এখন সম্ভব নয় ‘জীবন থেকে নেয়া’
কয়েকজন নারী আর একটি চাবির গোছাকে নিয়ে গল্পকে মনে হতে পারে একটি সাধারণ পরিবারের গল্প। সে গল্পও হয়ে উঠতে পারে একটি রাষ্ট্রের গল্প। তেমনই একটি চলচ্চিত্র ১৯৭০ সালে নির্মিত জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’। একটি পরাধীন দেশ কিভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়- এটি সেই গল্প। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ছবিটি নির্মিত হয়েছে পরাধীন সময়ে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে কজন তরুন প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে কারাবরন করেছিলেন- জহির রায়হান তাদের একজন। সেই আন্দোলনকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘পোস্টার’ নামে একটি গল্প ও ‘আরেক ফাগুন’ নামের উপন্যাস। ইচ্ছে ছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে ছবি নির্মাণের। সে ছবির জন্য একটি পোস্টারও ডিজাইন করেছিলেন। কিন্তু সরকারের বাধার কারণে তা হতে পারেনি।
১৯৬৯-৭০ সালের দিকে বিহারী প্রযোজক আনিস দোসানি জহির রয়হানকে একটি ছবি বানাতে বললেন। জহির কাহিনি ও চিত্রনাট্যের জন্য ডাকলেন আমজাদ হোসেনকে। জহির জানালেন, ‘এমন একটা গল্প হবে যেখানে এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াবে।’ আমজাদ বললেন, ‘বোন বোনকে বিষ খাওয়াবে! দর্শক কি ব্যপারটা গ্রহণ করবে?’
আমজাদ লিখে ফেললেন প্রথম দৃশ্য। কিন্তু অন্যরকম, এক বোন আরেক বোনকে দুধ-ভাই খাওয়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জহির স্ক্রিপ্ট দেখলেন। দেখেই বললেন, ‘খাওয়াতে বললাম বিষ! আর খাওয়াচ্ছেন দুধ!’ আমজাদ হেসে বলেন, ‘দুধ না খাওয়ালে বিষ খাওয়াবো কিভাবে!’ এরপর আমজাদ যেভাবেই লেখেন না কেন, তা পারিবারিক গল্প থেকে রাজনৈতিক গল্পে চলে যাচ্ছিল। এখানেও আছে আরেকটা গল্প আছে। এর আগে গণঅভ্যুত্থানে আসাদ শহীদ হবার কিছুদিন পর মওলানা ভাসানী তার দলীয় কর্মী আমজাদ হোসেনকে ডেকে আসাদকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি নির্মাণের জন্য বলেন। কিন্তু সরকারি চাপে আসাদের পরিবারের অনুরোধে সে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তিনি জীবন থেকে নেয়ার স্ক্রিপ্ট লিখতে বসে বারবার রাজনীতির গল্পে ঢুকে যাচ্ছিলেন। এক সময় জহির দেখলেন নিজের ইচ্ছেও গল্পটায় ঢুকে পড়ছে। এরপর দুজন মিলে স্ক্রিপ্ট শেষ করলেন।
প্রথমে চলচ্চিত্রটির নাম ঠিক করা হয় ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’। কিন্তু লেখার মাঝামাঝি অবস্থায় একদিন জহির রায়হান নাম পাল্টে রাখলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’।
ছবির কাহিনি দজ্জাল বড় বোন রওশন জামিল, স্বামী খান আতাউর রহমান, দুই ভাই শওকত আকবর ও রাজ্জাক,দুই ভাইয়ের বউ রোজী ও সুচন্দা এবং বাড়ীর চাকর বাকর ও রোজী –সুচন্দার বড় ভাই রাজনীতিবিদ আনোয়ার হোসেনকে ঘিরে। পুরো বাড়িতে দজ্জাল বড় বোন রওশন জামিলের একচ্ছত্র আধিপত্য চলতে থাকা অবস্থায় দুই ভাই বিয়ে করে নববধুদের সংসারে প্রবেশ এবং পরবর্তীতে সংসারের চাবির ঘোছা নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখার কূটকৌশল চরমে পৌঁছে।
ছবির চরিত্র বিশ্লেষনে দেখা যায় রওশন জামিলের চরিত্রটি তৎকালীন স্বৈরশাসক ও একনায়কতন্ত্রের (আইয়ুব খান/ ইয়াহিয়া খান) মুখচ্ছবি। যারা জোর করে বারবার এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। আনোয়ার হোসেন সে সময়ের জনপ্রিয় ও সচেতন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা ও রাজ্জাক প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক। ছবির শেষে দেখা যায় এক নবজাতককে। যার নাম মুক্তি। এ যেন পরাধীন বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা। এর বছর দশেক পরে সত্যজিত রায় নির্যাতনকারী ক্ষমতাসীন সরকারকে ব্যাঙ্গ করে নির্মাণ করেছিলেন রূপকধর্মী ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’।
ছবির একটি অনবদ্য দৃশ্য হল একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরীতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার দৃশ্য। বাস্তব সেই দৃশ্য ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে নেওয়া। চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরীর প্রধান সহকারী অরুণ রায় উঁচু থেকে প্রভাতফেরীর শর্ট নিচ্ছিলেন। আর সহকারী তমাল (কবি জসিমউদ্দীনের ছেলে) নিচ্ছিলেন দূর থেকে যেসব দল এগিয়ে আসছিল শহীদ বেদীর দিকে তার ফুটেজ। এদিকে আফজাল চৌধুরী নিজে ধারণ করছিলেন শহীদ বেদীতে আসা দলগুলোর নগ্ন পায়ে আসা এবং ফুল দেয়ার দৃশ্য। প্রভাত ফেরির একটি দৃশ্যে অবশ্য জহির রায়হান নিজেই উপস্থিত ছিলেন।
হঠাৎ জহির ছুটে গেলেন আফজালের কাছে। গিয়ে বলেন, ‘আমাকে একটু দেখিয়ে দিন তো কিভাবে ক্যামেরায় শ্যুট করতে হয়! আমি নিজে ধারণ করবো।’ তখন আফজাল তাকে শট নিয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা দিলেন। আর জহির মনের আনন্দে শুরু করলেন ভিডিও ধারণ। জহির রায়হান নিজেই একজন এডিটর ছিলেন, ফলে মাথায় এডিটিংয়ের ভাবনা রেখে ধারণ করলেন বেশ কিছু দৃশ্য।
এই ছবি শুটিংকালেই সরকারি নজরদারিতে পড়ে। শুটিংয়ের চলাকালে একদিন এফডিসির ২নং ফোরে আর্মি এসে শুটিং বন্ধ করে দেয়। সকাল দশটায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে গেলেন জহির রায়হান এবং রাজ্জাককে। বিকেল চারটায় ফিরে এলেন তারা। আসার আগে জহির রায়হান বন্ড দিয়ে এলেন, যদি এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার পর দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তবে তার সব দায়ভার তিনি বহন করবেন। শুটিং হলো সাভার, এফডিসি এবং জহির রায়হানের বাড়ির ছাদে। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেল ১০ এপ্রিল ১৯৭০।
ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী ও মেজর মালেক এবং তাদের দোসররা সেন্সর ছাড়পত্র না দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। কারণ তারা বুঝতে পারেন রওশন জামিলের চরিত্রটি একটি স্বৈরাচারের চরিত্র। দেশপ্রেমিক সচেতন দর্শক আগেই তাদের খায়েশ জানতে পেরে মিছিল শুরু করে দেয়। সামরিক সরকার বাধ্য হয় ছবিটি মুক্তি দিতে। কিন্তু মুক্তির প্রথম দিনই সারাদেশে হৈচৈ পড়ে গেল। প্রথম দিনই নিষিদ্ধ হলো প্রদর্শনী। সব সিনেমা হল থেকে আর্মি জব্দ করে নিয়ে গেল সিনেমার রিল। ঢাকার গুলিস্তান হলের সামনে শুরু হলো বিক্ষোভ। পরদিন সেন্সর বোর্ড আবার বসবে সিনেমাটি দেখতে। সাথে থাকবে রাও ফরমান নিজে।
জহির অনেক ভেবে একজনের কথাই স্মরণে আনতে পারলেন, যিনি পারেন ছবিটিকে আবার আলোর মুখ দেখাতে। জহির আমজাদ হোসেনকে দায়িত্বটা দিলেন। কারণ তার এলাকার মানুষ তিনি। আমজাদ গেলেন সেন্সর বোর্ডের সদস্য নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখের কাছে। আমজাদ তার হাটুর কাছে বসে পা টিপতে টিপতে বললেন, ‘স্যার আপনার উপরে সবকিছু। আপনি প্লিজ কালকে যাবেন।’ উনি বললেন, ‘আমি অসুস্থ। হাই প্রেসার তাই যেতে পারবো না।’ আমজাদ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন, ‘স্যার সারাদেশ আপনার দিকে তাকিয়ে।’
পরদিন শাইখ সাহেব গেলেন সেন্সর বোর্ডে। বোর্ডে উপস্থিত অল পাকিস্তান সেন্সর মেম্বার। আমজাদ প্রজেকশন রুমে চুরি করে অবস্থান নিয়ে প্রজেকশনের ছোট ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। রাও ফরমানসহ বাকি সদস্যরা ছবিটি দেখলেন। ছবি শেষে চেয়ারম্যান সাহেব সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কি মনে করে আসকার ইবনে শাইখকে বললেন, ‘আপনি বলেন।’ তিনি, কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর দাঁড়িয়ে বললেন, ‘স্যার পবিত্র কোরআনে কোন মিথ্যে কথা বলা নেই। মিথ্যে কথা বলবার কোন সুযোগও সেখানে দেয়া হয়নি। জহির হয়ত ভুল করে একটা সত্য সিনেমা বানিয়ে ফেলেছে। এই সত্যকে আমি কিভাবে মিথ্যা বলি!’ কেউ আর কোন কথা বলল না। ছবিটি মুক্তি পেল। তবে প্রজেকশন শেষে রাও ফরমান জহিরকে বললেন, ‘ছবিটি ছেড়ে দিলাম। বাট আই উইল সি ইউ।’
এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন খান আতাউর রহমান। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কম্পোজিশন করলেন। এর মাধ্যমে উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্র সংগীতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় এই গানটির মাধ্যমে। অন্যদিকে স্বাধীনতার আগে এটিই ছিল এই গানের প্রথম আনুষ্ঠানিক ব্যবহার। একইভাবে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’সহ একটি বাদে (এ খাঁচা ভাঙ্গব আমি কেমন করে) প্রায় সবগুলো গানেই তিনি করেন আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কম্পোজিশন। এখানে আজ আমরা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ শিরোনামে যে গানটি শুনি এটা কিন্তু ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে খান আতার দেয়া সেই কম্পোজিশনটাই শুনি। গানটি এর আগে একই সুরে গাওয়া হলেও খান আতা সিনেমার জন্য এতে হামিংসহ আরো কিছু আবেগমাখা শ্রুতিমধুরতা যুক্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ছবিটি কলকাতার হলে রেকর্ড ব্যবসা করে। জহির অবাক হয়ে দেখেন ছবিটি দারুন ব্যবসা করছে। কিন্তু এখান থেকে একটা টাকাও জহির নিজে খরচ করেননি। পুরোটাই তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে। সহকারী অরুণ রায় পরবর্তীতে তার চীফ আফজাল চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘সেদিন পকেটে খাবার পয়সা ছিল না, অথচ জহির ভাই সবগুলো টাকা মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে জমা দিয়ে দেন।’ কিন্তু তারাই জহিরকে নিয়ে নানা চক্রান্ত শুরু করেছিল। যেটা শুরু হয়েছিল প্রামণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ তৈরি করার সময়।
জহির রায়হান ও ‘জীবন থেকে নেয়া’ নিয়ে আজো আমরা বড় বড় অনেক কথা বলি। রাজনীতি-চলচ্চিত্রের সম্পর্কে ছবিটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো ক্ষমতাসীনদের অন্যায়-অবিচার নিয়ে এমন ছবি বানানো এখন কি সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর পাঠকরাই দিক।
জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
পরিচালনা ও প্রযোজনা : জহির রায়হান
বণ্টনকারী : আনিস ফিল্ম
কাহিনী ও চিত্রনাট্য : জহির রায়হান ও আমজাদ হোসেন
সঙ্গীত : খান আতাউর রহমান
চিত্রগ্রহণ : আফজাল চৌধুরী
সম্পাদনা : মলয় বন্দ্যোপাধ্যায়
অভিনয়ে : রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন,শওকত আকবর, রোজি সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, বেবি জামান প্রমুখ
…………………………………………………………
*তথ্যসূত্র: পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেট।
কিছু লিখেছিলাম, Pending হয়ে আছে, সমাধান কি? প্লিজ…….
প্রিয় Ehsan Sabir, আপনার পোস্টটি আমাদের নজরে এসেছে। বাংলা মুভি ডেটাবেজ এর ব্লগ সংক্রান্ত মডারেশন নীতিমালার কারণে পোস্টটি প্রকাশিত হয় নি, তবে আপনার পোস্টের বক্তব্যের সাথে আমরা একমত এবং আপনাকে ধন্যবাদ আপনি উদ্যোগী হয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে।
আপনি হয়তো খেয়াল করে দেখবেন বাংলা মুভি ডেটাবেজ এ অনেক ব্যক্তিরই ছোট বায়োগ্রাফি সংযোজন করা হয়েছে। আমাদের চেষ্টা আছে সকলেরই বায়োগ্রাফি পাতা তৈরী করা। এ ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে যদি সহায়তা করতে চান তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের ইমেইলে যোগাযোগ করুন। [email protected]
ধন্যবাদ।
tnx a lot. i’ll send u mail asap.
tnx again.