এক সপ্তাহ প্রদর্শন করে স্টার সিনেপ্লেক্সই উল্টো বিপাকে পড়লো!
গত ২৯ মার্চ শুধুমাত্র ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পেয়েছিল আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’। নামমাত্র দর্শক উপস্থিতির কারণে স্টার সিনেপ্লেক্স মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহে ছবিটির প্রদর্শন থেকে সরে আসে। আর এই অপরাধের (!) কারণে চলছে প্রতিবাদ, আগামীকাল নাকি মানববন্ধনেরও ডাক দেয়া হয়েছে।
কী আশ্চর্য!!! কী ছেলেমানুষী!!! আমার প্রশ্ন প্রতিবাদকারীদের কাছে: ধরুন আপনি স্টার সিনেপ্লেক্সের মালিক। যে চলচ্চিত্রকে বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রেক্ষাগৃহ প্রদর্শন করতে সম্মত হয়নি, শুধুমাত্র দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে সে চলচ্চিত্র আপনি প্রদর্শন করার পর যখন দেখলেন দর্শক সংখ্যা হাতে গোনা, আপনি সেই সিনেমা কোন যুক্তিতে পরের সপ্তাহে চালাবেন?একজন নির্মাতা যেমন চ্যারিটি করতে সিনেমা নির্মাণ করেন না, একটি প্রেক্ষাগৃহের মালিকও নিশ্চয়ই চ্যারিটি করতে সিনেমার ব্যবসা করেন না।
ভালো চলচ্চিত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলছেন? আন্তরিকতার কথা বলছেন? তাহলে আমার প্রশ্ন নির্মাতাদের কাছে: আপনারা কি সিনেমাটি মুক্তির আগে আন্তরিকতা দেখিয়েছিলেন? যে সিনেমা তিন বছর আগে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছিল, যে উৎসবে পরিচালক ও অভিনেতা পুরস্কার জিতেছিল, সেই চলচ্চিত্রের নামই তো এখনো বাংলাদেশের সব সিনেমাপ্রেমীরা জানেন না। এমন ভালো ছবির নাম তো সবার মুখে মুখে থাকার কথা!!! অথচ ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ মুক্তির আগে এ ছবির প্রযোজক শামসুর রহমান আলভী বলেছিলেন, ‘ আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে নিজ দায়িত্বে একটা সিনেমা নির্মাণ করেছি। তবে আমাদের উচিত ছিলো বাংলাদেশে ছবিটির ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা রাখা’।
সত্যিই তাই। অন্যের দিকে ঢিল না ছুঁড়ে এভাবে ভাবতে শিখুন-আপনার সিনেমার প্রতি প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা আগ্রহী হলেন না কেন? আপনার কাছে হয়তো আপনার সৃষ্টি ‘উৎকৃষ্ট’, কিন্তু ১টি সিনেমা হল বাদে বাকিরা সবাই যেহেতু মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, বুঝতে হবে সমস্যা আপনার। আপনিই আপনার ভালো সিনেমাটিকে, আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া সিনেমাটিকে দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারেননি। আর সে কারণে সিনেমার বেশির ভাগ দর্শকও এ ছবির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। আর দর্শকের আগ্রহ না থাকায় সিনেমা হলগুলোও ছবিটি প্রদর্শন করেনি। কিন্তু আপনারা স্টার সিনেপ্লেক্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আগে কি একটিবারও ভাবলেন না, সবাই যেখানে আপনাদের সৃষ্টিকে আমলই দেয়নি, তখন একমাত্র এই একটি সিনেমা হল-ই পাশে দাঁড়িয়েছিল? তাহলে তো বলতে হয়, বাকি সিনেমা হলগুলো মধ্যিখানে বেঁচে গেল। আপনাদের সৃষ্টিকে সম্মান করে এক সপ্তাহ প্রদর্শন করে স্টার সিনেপ্লেক্সই উল্টো বিপাকে পড়লো! এখন আপনাদের এই প্রতিবাদের কারণে যদি স্টার সিনেপ্লেক্সের মত দেশের ১ নম্বর রুচিশীল মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার পরবর্তীতে এই ধরনের ‘ভালো ছবি’ ১দিনও প্রদর্শন করতে নিরুৎসাহ হয়, ‘এসব উটকো ঝামেলায় আর যাবো না’-বলে পিছিয়ে যায়, তখন?
যখন স্টার সিনেপ্লেক্সই একমাত্র আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তখন অন্য প্রেক্ষাগৃহগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কেন প্রতিবাদ করলেন না আপনারা? স্টার সিনেপ্লেক্সে যখন দর্শক ছবিটি দেখতে আসছিল না, তখন কেন আপনারা দর্শকের কাছে গিয়ে প্রচারণা করলেন না? প্রচারণার জন্য অর্থ লাগে? অর্থ সংকট? ভুল। একটি ছবির প্রচারণার জন্য লাগে শুধু আন্তরিকতা, ইচ্ছা, দরদ, মায়া। যা ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ মুক্তির আগে নির্মাতাদের কারোরই ছিল না। বরং উল্টো অনেক বিনোদন সাংবাদিক, ব্লগার/ ফেসবুকার/ ইউটিউবার্সদের দেখেছি নিজ আগ্রহে নি:স্বার্থভাবে একটি ভালো ছবির পাশে দাঁড়াতে।
‘আমরা ডিস্ট্রিবিউশন বুঝি না, মার্কেটিং জানিনা, আমরা শুধু জানি ভালো সিনেমা বানানো’-এই যুগে এ ধরনের গা বাঁচানো মনোভাব নিয়ে থাকলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করাই উচিত না। আর যদি নির্মাণ করেই থাকেন, সে ছবিটিকে যারা পৃষ্ঠপোষকতা করল, সেই স্টার সিনেপ্লেক্সকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উল্টো প্রতিবাদ করা হচ্ছে! মানব বন্ধন করা হচ্ছে। নিজের কাছে প্রশ্ন করুন: এসব করে কি আপনাদের ছবির প্রতি যুক্তিবাদী দর্শকদের সম্মান বাড়ছে? না কমছে? আফসোস এতটুকুই: প্রতিবাদের জন্য যারা এক হচ্ছেন, তারা যদি একটু এই ভালো সিনেমার প্রচারণার ব্যাপারে এক হতেন! দর্শকও আসতো, সিনেমা হলগুলিও আগ্রহী হতো।
আর একটি প্রশ্ন: যারা সত্যিকারের নির্মাতা, তারা কি এসব কিছুর কখনো তোয়াক্কা করেছেন? করেননি। প্রয়াত তারেক মাসুদ তো দ্বারে দ্বারে গিয়ে সিনেমা ফেরী করে বেড়াতেন। আপনারা কেন বিকল্প উপায়গুলোতে বড় আকারে ঝাপ দিচ্ছেন না?
একটি কথা মানতেই হবে: ভালো সিনেমার কখনো মৃত্যু হয় না। ভালো সিনেমার বিকাশ হবেই। আজ হোক কাল হোক মাথা তুলে সে দাঁড়াবেই। এই বিশ্বায়নের যুগে ভালো সিনেমার হয়ে দর্শকই কথা বলবে। তবে এর শুরুটা করতে হবে ছবির জন্মদাতাকে, পরিচালককে/ প্রযোজককে। আপনি যদি আপনার সন্তানকে মায়া না করেন, কেউ করবে না কিন্তু। সুতরাং, রেষারেষি ভুলে চলুন শান্তির গান গাই। সবেধন নীলমনি মাত্র কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্স আমাদের। শুধু শুধু প্রতিবাদ করে দিন শেষে কতটুকু প্রাপ্তি যোগ হবে, ভেবে দেখতে হবে। কারণ এই যান্ত্রিক শহরে ফাস্টফুডে কামড় দেয়ার পাশাপাশি রুচিশীল দর্শকদের সিনেমা দেখার অভ্যাসটি কিন্তু ‘স্টার সিনেপ্লেক্স’-ই করতে পেরেছে। ভালো ছবি মুক্তি পেয়েছে, অথচ স্টার সিনেপ্লেক্সে চলেনি-আমি অন্তত এমনটি দেখিনি।
সুতরাং অহেতুক আঙুল না তুলে চলুন ভালো সিনেমা নির্মাণ করি। ভালো সিনেমার প্রচার করি। ভালো সিনেমার পরিচর্যা করি। ভালো সিনেমাহলগুলোকে নিজ নিজ জায়গা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করি। প্রতিবাদ কিংবা মানববন্ধন কখনোই ভালো সিনেমার বিকাশে যথার্থ সমাধান নয়। কখনোই নয়।