কালজয়ী গানের কারিগর নজরুল ইসলাম বাবু
সব কটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান…
এক সময় অনেক বছর আবহ সংগীত হিসেবে দেশাত্মবোধক গানটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলা ও ইংরেজি খবরের আগে কখনো সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে আবার কখনো শুধু বাদ্যযন্ত্রে বাজানো হতো। শুধু টিভিতেই নয় মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ২৬ মার্চ-সহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনো এই গানটি বাজানো হয়, সঙ্গে ‘একটি বাংলাদেশ, তুমি জাগ্রত জনতা’. ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’র মতো কালজয়ী গানগুলোও বাজানো হয়৷
এই গানগুলোর গীতিকার কে? নতুন প্রজন্মের কাছে জিজ্ঞেস করলে ৯০ শতাংশেরও বেশি বলতে পারবে না। অথচ উল্লেখিত দিবসে আমরা গানগুলোকে বুকে লালন করে গাই, গানের কথার আশ্রয়ে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করে সম্মান দেখাই আমরা। কিন্তু আফসোস… গানগুলোর যিনি রচয়িতা সেই গীতিকবিই থেকে যান আড়ালে নীরবে। আজ বলবো সেই গীতিকবি, মুক্তিযোদ্ধা ক্ষণজন্মা নজরুল ইসলাম বাবুর কথা।
১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানার চরণগর গ্রামে তার জন্ম। বাবা বজলুল কাদের ছিলেন স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষকতার পাশাপাশি সংগীতকেও মনে লালন করতেন তিনি। যার প্রভাব হয়তো বড় ছেলে নজরুল ইসলাম বাবুর ওপর পড়েছিল। চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে বাবুই ছিলেন সবার বড়্। প্রথমে স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে মামার কাছে থেকে বরিশাল বিএম স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক, পরে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও বিএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীনতাকামী বাবু ভারতে ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে যেমন তার বন্দুক চলেছে তেমনি চলেছে তার কলম। একটু অবসরেই তিনি লিখেছেন দেশের জন্য গান।
নিজে প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই হয়তো লিখতে পেরেছিলেন ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতা’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখো গো মালি’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’র মতো কালজয়ী সব গান।
নজরুল ইসলাম বাবু গীতিকার জীবনে প্রথমে বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত হন ১৯৭৪ সালে, সেখানে প্রথম রেকর্ড হওয়া গানটি ছিল শেখ সাদী খানের সুরে ‘না দেখাই বুঝি ছিল ভালো’। শিল্পী ছিলেন সুখেন্দু চক্রবর্তী। একই বছরে তার আরও দুটি গান প্রচার হয় বেতারে। সুবীর নন্দীর কণ্ঠে শেখ সাদী খানের সুরে ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’ তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, যার প্রেক্ষিতে গানটি ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মহানায়ক’ ছবিতে ব্যবহৃত হয়।
বেতারের মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাবু তালিকাভুক্ত গীতিকার হন ১৯৭৬ সালে। আশির দশকে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে আলাউদ্দিন আলীর সুরে বাবুর লেখা ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, পাশাপাশি গায়ক হিসেবেও প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবালকে একটি অবস্থান তৈরি করে দেয়।
বিটিভিতে বাবুর লেখা আরেকটি খুব জনপ্রিয় গান ছিল ‘’দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল, রেললাইন বহে সমান্তরাল বহে সমান্তরাল’। দিলরুবা খানের কণ্ঠে গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল ‘একদিন যখন’ নাটকে। নাটকটির পরিচালক ছিলেন জিয়া আনসারী, গানটি পরবর্তীতে শামিমা ইয়াসমিন দীবা ও মলয়কুমার গাঙ্গুলিও গেয়েছিলেন।
দারুণ জনপ্রিয় গানটি নিয়ে সুরকার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ এক স্মৃতিচারণে জানান, গানটা আসছিল না কিছুতেই, অথচ কিছুদিন পর রেকর্ডিং। নাটকে গানটি ব্যবহার করা হবে। আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা, পবিত্র কোরবানির ঈদের পরদিন, সকালে চালের রুটি ও মাংস দিয়ে নাশতা করে রিকশায় বের হয়েছিলেন দুই বন্ধু। মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে হঠাৎ ট্রেন এলো, রিকশা থামল, ঝিকঝিক আওয়াজে ট্রেন যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখমুখ বড় হয়ে গেল নজরুল ইসলাম বাবুর। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সব কটি সিগারেট ফেলে দিলেন, প্যাকেটর সাদা কাগজে লিখলেন, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল রেললাইন বহে সমান্তরাল বহে সমান্তরাল’… রিকশায় বসে পুরো গান লেখা হয়ে গেল।
এই স্মৃতিচারণা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় নজরুল ইসলাম বাবু কী রকম সৃষ্টিশীল গীতিকবি ছিলেন।
নজরুল ইসলাম বাবু বেতার ও টেলিভিশন মিলে বেশ কিছু আধুনিক গান লিখেছিলেন, যার বেশির ভাগই ছিল জনপ্রিয়। উল্লেখযোগ্য হলো— কত দিন দেখি না যেন তোমাকে (কণ্ঠ: সাবিনা ইয়াসমিন ও সংগীত: শেখ সাদী খান), মনে হয় হাজার বছর দেখি না তোমায় (কণ্ঠ: শাম্মী আখতার ও সংগীত: শেখ সাদী খান), নীল চাঁদোয়া (কণ্ঠ : শাকিলা জাফর ও শুভ্র দেব), আমি তোমাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি, কেন মন কাঁদেরে, ডায়েরির পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলেছি, প্রিয়ার দুচোখ যদি হয়, রেল লাইন বহে সমান্তরাল এবং প্রেম যেন এক প্রজাপতি।
আধুনিক ও দেশাত্মবোধকের পাশাপাশি নজরুল ইসলাম বাবু চলচ্চিত্রেও কিছু গান লিখেছেন, তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তারপরও তার লেখা বেশির ভাগ গানই পেয়েছিল জনপ্রিয়তা। সেই হিসেবে সুরকার শেখ সাদী খানের সঙ্গে আধুনিক গানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের গানেও বেশ একটা ভালো জুটি গড়ে উঠেছিল। এ ছাড়া আলাউদ্দিন আলী, আলী হোসেন, খন্দকার নূরুল আলমের সঙ্গেও হয়েছিলেন সফল। চলচ্চিত্রে বাবুর উল্লেখিত গান— কথা বলবো না বলেছি (আঁখি মিলন), হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে (মহানায়ক), ডাকে পাখি খোলো আঁখি (প্রতিরোধ), শোনো সোমা একটু দাঁড়াও (প্রতিরোধ), জীবনের এই যে রঙিন দিন (সাক্ষী), কাঠ পুড়লে কয়লা হয় (পদ্মা মেঘনা যমুনা), কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো (উসিলা), আমার মনের আকাশে আজ (প্রেমের প্রতিদান), কিবা জাদু জানো (দুই পয়সার আলতা) এবং কাল সারা রাত ছিল স্বপ্নেরও রাত (প্রেমের প্রতিদান)। এ ছাড়া চাকর, হুঁশিয়ার, শুভদা, সুখ, প্রতিঘাত-সহ আরও কিছু চলচ্চিত্রে গান লিখেন তিনি।
১৯৯১ সালে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ চলচ্চিত্রের জন্য বাবু শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাংলাদেশ প্রযোজক সমিতির পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। ১৯৮৬ সালে যৌথ প্রযোজনায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন, যার চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গানও লিখেছেন তিনি। অথচ জীবদ্দশায় তিনি এই সম্মানটুকু দেখে যেতে পারেননি। মাত্র ৪১ বছর বয়সে ১৯৯০ সালের ১৪সেপ্টেম্বর তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
স্বাধীনতার পরে যে কজন গীতিকার বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছিলেন নজরুল ইসলাম বাবু ছিলেন তাদের একজন। তার অকালে চলে যাওয়ায় আমাদের সংগীতাঙ্গনে যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে তার পূরণ হওয়ার নয়। গভীর ও শ্রদ্ধাভরে স্বজন করছি তাকে।