Select Page

‘… এরপর রাজ্জাকের নায়িকা হিসেবে তোমাকে মেনে নেবে না’

‘… এরপর রাজ্জাকের নায়িকা হিসেবে তোমাকে মেনে নেবে না’

মাত্র স্বাধীন হওয়া দেশটি তখনো ঠিকঠাকভাবে গড়ে ওঠেনি। বিপর্যস্ত দেশটিতে তখন আলোর সন্ধানে মুক্তিকামীরা লড়ছে। আশপাশে অভাব-অনটন, দারিদ্র্য যখন গ্রাস করছে, ঠিক তখনই দেশের মধ্যে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কালোবাজারি ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হতে লাগল। সমাজের সুবিধাবাদী, লোভী মানুষেরা শুধু নিজের ক্ষমতা, বিত্তবৈভব ও প্রভাব–প্রতিপত্তির জন্য দেশের সর্বনাশ করার চেষ্টায় থাকল। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ চিত্র—এই সবকিছু নিয়েই ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘চলচ্চিত্র ‘আলোর মিছিল‘।

আলো নামের একটি মেয়ের মৃত্যুতে সিনেমার কাহিনি শেষ হয়। এই দুঃখ–কষ্টের কাহিনি আর সংলাপের বুননে ছিলেন ইসমাইল মোহাম্মদ। মাতৃ–পিতৃহীন আলো নামের মেয়েটি মামাবাড়িতে মানুষ। দাদু, মামা-মামি সবার কাছে সে বড় প্রিয়। সে গান জানে, নাচ শেখে। সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া কালজয়ী গান, ‘এই পৃথিবীর পরে/ কত ফুল ফোটে আর ঝরে/ সে কথা কি কোনো দিন/ কখনো কারও মনে পড়ে’। ববিতা পর্দায় ঠোঁট মেলান।

‘আলোর মিছিল’ ছবিতে রাজ্জাক ও ববিতাকে মামা-ভাগনি চরিত্রে দেখা গেছে। তবে এর আগে রাজ্জাকের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন তিনি। তবে ববিতার শুরুটা হয়েছিল সংসার ছবিতে রাজ্জাকের মেয়ের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। পরে বেশ কয়েকটি ছবিতে রাজ্জাক-ববিতা জুটি হিসেবে জনপ্রিয় হন। প্রতিষ্ঠিত রোমান্টিক জুটিকে নারায়ণ ঘোষ মিতা পর্দায় উপস্থাপন করলেন অন্যভাবে।

ছবির গল্পে দেখা যায়, মামা-মামি ও সদ্য প্রেমে পড়া হাফ ইঞ্জিনিয়ার যুবকের সোহাগে-আদরে; পড়াশোনা, নাচ–গানের অনুশীলনে ভালোই চলছিল আলোর জীবন। কিন্তু যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে কেরানি বড় মামা আলিমের (খলিলউল্লাহ খান) হঠাৎ বড়লোক হওয়ার বাসনায় কালোবাজারি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। রাতারাতি লাখ লাখ টাকার মালিক হন। বদলে যায় বাড়ির পরিস্থিতি। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ নষ্ট হয়ে যায়। ছোট মামা রানা (রাজ্জাক) বিদেশ থেকে ফিরে বাকি পড়াশোনা ও ভালো চাকরিতে মন না দিয়ে দেশের কাজে যুক্ত হয়। এই কাজে তাকে উৎসাহিত করে আলিমের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শহীদ আশরাফ (আনোয়ার হোসেন)। দেশ অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটি ১৯৬৯ সালে লড়াকু ছাত্রনেতা থেকে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু দেশ স্বাধীন করার পরও নিজের জীবনে সচ্ছলতা ভোগ-সুখ-পরিবর্তন কিছুই আসেনি। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার সংগ্রামে আপসহীন। কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই-সংগ্রামের পথে রানার মতো ছাত্র-যুবদের অনেককে পাশে পেয়ে যায়।

এ সিনেমায় অভিনয় ও রাজ্জাকের সঙ্গে রসায়ন প্রসঙ্গে ববিতা জানান, খুব সম্ভবত ১৯৭৩ সালে ছবিটির শুটিং করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার বয়স তখন ১৭ বছর হবে। গেন্ডারিয়াতে থাকতাম। ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে মিতা সাহেব বাড়িতে এলেন। গল্প বললেন। শুনে এত ভালো লাগল যে বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু পরিবার, শুভাকাঙ্ক্ষী ও চলচ্চিত্রের সবাই বলতে লাগল, তুমি রাজ্জাকের নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছ। ‘টাকা আনা পাই, ‘পিচ ঢালা পথ’ ও ‘শেষ পর্যন্ত’  সুপার ডুপার হিট হয়েছে, সেখানে কেন তুমি রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে মামা-ভাগনির চরিত্রে অভিনয় করছ? ছবিতে নায়ক-নায়িকা রাজ্জাক ভাই ও সুজাতা ম্যাডাম। এই ছবিতে তুমি যদি ভাগনি হও, এরপর ওই ছবিতে নায়িকা হিসেবে থাকলে কেউ তোমাকে রাজ্জাকের নায়িকা হিসেবে মেনে নেবে না। সবার কথা শুনেছি, যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা, তখন ভাবলাম—এই ছবিটা আমার করা উচিত। কারণ, এটা অসাধারণ দেশাত্মবোধের ছবি।’

কথায় কথায় ববিতা বললেন প্রথম দিনের শুটিংয়ের কথা। বললেন, ‘আমার বেশির ভাগ অংশের শুটিং হয়েছিল এফডিসিতে। খুব সম্ভবত এক নম্বর ফ্লোরে প্রথম দিন কাজ করেছি। সেট বানিয়ে বাড়ির সব দৃশ্য ধারণ করা হয়। ছবির শুটিংয়ে আমি যখন শট দিতে গিয়েছি, দেখতাম, চোখে কোনো গ্লিসারিন দিতে হতো না। এমনভাবে দৃশ্য বুঝিয়ে দিতেন, চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ত।’ প্রথম দিন কোন দৃশ্যের শুটিং করেছেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘নিচতলা থেকে দোতলায় ট্রেতে করে চা নিয়ে যাওয়ার একটা দৃশ্য ছিল। সবাই ঘুমাচ্ছিল, প্রত্যেককে ডেকে ডেকে ঘরে চা দিচ্ছি।

একবারেই শটটি ওকে হয়।’ এই ছবির জন্য শাস্ত্রীয় নৃত্যও শিখতে হয়েছিল বলে জানালেন। মুক্তির পর ছবিটি মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহে ভাইবোনসহ পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে উপভোগ করেছিলেন বলেও জানালেন। ববিতা বললেন, ‘বোরকা পরে দেখতে গিয়েছিলাম। আমার মারা যাওয়ার দৃশ্যে, ওভারলেপে একটা সংলাপ ছিল, “মামা যাসনে।” এদিকে রাজ্জাক ভাই বলছেন, ভাবি, আমাকে বিদায় দাও, আলোকে কবরস্থানে নিয়ে যেতে হবে। মাটি দেওয়া হবে। “মামা যাসনে” সংলাপ বলার পর হলের সবাই হাউমাউ করে কেঁদেছে।’

‘আলোর মিছিল’-এ রাজ্জাকের প্রেমিকা দিনা চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি বললেন, ‘এই সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে আমি খুব তৃপ্ত ছিলাম। নারায়ণ ঘোষ মিতা অনেক বড়মাপের পরিচালক ছিলেন। বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী এই ছবিতে অভিনয় করেন। আজিম সাহেবের পর রাজ্জাকের সঙ্গে আমার বেশ কিছু সিনেমা হিট হয়। ‘আলোর মিছিল’ও সেই রকম সফল একটি সিনেমা। মজুতদার বাবার বিরুদ্ধে আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। এ ছবিতে ববিতাও অভিনয় করেছে। দুই নায়িকা কাজ করলে নাকি প্রতিযোগিতা হয়, তেমন কিছুই ছিল না আমাদের মধ্যে। ও আমার জুনিয়র, শুটিংয়ে তাই স্নেহ করতাম।’

এ ছবির বিখ্যাত ‘এ পৃথিবীর পড়ে কত ফুল ফোটে আর ঝরে’ সম্পর্কে সাবিনা ইয়াসমীন জানান, তখন একের পর এক চলচ্চিত্রে গাইছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সত্য সাহার কাছ থেকে এই গানটি গাওয়ার প্রস্তাব পান। এফডিসির স্টুডিওতে এই গানে কণ্ঠ দেন বলে জানালেন। সেদিন স্টুডিওতে সত্য সাহা ছাড়াও পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা ছিলেন। বললেন, ‘গানটি খুব বেশি পছন্দের ছিল। দাদাকে এ কথা বলার পর তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। অন্য রকম গান। কথাগুলো দারুণ। সুর তো ভীষণ প্রেমময়। গানের কথা-সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছিল। সুরের সঙ্গে মিলে স্বপ্নের মতো একটা আবহ তৈরি করেছিল। আর সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে পড়ে তো আরও অপূর্ব হয়ে উঠেছিল।’

১৯৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়া ‘আলোর মিছিল’-এর চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছে নারায়ণ ঘোষ মিতা। প্রযোজনায় ছিল ঝর্ণা পিকচার্স। কাহিনি ও সংলাপ ইসমাইল মোহাম্মদ, চিত্রগ্রহণ রফিকুল বারী চৌধুরী। মুস্তাফিজুর রহমানের গীত রচনা ও সত্য সাহার সংগীতে কণ্ঠ দেন আবদুল জব্বার, সাবিনা ইয়াসমীন ও খন্দকার ফারুক আহমেদ। নৃত্য পরিচালনা গওহর জামিল। পরিবেশনায় ছিল চিত্রলোক।

*আলোর মিছিল মুক্তির ৫০ বছর উপলক্ষে গত ২৫ জানুয়ারি বিশেষ একটি লেখা প্রকাশ করে প্রথম আলো। লিখেছিলেন মনজুর কাদের। বিএমডিবির আর্কাইভিংয়ের সুবিধার্থে কিছুটা অদল-বদল হলেও লেখাটি মূলত সেই প্রতিবেদনই।


Leave a reply