বিদেশি গল্পে সেরা বাংলাদেশি ছবিটি
এফডিসির চলচ্চিত্র মানেই ৭টি ফাইট, ৫টি গান, যাত্রার ঢং-এ অ্যাকটিং, কানের পর্দার ফাটানো চিৎকার, আজগুবি গল্প নয় এই কথাটার আরেকটি প্রমাণ দিচ্ছি, শুনুন।
আমাদের মূলধারায় গতানুগতিক ধরনের বাইরে অসংখ্য দর্শকনন্দিত ছবি আছে যা অনেকেরই অজানা। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্ষতিপূরণ’ তারই একটি প্রমাণ। ছবিটি সাধারণ দর্শক থেকে সমালোচক সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল এবং একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করে। কয়েক বছর আগে সালমান খানের ‘রাজরঙ্গি ভাইজান’ দেখে যারা কেঁদেছিলেন তাদের বলবো দয়া করে আমাদের স্বল্প বাজেটের ‘ক্ষতিপূরণ’ একবার দেখুন ।
১৯৮৯ সালের কোন এক বিকেলে সপরিবারে গিয়েছিলাম সিলেটের ‘মনিকা’ সিনেমা হলে, যথারীতি মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন ছবি ‘ক্ষতিপূরণ’ দেখতে। নায়ক ছিলেন আলমগীর ও নায়িকা রোজিনা। কিশোরবেলার আলমগীর আমার সবচেয়ে প্রিয় একজন নায়ক, যার ছবি মানেই অসাধারণ কিছু। সেদিন ভাবতে পারিনি কী চমক অপেক্ষা করছিল হল ভর্তি দর্শকদের জন্য। যাই হোক, টেলি সামাদ ও আবুল খায়েরের অলিম্পিক ব্যাটারি ও গোল্ডলিফের বিজ্ঞাপন দুটোর জাতীয় পতাকা প্রদর্শন শেষে ছবি শুরু হলো।
ছবির গল্পটি এমন— আলমগীর একজন চিত্রশিল্পী, সন্তান মারা যাওয়ায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী সেই শোকে আত্মহত্যা করে। স্ত্রীর মৃত্যুতে আলমগীরকে পুলিশ সন্দেহ করে। এখন বিশাল বাড়িতে আলমগীর একাই থাকে। শোকে-দুঃখে প্রতিরাতে মাতাল হয়ে বাড়িতে ফেরে। একদিন তেমন অবস্থায় বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারে একটি ৫-৬ বছরের বয়সী শিশুকন্যাকে কুড়িয়ে পায়। বাসায় নেওয়ার পর আলমগীর জানতে পারে মেয়েটি বোবা ।
নিজের মেয়ে ‘কবিতা’ নাম দিয়েই তাকে লালন-পালন শুরু করে আলমগীর। কিন্তু এরপর থেকেই ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। কারা যেন মেয়েটিকে ছল-বলে-কৌশলে ছিনিয়ে নিয়ে খুন করতে চায়। আলমগীর নিজেও ভেবে পায় না কেন এই নিষ্পাপ শিশুটির পেছনে এতো শত্রু।
ঘটনাক্রমে একদিন মেয়েটির ছোট খালা রোজিনার সঙ্গে আলমগীরের পরিচয় হয়। রোজিনা মেয়েটিকে গাড়িতে একা বসে থাকতে দেখে মায়ায় পড়ে যায় এবং তাকে নিয়ে শপিংমলে ঘুরে বেড়ায়; এভাবে রোজিনা-আলমগীরের পরিচয়। রোজিনাও জানে না, শিশুটি তার মেজো বোনের মেয়ে, যাকে বিদেশ থেকে আসা রোজিনা ও তার বড় বোন রোজী আফসারী খুঁজছে।
এ দিকে শিশুটিকে নিতে ছদ্মবেশে দিলদার ও তার স্ত্রী আলমগীরের বাড়িতে হানা দেয় এবং নিজেদের শিশুটির মা-বাবা দাবি করে। কিন্তু দিলদার যখন মেয়েটিকে বাবা ডাকতে বলে তখনই আলমগীরের সন্দেহ হয়। অর্থাৎ খুনি চক্র দিলদারকে টাকার বিনিময়ে মেয়েটিকে অপহরণ করতে পাঠায়। একদিন খুনি চক্রের সাজানো নারী অপহরণ ঘটনায় সন্দেহে জেলে যায় আলমগীর। মেয়েটির দায়িত্ব নেয় রোজিনা এবং আলমগীর তাকে বলে, যেভাবেই হোক কবিতার দিকে যেন খেয়াল রাখে।
কবিতাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসার পর রোজী কবিতাকে চিনে ফেলে এবং রোজিনাকে জানায় এই সেই তাদের মেজো বোনের মেয়ে। দিলারা নিখোঁজের ঘটনায় আগেই জিডি করে রেখেছিল রোজী। রোজী পুলিশের কাছে গেলে বের হয়ে আসে রোমহর্ষক ঘটনা। কে বা কারা কবিতার মা-বাবাকে খুন করে বাড়ির বাগানের পেছনে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিল, সে লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ সন্দেহ করলেও বোবা শিশুটির আচরণে বুঝিয়ে দেয় আলমগীর খুনি নয়, বরং আলমগীরের কাছে সে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। আলমগীরও জানতে পারে, কুড়িয়ে পাওয়া বোবা শিশুটিকে কেন বারবার একটি চক্র ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। এরপর সে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়।
কামারশালায় ঘরে হাতকড়া খুলতে এসে দেখা পায় কামাররুপী দিলদারের, যে একদিন বাবা সেজে কবিতাকে অপহরণ করতে গিয়েছিল। আলমগীর তার কাছ থেকে জানতে পারে যে এক দাড়িওয়ালা লোক টাকার বিনিময়ে এই কাজ করতে বাধ্য করেছিল। অভাবে পরে দিলদার সেদিন রাজি হয়েছিল।
দিলদারের কাছ থেকে ধারণা পেয়ে আলমগীর একটি ছবি আঁকে, যাকে সে একদিন রাস্তায় দেখেছিল এবং দেখামাত্রই কবিতা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। রাতের আঁধারে রোজিনার সঙ্গে দেখা করতে এসে সব খুলে বলে, কেন সে পালিয়েছে এবং সাদা কাগজে দাড়িওয়ালা লোকটির ছবি এঁকে রোজিনার হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘তুমি কবিতাকে এই ছবিটা দেখিয়ে জানার চেষ্টা করবে লোকটিকে চিনে কিনা?’ রোজিনা ছবিটি দেখাতেই কবিতা ভয় পেয়ে যায়, যাতে বুঝতে বাকি নেই মানুষটিকে কবিতা চেনে।
এরপর শুরু হয় কবিতার মা-বাবাকে খুন করার রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনিদের ধরতে আলমগীরের অভিযান। সে নিষ্পাপ শিশুটির মা-বাবা হারানোর ‘ক্ষতিপূরণ’ বুঝিয়ে দিতে চায় এবং খুনি ড্যানি সিডাক ও আহমেদ শরীফের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ছবিটি শেষ হয়। আর চাঞ্চল্যকর খুনের রহস্য উদ্ঘাটন ও জীবন বাজী রেখে খুনিদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ফেরারি আসামি আলমগীরকে পুলিশ বিভাগ ক্ষমা করে দেয়। আলমগীর-রোজিনার মাঝে হারানো মা-বাবাকে খুঁজে পায় কবিতা। এভাবেই সেদিন রুদ্ধশ্বাস এক গল্পের সহজ-সরল কিন্তু অসাধারণ নির্মাণ দেখে তৃপ্ত দর্শক বাড়ি ফিরেছে।
টাইটেলের শুরুতে পরিচালক মালেক আফসারী ‘একটি বিদেশি ছবির ছায়া অবলম্বনে’ লিখে না দিলে কেউ সহজে বুঝতেই পারতো না ছবিটি বাংলাদেশের গল্প নয়। কিশোর বয়সে দেখলেও আজও ছবিটির স্মৃতি বারবার চোখে ভাসে। বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমার ব্যতিক্রমধর্মী রূপ দেখে।
মালেক আফসারী হলেন আমাদের ‘মাস্টার মেকার’ এ জে মিন্টুর অন্যতম একজন মেধাবী ছাত্র। গুরু মিন্টুর মতো আফসারী বাণিজ্যিক ছবির গল্প নিয়ে বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন, ‘ক্ষতিপূরণ’ এর মধ্যে সেরা। সেদিনের স্বল্প বাজেটে ও সীমিত কারিগরি সহায়তায় নির্মিত ‘ক্ষতিপূরণ’ ছবিটির কাছে আজকের কয়েক কোটি টাকার ছবিও পাত্তা পাবে না এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। প্রেম-বিরহ, পারিবারিক টানাপোড়েন কিংবা সামাজিক অ্যাকশন গল্পের বিপরীতে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী গল্পের ছবিটি শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোন শ্রেণির মাথার ওপর দিয়ে যায়নি বরং প্রতিটি শ্রেণির দর্শকেরা পুরো ছবিটি দারুণ উপভোগ করেছিলেন।
টাইটেল শেষ হতে না হতেই শওকত আকবরকে তার ব্যবসায় অংশীদার আহমেদ শরীফ খুন করে যা রাস্তা দিয়ে বাসায় যেতে জনি-দিলারা দম্পতি ও ৫/৬ বছর বয়সী তাদের শিশুকন্যা দেখে ফেলে। যার ফলে আহমেদ শরীফ তার ভাড়াটে খুনি ড্যানি সিডাককে পাঠায় খুনের সাক্ষী হিসেবে ওই অপরিচিত দম্পতিকেও খুন করতে। জনি-দিলারাকে খুন করলেও শিশুকন্যাটি দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায়। এরপর টাইটেলে দেখানো হয় রোজী ফিল্মসের নাম ও পরিচালক হিসেবে মালেক আফসারীর নাম। তার মানে দর্শক নড়েচড়ে বসার আগেই একটি খুন দেখতে পেল এবং মূল গল্পটি মাত্র শুরু হলো।
টাইটেল শেষেই আলমগীরের আগমন আর এভাবেই ছবিটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দৃশ্য ধরে ধরে এগিয়েছে যা পরিচালনার নিপুণতা ও দক্ষতা প্রমাণ করে। অবাক করার বিষয় হলো, সেদিন বড়পর্দায় আলমগীরকে বয়সের তুলনায় অনেক অনেক বেশি তরুণ লেগেছিল। তিনিও পুরো ছবিতে তারুণ্যদীপ্ত যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক-সমালোচক সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।
সেই বছরে আলমগীর অভিনীত রাঙাভাবী, সত্য মিথ্যা, ব্যথার দান, বিসর্জনের মতো দারুণ দারুণ একাধিক ছবি মুক্তি পেয়েছিল যার সবগুলোই দর্শকনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু ‘ক্ষতিপূরণ’ অন্য সব ছবি থেকে আলাদা ছিল এবং নিজের অভিনয় স্টাইলটা পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন যার পুরস্কার আলমগীর পেয়েছিলেন বছর শেষে জাতীয় পুরস্কারের পর্বে। পেশাদার খুনি চরিত্রে প্রায় সংলাপহীন ড্যানি সিডাক দারুণ অভিনয় করেছিলেন। তার ক্যারিয়ারে ‘ক্ষতিপূরণ’ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটি চলচ্চিত্র হয়ে থাকবে। বোবা শিশু মেয়েটির চরিত্রে অভিনয় করেছিল সম্ভবত বিন্তি বা বিন্তু। বোবা চরিত্রে সে অসাধারণ অভিনয় করেছিল; যাকে ১৮০০ শিশুশিল্পী থেকে বাছাই করেছিলেন প্রযোজক রোজী আফসারী ও পরিচালক মালেক আফসারী। যার সার্থকতা বিন্তি দেখিয়েছিল। ভেবেছিলাম শিশুশিল্পীটি সেই বছর জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যাবে কিন্তু এ জে মিন্টুর ‘সত্য মিথ্যা’ ছবির জন্য মাস্টার জনসন সেরা শিশুশিল্পীর পুরস্কার অর্জন করে।
ছবিটিতে রোমান্টিক দৃশ্য নেই বললেই চলে কিন্তু তারপরেও আছে প্রেম, দুঃখবোধ, ভালোলাগা-ভালোবাসার গল্প, যা অন্য সব ছবি থেকে আলাদা করে রেখেছিল। বিনোদনের কোন উপকরণ বাদ ছিল না। গান, নাচ, ফাইট আছে আর আছে উত্তেজনায় ঠাসা পরিচ্ছন্ন গল্প।
হলিউডের অনুকরণে ছবিটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রযোজক বদলসহ নানা সমস্যায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে একই গল্পে ১৯৮৮ সালে গোবিন্দ অভিনীত হিন্দি ‘হত্যা’ মুক্তি পায়। ‘হত্যা’ আগে মুক্তি পাওয়ায় অনেকে ভেবে থাকেন মালেক আফসারী হয়তো হিন্দি ছবিটিকে নকল করেছেন। আসলে তা নয়, দুটোই হলিউডের একই ছবি থেকে নেওয়া।
‘ক্ষতিপূরণ’ ছবিটির সহযোগী প্রযোজক ছিলেন আলমগীর। অর্থাৎ রোজী আফসারী ও আলমগীর যৌথভাবে নির্মাণ করেন ছবিটি, পরিবেশনায় ছিল রোজী ফিল্মস।
বিদেশি ছবির ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ‘ক্ষতিপূরণ’ কি পুরস্কার পায়নি? আলমগীরের কথা তো আগেই বলেছি, এ ছাড়া মফিজুল হক শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক ও অ্যান্ড্রু কিশোর শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন। ছবির গান লিখেছিলেন আলমগীরের সাবেক স্ত্রী ও গীতিকার খোশনূর আলমগীর, সংগীত পরিচালনা করেন আবু তাহের। ‘এই দুটি ছোট্ট হাতে’ গানটির জন্য অ্যান্ড্রু কিশোর পুরস্কার পেয়েছিলেন। পুরো ছবিতে আবু তাহেরের মানানসই আবহ সংগীত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যদিই একটি সুরকেই ব্যবহার করেছেন তিনি। আবহ সংগীত হিসেবে একটি শিশুর বোবা আর্তনাদের সুরের ব্যবহার ছবির গল্প ও দৃশ্যকে আরও বেশি হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছিল। সেই বছর মিন্টুর ‘সত্য মিথ্যা’ না থাকলে সম্ভবত ‘ক্ষতিপূরণ’ আরও কয়েকটি পুরস্কার লাভ করতো।
সবশেষে সবাইকে আবারও অনুরোধ করবো, যারা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবিকে বস্তাপচা বলে যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করেন তারা একটিবার হলেও আমাদের পুরোনো দিনের বাণিজ্যিক ছবিগুলো দেখবেন, জানবেন। আর গত এক যুগেও কোন নতুন ধারার মেধাবী পরিচালকদের কাছ থেকেও এমন ছবি পাইনি,হয়তো পাবো না কোনো দিন। কারণ এখন ছবি নির্মাণ হয় দেশ-বিদেশে পুরস্কার পাওয়ার জন্য কিন্তু সিনেমা হলের সব শ্রেণির দর্শকদের জন্য আন্তরিকতা নিয়ে ছবি নির্মাণ কেউ করে না।
*মালেক আফসারী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, হিন্দি ছবির ফ্রেম টু ফ্রেম নকল করেছেন- সম্পাদক