এক যুগেও শাকিবের বিকল্প পায়নি ঢালিউড
এটা কোনোভাবে অস্বীকারের উপায় নেই যে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এই সময়ের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনিই ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা। অনেক অভিনেতা এর মাঝে এসেছেন; তবে প্রতিযোগিতায় শাকিব এগিয়ে ছিলেন সবসময়ই। এমনকি বক্স অফিস নিরিখে তার আশপাশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোন অভিনেতাই নেই।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় করে চললেও কিং খান হিসেবে শাকিবের উত্থানটা ২০০৮ সালের দিকে। তারপর থেকে ঢাকাই সিনেমার শীর্ষ নায়ক তিনি। সিনেমার মন্দার একটা সময়ে বলা হতো শাকিব নিজেই ইন্ডাস্ট্রি, তাকে ঘিরেই এখানে টাকা লগ্নি হয়, ব্যবসাসফল সিনেমার বীজ বোনেন প্রযোজক-হল মালিকরা। চলচ্চিত্রে অনেক নতুন মুখ আসে তারা আলোচিত হন, সম্ভাবনার আশা জাগান। তাদের অনেকে হারিয়েও যাচ্ছেন সময়ের নিয়মে। এতকিছুর মাঝেও শাকিব খান বহাল তবিয়তে তার স্টারডম টিকিয়ে রেখেছেন।
শাকিব খান ১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘধীতে মাসুদ রানা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে এসে নাম পাল্টিয়ে শাকিব খান রাখা হয়। তার বাবা আব্দুর রব ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী এবং মা নূরজাহান একজন গৃহিণী। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হলেন এক বোন ও এক ভাই। বাবার চাকরির সুবাদে তার শৈশব-কৈশোর থেকে বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে।
কাগজে কলমে শাকিব খান প্রথমে চুক্তিবদ্ধ হন আফতাব খান টুলু পরিচালিত ‘সবাইতো সুখী হতে চায়’ সিনেমাতে। তবে হলে মুক্তি পাওয়ার সুবাদে শাকিব খানের প্রথম সিনেমা ধরা হয় সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘অনন্ত ভালোবাসা’কে। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটি তেমন সফল না হলেও শাকিব নির্মাতাদের চোখে পড়েন। তারপর একে একে অনেক সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্র আবার কোনটায় একক নায়ক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
২০০৭ সালের দিকে এসে জনপ্রিয় নায়ক হিসেবে আস্তে আস্তে একটি জায়গা করে নেন তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে। ওই বছর তার দেড় ডজন সিনেমা ব্যবসাসফল হিসেবে নাম লিখিয়ে নেয়। তখনকার সময়ের সুপারস্টার নায়ক মান্নার সাথে তার কিছু সিনেমা বক্স অফিসে ব্যাপক ঝড় তোলে। মান্নার আকস্মিক মৃত্যুর পরে তিনি একাই চলচ্চিত্রের দুঃসময়ের কান্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হন। এর পরের গল্পটা শুধুই সাফল্যর। ২০০৮ থেকে ২০২০ এই এক যুগে শাকিবের অবস্থান নাড়াতে পারেননি কেউ। অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি।
গত এক যুগ ধরে রাজার মতই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন চলচ্চিত্র অঙ্গন। একে একে উপহার দিয়েছেন কোটি টাকার কাবিন, চাচ্চু, আমার স্বপ্ন তুমি, দাদীমা, এক বুক জ্বালা, সন্তান আমার অহংকার, আদরের জামাই, ডন নাম্বার ওয়ান, প্রিয়া আমার প্রিয়া, সুভা, জান আমার জান, দেবদাস, কিং খান, সত্তা, নাম্বার ওয়ান শাকিব খান, রাজনীতি, পূর্ণদৈঘ্য প্রেম কাহিনী, বসগিরি, পাসওয়ার্ডসহ অসংখ্য সুপারহিট সিনেমা। শুধু নায়ক নয়, প্রযোজক হিসেবেও তার প্রথম সিনেমা ‘হিরো দ্য সুপারস্টার’-এ অভূর্তপূর্ব সাফল্য পেয়েছেন। শুধু ঢালিউড নয়, কাজ করেছেন টালিউডেও। সেখানেও উপহার দিয়েছেন শিকারি, নবাব, ভাইজান এলো রে’র মতো সুপারহিট সিনেমা। তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, বাংলাদেশের একটি শ্রেনীর কাছে নায়ক হিসেবে শাকিব খানের কদর বাড়ে মূলত ‘শিকারি’র মধ্য দিয়ে। ভালো পরিচালক ও বিষয় পেলে শাকিব যে চমকে দিতে পারেন তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন বেশ ভালোভাবেই।
সমসাময়িক প্রায় সব প্রবীণ-নবীন নির্মাতার সাথেই কাজ করেছেন শাকিব। চাষী নজরুল ইসলাম, সোহানুর রহমান সোহান, বদিউল আলম খোকন, মনতাজুর রহমান আকবর, এফ আই মানিক, কাজী হায়াৎ, মালেক আফসারী, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, এজে রানা, জাকির হোসেন রাজু, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, হাসিবুর রহমান কল্লোলসহ আমাদের দেশের অনেক জনপ্রিয় ও দক্ষ পরিচালকদের সিনেমায় দেখা গেছে তাকে। ক্যারিয়ারের দিক তাকালে তার থেকে সিনিয়র মৌসুমী, শাবনূর, পপি থেকে শুরু করে পূর্ণিমা, মুনমুন, সাহারা, মিম, মাহি হোক বা আজকের নবাগতা বুবলি, নুসরাত ফারিয়া, রোদেলা জান্নাত, পূজা চেরিসহ আরও অনেকে নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করেছেন। তবে অপু বিশ্বাসের সাথে তার জুটি বাংলাসিনেমার ইতিহাসে অন্যতম একটি জনপ্রিয় জুটি। ৭০ টির বেশি সিনেমায় তারা জুটি বেধে কাজ করেছেন। উপহার দিয়েছেন অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমা। পরবর্তীতে প্রেম, বিয়ে, সন্তান এবং ডিভোর্স এসব নানা বিষয়ে মতপার্থক্যে নিয়ে শাকিব-অপু জুটি ভেঙ্গে যায়।
অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’, ২০১২ সালে ‘খোদার পরে মা’ এবং ২০১৫ সালের ‘আরও ভালোবাসবো তোমায়’, ২০১৭ সালে ‘সত্তা’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন শাকিব খান। আটবার পেয়েছেন মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার। এ ছাড়া বাচসাসসহ অসংখ্য পুরস্কার জয় করে নিয়েছেন।
সফল নায়ক হবার পাশাপাশি শাকিব খান একজন সফল প্রযোজক। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এসকে ফিল্মসের ব্যানারে ২০১৪ সালে মুক্তিপায় ‘হিরো: দ্য সুপারস্টার’, পরিচালক ছিলেন বদিউল আলম খোকন। ২০১৯ সালে করেন ‘পাসওয়ার্ড’, ব্যবসাসফল সিনেমাটি পরিচালনা করছেন মালেক আফসারী। সর্বশেষ ‘বীর’ মুক্তি পায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে কাজী হায়াতের ৫০তম সিনেমাটি ততটা সফল নয়। শাকিব বর্তমানে আমেরিকায় থিতু হলেও সেখানেই শুরু করেছেন অভিনয় ও প্রযোজনার নতুন অধ্যায়।
যারা সিনেমার বাজার নিয়ে খোঁজ-খবর রাখেন তারা ভালো করেই জানেন যে, মন্দার বাজারে বাণিজ্যিক ধারায় শাকিব খান এখনো আশা জাগাতে পারেন। তার ব্যক্তিজীবন, কিছু সিনেমায় অভিনয়, সহশিল্পী, গল্প বা চরিত্র বাছাই নিয়ে অনেক সময় আলোচনা সমালোচনা হলেও তিনিই নাম্বার ওয়ান। এই সময়ে এসে আরিফিন শুভ, সিয়াম, রোশান আশা জাগালেও তাদের পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তাদের কেউ এখনো বক্স অফিসে শাকিবের বিকল্প হতে পারেননি।