এটিএম ছাড়া ছবি জমে না!
বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘চিত্রালী’-র একটি সংখ্যায় লিজেন্ডারি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান-কে নিয়ে একটি কভার স্টোরিতে শিরোনাম করা হয়েছিল-‘এটিএম ছাড়া ছবি জমে না।’ এটিএম থাকা মানেই ফাটিয়ে অভিনয় করা। নায়ক-নায়িকার ক্রেজ যতই থাক না কেন দর্শক এটিএমকে নিত বিশেষভাবে তাই তিনি ছাড়া যেন ছবি জমত না। এটা যে শুধুই সেই রাজ্জাক-শাবানাদের সময়ে ঘটত তা কিন্তু নয় তিনি ছবি জমিয়ে তুলতেন নিজের ক্যারিয়ারের শেষের দিকের ছবিগুলোতেও। তিনি থাকা মানেই পর্দা আলোকিত হওয়া।
দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে একজন এটিএম শামসুজ্জামান রাজ্জাক আমল থেকে শুরু করে বর্তমান শীর্ষ নায়ক শাকিব খান পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। নায়কের ভেতর থেকেও তিনি জ্বলে উঠতেন পর্দায় আপন শক্তিতে।
এটিএম শামসুজ্জামান একমাত্র অভিনেতা যিনি অনেককিছুর কম্বো ছিলেন। ভিলেনের অভিনয় করলেও তার সাথেই কমেডি করতেন একই সময়ে। তাঁর অভিনয়ে একই সাথে ভয়ঙ্করের পাশাপাশি বিনোদিতও হত দর্শক। আবার ভালো মানুষের ক্ষেত্রেও যেন হয়ে যেতেন মাটির মানুষ।
ধরা যাক নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত ‘জিনের বাদশা’ ছবির কথা। এ ছবিতে এটিএম ভিলেন। ভিলেজ পলিটিক্সের চর্চা করা চেয়ারম্যান তিনি। নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যা করার তিনি করেন। কূটবুদ্ধির এটিএম বাপ্পারাজের বিপক্ষে কঠিন হয়ে ওঠেন আবার সেই এটিএমই জিনের বাদশার সামনে কাঁপতে থাকেন, ছাগলের চামড়ায় কঙ্কাল আঁকা দেখে আঁতকে ওঠেন তখন তাঁর বডি ল্যাংগুয়েজে দর্শক হাসে। ‘মোল্লাবাড়ির বউ’ ছবির কথাই ধরুন। রিয়াজ, শাবনূরের কমেডির পাশাপাশি ছবির নামকরণের প্রধান চরিত্রে মোল্লার ভূমিকায় এটিএম শামসুজ্জামান যে কমেডি করেছেন এটা শুধু তাঁর দ্বারাই সম্ভব। রিয়াজকে প্যান্ট-শার্ট পরতে দেখা এটিএমের অভিনয় কিংবা মিষ্টি কিনে আনার পর রিয়াজ যখন তাঁর মুখে মিষ্টি ছড়িয়ে দেয় ছানা মিক্স আছে বলে ঐ সময় এটিএম অসাধারণ। ‘হাজার বছর ধরে’ ছবিতে সিরিয়াসনেসের পাশাপাশি তাঁর কমেডিও ছিল দারুণ। টুনি চরিত্রে শশীর বুদ্ধিমতো যখন আম্বিয়াকে বিয়ে করার প্রস্তাবে এটিএম রাজি হন টুনির সাথে তাঁর খুনসুটি ছিল দেখার মতো। ‘ভণ্ড’ ছবিতে বিশ বছরের মুরগি চুরির অভিজ্ঞতায় চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর এটিএমের অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘ভণ্ড’-র পাশাপাশি ‘মনে পড়ে তোমাকে, পাগলা ঘণ্টা’ ছবিতে হুমায়ুন ফরীদির সাথে তাঁর কমেডি অনবদ্য। ‘জামাই শ্বশুর’ ছবিতে রাজিবের বাবার চরিত্রে এটিএমের কমেডি ছবি মাতিয়ে তুলেছিল বিশেষ করে বদমেজাজি ছেলে রাজিবের সামনে এটিএমের চুপসে যাবার অভিনয় মজার ছিল। ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ ছবিতে রিয়াজকে ধোলাই দেয়ার পরিকল্পনা করলে নিজেই উল্টো ধোলাই খান এটিএম। বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে যান রীনা খানের সামনে। তখন তার গেটআপ ছিল ভীষণ মজার। ‘ভালো মানুষ’ ছবিতে তিনি নেগেটিভ ছিলেন একদম অন্যভাবে। মানব পাচারের সাথে তাঁর যোগাযোগ থাকে। সমুদ্রের ধারে এক মহিলাকে দেখে বলেন-‘একা নাকি?’ এই সংলাপটি তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর অঙ্গভঙ্গি ছিল মারাত্মক লেভেলের মজাদার। ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে হ্যাংলা পাতলা গড়নের রাজাকারের চরিত্রটি ছিল কমেডিতে ভরা। কমেডিতে তিনি এতই অসাধারণ যে তাঁর ছবিতে তিনিই রাজা। যে ছবিতে এটিএম থাকত কমেডির জন্য দিলদার না থাকলেও চলত সে ছবিতে।
একদম ভয় পাইয়ে দেয়া পুরোদস্তুর ভিলেন এটিএম পর্দা কাঁপিয়ে পুরোপুরি বদলে যেতেন। ‘চাঁদনী রাতে’ ছবির ফোকাস এটিএম একাই অর্ধেকের বেশি নিয়ে নেন আনপ্যারালাল ভিলেনে। ‘চেতনা’ ছবির লোকাল গুণ্ডার চরিত্রটি ভয়ানক। শিক্ষক আলমগীর যখন সমুদ্রের তীরে এটিএমের মুখে থু থু ছিটায় সাথে সাথেই তাঁকে ছুরি বসিয়ে খুন করেন। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। ‘ঘৃণা’ ছবিতে হুমায়ুন ফরীদির ডানহাত থাকেন তিনি। রুবেল যখন পরিকল্পনা করে ভাতে বিষ মেশায় আর এটিএমকে ফাঁসিয়ে দেয় ঐসময় এটিএমের বিষ খেয়ে মৃত্যুর সময়টা জাস্ট মাইন্ডব্লোয়িং ছিল। ‘বদসুরত’ ছবিতে তাঁর ভিলেন গেটআপ ছিল অন্যতম সেরা। ‘স্বপ্নের নায়ক’ ছবিতে সালমান শাহকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেন এবং এ ছবিতেও তিনি দুর্দান্ত ভিলেন। ‘মোল্লাবাড়ির বউ’-তে শাবনূরকে খুন করার পরিকল্পনা করে দা হাতে যখন দাঁড়িয়ে যায় তার সামনে ঐসময়ও এটিএম ভয়ঙ্কর। একই ছবিতে তাঁর কমেডি ইমেজ যে কত বিনোদনমূলক ছিল সেটা তখন যেন বিপরীত কিছু হয়ে যায় এত গভীর ভেরিয়েশন তাঁর অভিনয়ে। ক্যারিয়ারের শেষের দিকে ‘চোরাবালি’ ছবিতে শহীদুজ্জামান সেলিমের নেতার চরিত্রে এটিএম কুল ভিলেন ছিলেন। তাঁর অভিনয় ভিন্ন রকমের মজা দিয়েছে দর্শককে এবং তিনি শেষের দিকেও প্রমাণ করেছেন যে তিনি আনপ্যারালাল।
একদম নিখাদ ভালোমানুষের চরিত্রেও এটিএম শামসুজ্জামান নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ছবি ‘দায়ী কে’-তে তিনি যে অভিনয় করেছেন তাকে কোনোভাবেই ভিলেন ও কমেডির সাথে মেলানো যাবে না। মনে হবে তিনি শুধুই ভালো মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ছবিতে ক্যানভাসার চরিত্রে ছিলেন। তাঁর মাকে তাঁর বাবা ঠকিয়েছেন তাই তাঁর লক্ষ্য থাকে বাবাকে খুন করা এবং শেষে তাই হয়। ছবির শেষে ফাঁসির আদেশের পর আদালতে ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষের ছেলের পা ধরে এটিএমের সংলাপটি ছিল ধারালো। বলেন-‘জীবনভর মানুষের লাত্থি গুতা খাইয়া আসছি আজ শ্যাষ লাত্থিটা তুই দে।’ এমন সংলাপ সম্ভবত আর কারো ছবিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য এ ছবিতে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানে হ্যাংলা গড়নের সেই এটিএমের দেয়া স্যাড এক্সপ্রেশনগুলো তাঁকে নিখাদ ভালো মানুষের চরিত্রে অনবদ্য করে তোলে। ‘ডাক্তারবাড়ি’ ছবির আদর্শবাদী সেই মানুষটি যে নিজের ভাইদের গ্রামের মানুষের চিকিৎসার জন্য কাজে লাগাতে চায় কিন্তু তারা যখন বেশি ফিসের লোভে শহরে যেতে চায় এটিএম তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। আদর্শবাদী সেই চরিত্রটি অন্যতম সেরা পজেটিভ চরিত্র তাঁর। ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ, চণ্ডিদাস রজকিনী’ ছবিগুলোতে এটিএম নিজের অভিনয়শক্তিতে ছবির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠেন। ডিজিটাল আমলের ‘লালটিপ, আইসক্রিম’ ছবিতেও তিনি টাচি চরিত্রে নিজেকে অসাধারণ করে তোলেন।
তো এতক্ষণ যা বলা হলো এবার আপনারা পাঠকরা মিলিয়ে দেখুন তো প্রায় পাঁচ দশকের বিশাল ক্যারিয়ারে একজন এটিএম শামসুজ্জামান তাঁর লিজেন্ডারি ইমেজে বিচিত্র সব চরিত্রায়ণে যা রেখে গেছেন তাতে কি মনে হয় না এটিএম ছাড়া ছবি জমে না!
ছবি জমানোর সে কারিগর আজ চলে গেলেন। তাঁর চলে যাবার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রজন্মের শেষ অভিভাবককেও হারালো দেশের চলচ্চিত্র এবং নিঃস্ব হবার পথে পুরোপুরি এগিয়ে গেল।