এ দেশ তোমার আমারের নায়িকা সুমিতা দেবী
আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের রয়েছে একটি অসাধারণ যুগ যার শুরু হয়েছিল সেই সূচনালগ্ন থেকে আর শেষ হয় ৯০ দশকের শেষ দিকে যা আমি আমার বিভিন্ন লিখায় আপনাদের কাছে তুলে ধরেছিলাম।
মূলধারার বাণিজ্যিক বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে জীবনের লম্বা একটি সময় আমার কেটেছে যার মাঝে পেয়েছিলাম অনেক অনেক আনন্দ ও সুখ। সেই সুখের পরিমাণটা এতো বেশি ছিল যে যা আজো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই সুখ স্মৃতি থেকে আজ আপনাদের জন্য আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের একজন গুণী পরিচালক প্রয়াত এহতেশামের সূচনা লগ্নের একটি অসাধারণ ছবি ‘এ দেশ তোমার আমার’ নিয়ে একটু আলোচনা করবো। ছবির কথায় যাওয়ার আগে পরিচালক এহতেশাম নিয়ে কিছু কথা বলে নিচ্ছি।
এহতেশাম হলেন মূলধারার বাণিজ্যিক বাংলা চলচ্চিত্রের একজন অসাধারণ পরিচালক এবং অনেক কিংবদন্তির গুরু যাকে ৯০ দশকের চলচ্চিত্রের তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ‘দাদু’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি ছিলেন সর্বদা একজন পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক যিনি কোনদিন পুরস্কার লাভের আশায় ছবি বানাতেন না। তাঁর হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রে আগমন হয়েছিল শবনম, শাবানা, শাবনাজ, নাঈম, শাবনুরের মতো রথী-মহারথীরা উঠে এসেছেন যাদের অনেকেই হয়ে গেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি।
১ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় নির্মিত ও এহতেশাম পরিচালিত ছবিটির নাম ‘এ দেশ তোমার আমার’। প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনিস (খান আতাউর রহমান) ও সুমিতা দেবী। এ ছাড়া অভিনয় করেছেন রহমান, মাধুরী চ্যাটার্জী, সুভাষ দত্ত, দাগু বর্দ্ধন, স্বপ্না, সুলবান, মেজবাউদ্দিন, বাদশাহ্, গোপাল দে, জহীর চৌধুরীসহ অনেকে। ছবিটি নির্মিত হয়েছিল তৎকালীন দুই পাকিস্তানের নেতা কায়েদ আজম জিন্নাহর একটি ভাষণের দুটি লাইনকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে যা ছিল—
“একটি ঐক্য ও শৃংখলাবদ্ধ জাতি হিসেবে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আজ আমাদের সবার মধ্যে থাকা প্রয়োজন গঠনমূলক প্রেরণা।আজাদী লড়াইয়ের সময়কার উগ্রমনোবৃত্তি আজ পরিহার করতেই হবে।” (উইকিপিডিয়া) অর্থাৎ দেশ গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার এই আহবান পৌঁছে দেয়াই ছিল ছবিটির মূল বক্তব্য। ছবির গল্পে নায়িকা শাহানা (সুমিতা দেবী) কাপাশতলী গ্রামের জমিদার কন্যা যার পিতা আজিজ সাহেব মারা যাওয়ার পর জমিদার চাচার কাছেই বেড়ে উঠেছেন এবং যিনি পিতার মতোই একজন পরোপকারী। শাহানা ভালোবাসে গ্রামের সাধারণ ঘরের ছেলে সংগ্রামী হারুন (আনিস/খান আতাউর রহমান)-কে। শাহানা ও হারুন ভালোবাসার মাঝেও গ্রামের যেকোনো সংকটে দুজন মিলে গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়াতো যা শাহানার জমিদার চাচা পছন্দ করতেন না। তারপরও ওরা দুজনে মিলে সবসময় যেকোনো সংকটে গ্রাম ও গ্রামের মানুষের পাশে থাকতে চায় যা নিয়ে চাচা ভাতিজীর মাঝে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এর মাঝে একদিন হুট করে বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি প্রবেশ করতে থাকে। হারুন গ্রামের সবাইকে একত্রিত করে নতুন বাঁধ দিতে চাইলে- শাহানার চাচা জমিদার ও তার খাস চামচা কানুলাল বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে বাঁধের কাজে বাধা দেয়। পরিশেষে সততা ও জনতার দুই শক্তি মিলিত হয়ে সব বাধা অতিক্রম করে নতুন বাঁধ দিয়ে গ্রামকে রক্ষা করে সবাই।
ছবিটির গীত ও সঙ্গীত করেছিলেন খান আতাউর রহমান। এম কাহিনী ও চিত্রনাট্য ছিল এহতেশামের। ছবিটির প্রযোজনা সংস্থা ছিল ‘লিও ফিল্মস’ এবং প্রযোজক ছিলেন বি এম খান। দেশের জন্য কীভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয় সেই শিক্ষাটাই এই ছবিটি থেকে পাবেন যা সকলের দেখা উচিৎ।
এতক্ষণ যে ছবির গল্পটি আপনাদের বললাম এবার সেই ছবিতে শাহানা চরিত্রে অভিনয় করা মানুষটির গল্প বলবো যিনি ছিলেন আমাদের বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের একজন কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুমিতা দেবী।
সুমিতা দেবী (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ – ৬ জানুয়ারি ২০০৪): তার প্রকৃত নাম হেনা হেনা ভট্টাচার্য্য। ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে মানিকগঞ্জ জেলার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে সুমিতা দেবী ঢাকায় চলে এলেন। এসেই বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে ১৯৫১ সালে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে কিছুদিন ছিলেন, এরপর কলকাতায় ফিরে আসতেই সুমিতা দেবীর বিয়ে হয়ে গেল অতুল লাহিড়ির সঙ্গে। হেনা ভট্টাচার্য্য থেকে হয়ে গেলেন হেনা লাহিড়ি। অবশ্য এ বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
৫০ এর দশকের শেষ দিকে প্রখ্যাত পরিচালক ফতেহ লোহানি’র ‘আসিয়া’ ছবির নাম ভুমিকায় অভিনয় করে চলচ্চিত্রে আগমন করেন। তবে এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় তার নায়িকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে এ ছবিতে তার অভিনয় করা সম্ভব হয়নি। পরে ওই চরিত্রটি করেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে তৃপ্তি মিত্র। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম দিকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের কারণে তাঁকে বলা হতো ‘ফার্স্ট লেডি’। তবে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবির নাম এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিটি যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯ সালে এবং এর পর মুক্তি পায় ফতেহ লোহানির ‘আকাশ আর মাটি’। ‘আসিয়া’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। এ ছবিতে সুমিতা ছিলেন নাম ভূমিকায়, নায়ক ছিলেন শহীদ। ছবিতে তার প্রেমিক শহীদ। কিন্তু ছবির কাহিনী অনুযায়ী শহীদের চাচা কাজী খালেকের সঙ্গে সুমিতার বিয়ে হয়। প্রেমিকা সুমিতা হয়ে গেলেন প্রেমিক শহীদের চাচী। এটা দুজনে মেনে নিতে পারেননি। যে কারণে দুজনের সহমরণের মাধ্যমে ছবির কাহিনী সমাপ্ত হয়। ‘আসিয়া’তে অসাধারণ অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন এবং ছবিটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে।
সুমিতা দেবীর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো সোনার কাজল (১৯৬২, নায়ক খলিল), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩, নায়ক আনোয়ার হোসেন), এই তো জীবন (১৯৬৪, নায়ক রহমান), দুই দিগন্ত (১৯৬৪, নায়ক আনোয়ার হোসেন), ধূপ ছাঁও (১৯৬৪, নায়ক এজাজ), জনম জনম কি পিয়াসি (১৯৬৮), সঙ্গম (১৯৬৩, নায়ক খলিল), অশান্ত প্রেম (১৯৬৮, নায়ক হায়দার শফী)। উল্লেখ্য যে ‘ধূপ ছাও’ (উর্দু) তার নায়ক এজাজ ছিলেন গায়িকা নুরজাহানের স্বামী। এ ছাড়া তিনি ৫টি ছবি প্রযোজনা করেন— আগুন নিয়ে খেলা, মোমের আলো, মায়ার সংসার, আদর্শ ছাপাখানা ও নতুন প্রভাত।
সুমিতা দেবী তার চলচ্চিত্র জীবনে প্রায় চার দশক কাল সময় অতিবাহিত করেছিলেন। নায়িকার প্রধান চরিত্রে অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১২টি। বাংলা ছবির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উর্দু ছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। শতাধিক চলচ্চিত্রে সহ-নায়িকা কিংবা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৫৯ সালের শেষদিকে ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে জহির রায়হানের সঙ্গে তার পরিচয় গাঢ় হয়, যদিও ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবির প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির। তারা একে অপরকে মন দিয়ে বসলেন। তারপর দুজনে গোপনে কোর্টে গিয়ে ১৯৬১ সালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।সুমিতা দেবী পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত হন ও তার নতুন নামকরণ হয় নিলুফার বেগম। তাদের ৭ বছরের সংসার জীবনে দুটো পুত্র সন্তান জন্ম নেন যারা হলেন অনল রায়হান ও বিপুল রায়হান। ১৯৬৮ সালে জহির রায়হান অভিনেত্রী সুচন্দাকে বিয়ে করলে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়।
মঞ্চ, বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ সুমিতা দেবী বেশ কয়েকবার পুরস্কৃত হয়েছিলেন। যার মধ্য উল্লেখযোগ্য হলো– পাকিস্তান সমালোচক পুরস্কার, নিগার পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, আগরতলা মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার, চলচ্চিত্র ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, বাংলাদেশ টেলিভিশন রিপোর্টারস সমিতি পুরস্কার, জনকণ্ঠ গুণীজন ও প্রতিভা সম্মাননা। ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি এই গুণী ও প্রবীণ অভিনেত্রী মৃত্যুবরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি অধ্যায়। পরিশেষে বলতে হবে সুমিতা দেবী শুধুই একজন অভিনেত্রী ছিলেন না, ছিলেন আমাদের নাটক ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসের শুরু থেকে দীর্ঘ ৫ দশকের একটি জীবন্ত অধ্যায় ও কালের এক নীরব সাক্ষী যাকে আমরা সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। এমন একজন নিবেদিত, গুণী একজন অভিনেত্রী আমরা আর কবে পাবো জানি না।