Select Page

কাজী হায়াতের ‘দি ফাদার’ ও একটি ভয়াবহ স্মৃতি

কাজী হায়াতের ‘দি ফাদার’ ও একটি ভয়াবহ স্মৃতি

আমি তখন খুব ছোট। বয়স মনে হয় পাঁচ বা কিছু কম। আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রামের স্টেশন রোডস্থ বদরঝর্ণা পুকুর পাড়ে, উজালা সিনেমার বিপরীতে। বাসার জানালা দিয়ে উজালা সিনেমার বিলবোর্ড দেখা যেতো।

‘দি ফাদার’ ছবিতে বুলবুল আহমেদ ও সুচরিতা

একদিন উজালায় বেশকিছু ছাত্র আগুন লাগিয়ে দিল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকলো।

সিনেমার আশপাশে যাদের ঘর-বাড়ি, দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তারা প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি  করতে থাকলো। এই সুযোগে কিছু লোক লুটপাট করতে থাকলো। আমরাও এর শিকার হলাম।

জীবনের প্রথম কচি চোখে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড দেখে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। প্রায় ঘুমের ঘোরে ‘লাগুন’, ‘লাগুন’ বলে চিৎকার দিতাম। পরে আমার মা-বাবা অনেক ডাক্তার দেখান। তারপরও আমি মাঝে মাঝে আতংকিত হতাম।

শিশুমনে একবার কোনো বিষয়ে ভয় পেলে, সে বিষয়ের প্রতি সবসময় একটি ভয় থাকে। অহেতুক ভয়। তেমনি আমার আগুনের প্রতি ভয় ছিল। বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার এই ভয় ছিল।

বত্রিশ বছর বয়সে আমি কুয়েতে কুয়েতিদের রান্নাবাড়া করতাম। তখন এই ভয় চলে যায়।

৬ ডিসেম্বর ১৯৯০, বৃহস্পতিবার। সেদিন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করেন। কিন্তু পদত্যাগ করার আগে সারাদেশে কঠোরভাবে ১৪৪ ধারা জারি ছিল। সেইদিন বিটিভিতে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘দি ফাদার’ প্রদর্শন হচ্ছিল। আর ফাঁকে ফাঁকে ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদের বক্তব্য প্রচার হচ্ছিল। সঙ্গে স্থিরচিত্র জুড়ে সাতদল নেত্রী ও আটদল নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার হচ্ছিল।

ছবিটি দেখেছিলাম জমিদারের ঘরে। চট্টগ্রামে বাড়িওয়ালাদের জমিদার বলা হয়। ছবি দেখা শেষ করে যখন নিজ ঘরে আসলাম তখন দেখি বড়ভাই এসেছে।

আমার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে। আবার চলে যাবে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে এসেছে। পথে পথে আর্মি- বিডিআর টহল দিচ্ছে।

আমার কাছে জানতে চাইলো: কোথায় ছিলাম?

: সিনেমা দেখছিলাম টিভিতে।

: কী নাম সিনেমার?

: দি ফাদার।

: দি ফাদার ছবি নিয়ে একটি ঘটনা আছে জানছ?

: না।

: তাহলে শোন। তোর হয় তো মনে আছে। ছোটবেলায় তুই আগুন দেখে খুব ভয় পেয়েছিলি!

: হ্যাঁ!

তারপর বড়ভাই ঘটনাটি বলল— কাজী হায়াতের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘দি ফাদার’। ছবিটি আলমাস সিনেমায় চলছিল। তখন বিনোদন বলতে একমাত্র সিনেমা; ভিসিআর ছিল না, ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। যারা বড়লোক তাদের ঘরে টেলিভিশন ছিল।

সিনেমাই ছিল আমাদের একমাত্র বিনোদন মাধ্যম। আমরা ছাত্র-শিক্ষক, তরুণ-যুবক, নবীন- প্রবীণ  সবাই সিনেমা দেখতো। পরিবার-পরিজন নিয়ে।

‘দি ফাদার’ চলাকালীন আলমাস সিনেমায় হাউসফুল চলছিলো। টিকিট ব্ল্যাক করে এমন একজনের সঙ্গে কয়েকজন ছাত্রের তর্ক-বিতর্ক হয়। একপর্যায়ে টিকিট ব্ল্যাকার দারোয়ানের টুল দিয়ে একজন ছাত্রের মাথায় আঘাত করে। সেই ছাত্র মারা যায়। তারপর বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নগরীর সবকটি সিনেমা হলে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

গুলজার, খুরশিদ মহল এবং সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সিনেমা ছাড়া সবকটিতে অগ্নিসংযোগ করে।

খুরশিদ মহলের সামনে পেট্রোল পাম্প ছিল। তাই ট্রাফিক পুলিশ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হ্যান্ড মাইকিং করে অনুরোধ করেন যাতে আগুন না লাগায়। আগুন লাগালে পেট্রোল পাম্প ব্লাস্ট হয়ে পুরো লালদিঘী এলাকা পুড়ে যাবে।

গুলজার সিনেমায় আগুন লাগায়নি। কারণ গুলজারে টিকেট ব্ল্যাক হতো না। ছাত্ররা গুলজার সিনেমার মালিককে ফুলের মালা পরিয়ে মিছিল করে।

আর সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সিনেমায় ব্ল্যাক হতো না।

সিনেমা হল ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে বাংলাদেশে ২৮ দিন সিনেমা হল বন্ধ ছিল।

‘দি ফাদার’-এর কাহিনী হৃদয় ছুঁয়ে যায়। একজন বিদেশি নাগরিক তার ড্রাইভারের শিশুকন্যা লালনপালন করে। শিশুকন্যাটি যখন পিতামাতাহীন হয়ে যায়, তখন বিদেশি নাগরিক নিজ কন্যার মতো আদর স্নেহ দিয়ে লালনপালন করেন। একটি মানবিক গল্প, যে গল্প দর্শকদের কাঁদাতে পারে এবং ভাবাতে পারে।


About The Author

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

Leave a reply