কলকাতার সিনেমা বাঁচাতে ভরসা ঢাকা
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে ঢাকা সফরে আসেন কলকাতার একঝাঁক তারকা। তাদের মুখে ঘুরে ফিরেই ছিল কলকাতার চলচ্চিত্র বাংলাদেশে প্রদর্শন। এর জন্য তারা হিন্দি সিনেমার আমদানি ঠেকাতে অনেকে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণের প্রতিই গুরুত্বারোপ করেন। এ প্রসঙ্গে নায়ক দেব দুই বাংলা এক করার কথাও বললেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে মিলে কথা বলতে বাংলাদেশের কোনো পরিচালক-প্রযোজককে দেখা যায়নি।
সবমিলিয়ে তাদের তোড়জোড় থেকে ফুটে উঠেছে কলকাতার চলচ্চিত্রের মন্দা অবস্থা। যা মমতা ব্যানার্জীর ভাষণ থেকে বিএফডিসির বৈঠক সর্বত্র দৃশ্যমান ছিল।
শনিবার সকালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত অনানুষ্ঠানিক এক বৈঠকে ঢাকা-কলকাতা যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মান, নির্মাণের নীতিমালা তৈরি করা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের পেশাগত মান উন্নয়নসহ নানা পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে আলাপ হয়। এতে বরাবরই বলা হয়, এ ঢাকা-কলকাতার চলচ্চিত্রের উন্নয়ন হবে। কিন্তু বেশীরভাগ কথা এসেছে কলকাতার চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের কাছ থেকে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম হারুন-অর-রশীদ, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, সহসভাপতি সোহানুর রহমান সোহান, মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার, শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অমিত হাসান, সহসভাপতি ওমর সানি, অভিনেত্রী সিমলা, মেহের আফরোজ শাওন, ভারতের অভিনেতা প্রসেনজিৎ, নির্মাতা গৌতম ঘোষ, অরিন্দম শীল, ভেঙ্কটেস ফিল্মসের কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে।
নির্মাতা গৌতম ঘোষ বলেন, ‘বাংলা সিনেমার অভিনেতা, অভিনেত্রী আর কলাকুশলীরা এখন যেন কুয়োর ব্যাঙ! উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য কোথাও আমাদের বাংলা সিনেমার বাজার ভালো না। এখন দুই বাংলা একযোগে কাজ না করলে বাংলা চলচ্চিত্রের বাজার আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যৌথ প্রযোজনার ব্যাপারে অন্যভাবে ভাবতে হবে। এসব সিনেমা নির্মাণের নিয়মকানুন দুই বাংলার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হবে। সিনেমার বাণিজ্যিক দিকটি মাথায় রেখে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। একইসঙ্গে দুই দেশের চলচ্চিত্রের শিল্পীদের কথাও মাথায় রাখতে হবে।’
ভারতীয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ দুই বাংলার চলচ্চিত্র আমদানি-রপ্তানির ইস্যুতে একটি যৌথ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এ কমিটি ঠিক করে দেবে কোন সিনেমাগুলো বিনিময় হবে, কোন সিনেমাগুলো সেন্সর করা যাবে। এ ধরনের কমিটির কথা ঢাকার নির্মাতারা উল্লেখ না করলেও গুরুত্ব দিন বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম হারুন-অর-রশীদ ।
তিনি বলেন, ‘যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোর মান ওঠানামা করছে। এ সিনেমাগুলো দুদেশে প্রদর্শন করতে গিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া ঠিকমতো হচ্ছে না। অথচ উপমহাদেশীয় ভাষার চলচ্চিত্র আমদানি করতে আইন খুব কঠিন নয়।’
পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান চলচ্চিত্র বিনিময় প্রথার বিষয়টি তুলে এনে বলেন, ‘বিশ বছর আগে নির্মিত বাংলাদেশি সিনেমা সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত কোনো ভারতীয় সিনেমার বিপরীতে রপ্তানি হবে, ব্যাপারটি দুঃখজনক। এটা চলতে পারে না।’
এস এ হক অলিক বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের প্রসেনজিৎকে এদেশের মানুষ এখন ভালোভাবেই চেনে, জানে। কিন্তু আমাদের শাকিব খান বা অন্য অভিনেতাদের পশ্চিমবঙ্গের দর্শক চেনে না। যাদের চেনেই না, তাদের সিনেমা কেন দেখবে সে দর্শক।’। এর জবাবে প্রসেনজিৎ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সিনেমার প্রযোজকরা বাংলাদেশি শিল্পীদের নিয়ে প্রচারণা করতে পারেন।’
প্রসেনজিৎ আরো বলেন, ‘এক সময় যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা অনেক ভাল ছিল, তখন কলকাতার চলচ্চিত্রে ছিল দুর্দিন। কিন্তু সুপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে কলকাতার চলচ্চিত্র এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন আমরা পরিকল্পনা করে দুই বাংলার চলচ্চিত্র অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারি।’
তবে কলকাতার চলচ্চিত্রের দুর্দিন সম্পর্কে তিনি এড়িয়ে যান। তামিল সিনেমার রিমেকসহ নানা কারণে গত কয়েকবছর ধরে কলকাতার চলচ্চিত্র একদম ব্যবসা করতে পারছে না। তাই ওখানকার পত্রিকায় বাংলাদেশে কলকাতার চলচ্চিত্রের বাজার সম্প্রসারণের কথা বারবার উঠে এসেছে। মাস দুয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে প্রসেনজিৎ বাংলাদেশে হিন্দি চলচ্চিত্রের মুক্তিতে হতাশা প্রকাশ করেন।
বৈঠকের শেষে হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘এখন বাংলা চলচ্চিত্রে বাজার আরও বড় করতে হলে, যৌথ প্রযোজনার বিষয়ে আরও বেশি করে ভাবতে হবে। আমরা দশ বছরে দশটি যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারি। যৌথ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে এসব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, নির্মাতা, কলাকুশলীদের বিষয়ে।’।
এর আগে ভারত দুতাবাস আয়োজিত ‘বৈঠকী বাংলা’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে, মমতা ব্যানার্জী বলেন, ‘দুই দেশের সিনেমা শিল্প নিয়ে অনেক জট রয়েছে। আমি সেগুলো খোলার চেষ্টা করছি। এই জট খুলতে তিনি বাংলাদেশ থেকে তিনজন ও ভারত থেকে তিনজন নিয়ে একটি কমিটি করারও প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে সে কমিটির সভাপতি করারও প্রস্তাব করেন তিনি। যে কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টপাধ্যায় ও শ্রীকান্ত মেহতার নামও বলেন তিনি। তৃণমূল কংগ্রেসে নেত্রী বলেন, কলকাতায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব করুক। বাংলাদেশে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব করুক।’
শনিবার রাতে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ সফরের আগে এক ধরনের মিডিয়া হাইপ তৈরি করা হয়েছে। তার সফরে তিস্তা, সীমান্ত চুক্তি নিয়ে আশাবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে এসব ব্যাপারে তার কোন ক্ষমতাই নেই। এগুলো একান্তই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার। এখন দেখা যাচ্ছে মমতার এ সফর মূলত আমাদের এখানে কলকাতার সিনেমার বাজার সৃষ্টি করা।’
অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি লিখেন, ভগবান ‘গৌতমে’র সাধনায় দেবাদি ‘দেব’ যেন ‘প্রসেন’ চিত্তে ‘মমতা’ময় রূপ নিয়ে অবতীর্ন হচ্ছেন এই বাংলায় ! এই অবতীর্নের হেতুতে কোন যুগের শুরু হবে ?
পরিচালক পি এ কাজল লিখেন, শ্রীকান্ত মেহেতারা কলিকাতার বাংলা ছবি ধ্বংস করে বাংলাদেশের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। এই বেনিয়াদের চক্রান্ত সফল হতে দেওয়া হবে না। এই হোক সব দেশ প্রেমিক চলচ্চিত্র কর্মী ও দর্শকদের দাবী। আমাদের বাংলা -বাঙ্গালি- দেশ ও জাতির উন্ননের প্রধান রুপকার আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে ভাষার দিনে ও মাসে- মেহেতাদের এই ভাষার, স্বাধীনতার ঐতিহ্য নেই।