কবিতার কথা
‘কবিতা তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না’- ভাবছেন নগর বাউল গুরু জেমসের গান শোনাতে আসলাম! নাহ, শোনাতে আসলাম আমাদের চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য এক নায়িকার কথা। কবিতার কথা।
কবিতা আমাদের চলচ্চিত্রের আশি-নব্বই দশকের একজন ব্যস্ত নায়িকা। তার মধ্যে আহামরি কোনো সৌন্দর্য না থাকলেও অসাধারণ অভিনয়গুণ ছিল। তার সময়ের ব্যস্ত নায়কদের সাথেই কাজ করেছে। বাণিজ্যিক ছবির মধ্যেই রোমান্টিক, ফ্যামিলি ড্রামা, স্যাড, ফোক এরকম অনেক ক্যাটাগরিতে নিজেকে প্রমাণ করেছে।
কবিতা-কে বলা হত জসিমের বোন আর রুবেলের নায়িকা। বেশকিছু ছবিতে জসিমের বোন ছিল। রুবেলের নায়িকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাদের জুটির রসায়নও জমত বেশ।
কবিতা অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি : চিরশত্রু, ননদ ভাবী, মাস্তান রাজা, সম্পর্ক, আজাদ, আন, মূর্খ মানব, জজ সাহেব, লিনজা, মিথ্যার রাজা, সন্ত্রাসী নায়ক, লাওয়ারিশ, অর্জন, মৃত্যুদণ্ড, গরীবের বিচার নাই, আজকের হিটলার, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, আখেরি মোকাবেলা, সিপাহী, ত্রাস, পারলে ঠেকাও, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী রাজা, জেলের মেয়ে রোশনী, বাঁশিওয়ালা, রাজা গুন্ডা, বিশ্বহারামী, এতিম রাজা, শংখমালা, অচিন দেশের রাজকুমার, প্রেম সোহাগী, মাতৃভূমি, গর্জন, গাড়িয়াল ভাই, আমি সেই মেয়ে, বাপ বেটা ৪২০, চাকর, দাঙ্গারাজা, ডিসকো বাইদানী, শক্তি পরীক্ষা, বীর পুরুষ মহাগুরু, ডন, মায়ের কান্না, ইনকিলাব, গোলা বারুদ, দুর্নীতিবাজ, রুবেল আমার নাম, মহাশত্রু, পুষ্পমালা, বাঘা বাঙালি ও টাইগার।
জসিমের বোনের চরিত্রে ছিল চিরশত্রু, রাজা গুণ্ডা, টাইগার, আখেরি মোকাবেলা, গর্জন ছবিগুলোতে। জসিম-কবিতার ভাইবোনের অভিনয় দেখে মনে হত তারা সত্যিকারের ভাইবোন। তাদেরকে দেখে দর্শক হিশাবে বারবার শ্রদ্ধা জাগত আমাদের বাস্তব জীবনের ভাই-বোনদের চিরন্তন সম্পর্কের কথা। আমরা আমাদের ভাইবোনদের কতটা ভালোবাসি ফিল করতাম। ‘টাইগার’ ছবিতে কবিতাকে কিছুটা স্টাইলিশ দেখা গেছে।
রুবেলের নায়িকা কবিতা। তার বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ছবি করেছে। ছবিগুলো ছিল অর্জন, মূর্খ মানব, আন, আজাদ, মিথ্যার রাজা, লাওয়ারিশ, মৃত্যুদণ্ড, গরিবের বিচার নাই, আজকের হিটলার, বীরপুরুষ, ডন, মহাগুরু, মায়ের কান্না, ইনকিলাব, মহাশত্রু, রুবেল আমার নাম, দুর্নীতিবাজ, মৃত্যুর সাথে পাণ্জা ইত্যাদি। এ জুটি অন্য আর দশটা জুটির মতোই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সফল জুটি ছিল।
রুবেলের বিপরীতে কবিতার জনপ্রিয় গান:
কাছে আসতে আসতে এত কাছে এসেছি – অর্জন
মাটি কাটা কন্টেকদার লজ্জা শরম নাই যে তার – আজকের হিটলার
মূর্খ মানব প্রেম বোঝে না – মূর্খ মানব
বাপ্পারাজ-কবিতাও জুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাদের অন-স্ক্রিন কেমিস্ট্রি ভালো ছিল।
মান্নার বিপরীতে ত্রাস, মাতৃভূমি, পারলে ঠেকাও, এতিম রাজা, সিপাহী ছবিগুলোতে ছিল। ‘ত্রাস’ কবিতার উল্লেখযোগ্য ছবি। ক্যাম্পাস পলিটিক্সের মধ্যে ছাত্রনেতা কাবিলা কবিতাকে কলেজ মাঠে অসম্মান করতে চেষ্টা করলে মান্না কাবিলাকে মারধর করে। কবিতাকে সেভ করার মধ্য দিয়েই ছবিতে নোংরা ছাত্র-রাজনীতির বিরুদ্ধে মান্নার প্রতিবাদী ইমেজ শুরু হয়। এ ছবিতে মান্নার সাথে মজার একটা সংলাপ আছে কবিতার। মান্নাকে পেছন থেকে ডাকলে শোনে না। মান্না খুব জোরে হাঁটছিল এটা দেখে কবিতা বলে- ‘তুমি তো জিরাফের মতো লম্বা, তোমার সাথে হেঁটে পারি!’…:-D ছবিতে ‘একতা শান্তি শৃঙ্খলা জ্ঞানের পথে এগিয়ে চলা’ গানটিতে কবিতাও আছে। অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো গান।
‘পারলে ঠেকাও’ ছবিতে মান্নার মৃত্যুর পর বিশেষ ব্যবস্থায় যন্ত্রমানব মান্নাকে তৈরি করা হলে কবিতা তাকে চিনতে পারে না প্রথমে, অনেক ঘটনার পরে চিনতে পারে। এনজয় করার মতো ছবি ছিল।
ফোক কালচারে নির্মিত বাঁশিওয়ালা, অচিন দেশের রাজকুমার, গাড়িয়াল ভাই, জেলের মেয়ে রোশনী, প্রেম সোহাগী ছবিগুলোতে অসাধারণ পারফর্ম করেছে কবিতা। রাজা-বাদশাহর গল্পের ছবিতে চাকচিক্যের পোশাকে যেমন দেখা গেছে তেমনি দেখা গেছে নিম্নবিত্তের দিন এনে দিন খাওয়া চরিত্রেও। জেলের মেয়ে হয়ে নৌকা বাইতেও দেখা গেছে। ‘বাঁশিওয়ালা’ ছবিতে মিঠুনের বিপরীতে ‘ভালোবাসি বলে রে বন্ধু আমায় কাঁদালে’ গানটিতে কবিতা অসাধারণ ছিল। ‘গাড়িয়াল ভাই’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের বোনের চরিত্রেও নিজের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছে। ভাইবোনের সম্পর্কে বিশ্বাস, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ এসবের উদাহরণ আছে ছবিটিতে। এ ছবিতেও বিপরীতে মিঠুন।
যৌথ প্রযোজনার ‘আমি সেই মেয়ে’ ছবিতে অভিনয় করেছিল কবিতা। বিপরীতে ছিল শাহিন আলম। ঋতুপর্ণার সৎ বোনের চরিত্রে ছিল। দুজনের ফেস-টু-ফেস কয়েকটা সিকোয়েন্সে কবিতার অভিনয়শক্তিও কম ছিল না ঋতুপর্ণার তুলনায়। আমাদের আলেচনার টেবিল না পাওয়া তারকাও যে নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে সেরাটা দিতে পারে বাইরের ইন্ডাস্ট্রির ট্যালেন্টের সাথে এ ছবিতে কবিতা সেটা দেখিয়েছে।
কবিতা নামে দুজন নায়িকা ছিল। সাদাকালো ও রঙিন দুই সময়ের নায়িকা দুজন। আগের কবিতা মারা গেছেন। তার কথা বলতে গিয়ে পরবর্তীকালের কবিতাকে অনেকে মৃত বলে। এই কবিতা প্রবাসী।
কবিতা ৩৫ মিলিমিটারের সময়ের উল্লেখযোগ্য নায়িকা। নিজস্বতা রেখে প্রতিভার সাথে কাজ করেছে। ভালো ছবি ও অভিনয়ের সাথেই তার নামটি থাকবে দেশীয় চলচ্চিত্রে। তাকে আমরা ভুলিনি।