফুল – হাজার বছর ধরে
একদিন তোমাকে না দেখলে – কাজের মেয়ে
কি কথা যে লিখি – না বোলো না
নদী চায় চলতে – না বোলো না
সাগরের মতোই গভীর – প্রেমের জ্বালা
অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে – লুটতরাজ
এই জগৎ সংসারে তুমি – তেজী
আমি জীবন্ত একটা লাশ – ইতিহাস
চোখ যে মনের কথা বলে – আজ গায়ে হলুদ
প্রতিদিন তোমাকে আমি চাই – আমার অন্তরে তুমি
আমার হৃদয় একটা আয়না – ফুল নেবো না অশ্রু নেবো
তোমার ঐ মুখের হাসি – আমার স্বপ্ন তুমি
তিনি চলচ্চিত্রে গান লেখা ও সুর করার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন। এ কিউ খোকন পরিচালিত ‘গুরুভাই’ ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন গডফাদার হিসেবে। ছবিতে তাঁর ভূমিকা গানকেন্দ্রিকই ছিল।
দেশাত্মবোধক গানেও তাঁর অনবদ্য সংযোজন আছে। সাবিনা ইয়াসমিনের বিখ্যাত গান ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না, সেই রেললাইনের ধারে, মাঝি নাও ছাইড়া দে, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’ তাঁর লেখা।
তিনি এনটিভি আয়োজিত ২০০৫ সালে সঙ্গীত প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’-এর অন্যতম প্রধান বিচারক ছিলেন। নোলক, সালমা, বিউটি-দের মতো প্রতিভা তাঁর হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছিল। এ আয়োজনে তাঁর গান নিয়ে বিশেষভাবে একটা পর্ব করা হত যার নাম ছিল ‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাউন্ড।’ তিনি চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অ্যালবামের গানেও কথা ও সুরে অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে মনির খানের উল্লেখযোগ্য হিট গানের গীতিকার, সুরকার তিনি ছিলেন।
একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল কিংবদন্তি ইমেজে গানের জগতে অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টিগুলো থেকে প্রেরণা নিয়ে আগামী দিনের গানের জগতে অবদান রাখবে অনেকে। পাশাপাশি তাঁর সৃষ্টিকর্মকে মূল্যায়ন করতে হবে তবেই তাঁর প্রতি দেয়া হবে যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা।