কী যে দাপট ছিল ওয়াসিমের!
আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়ে গেল গত ১৮ এপ্রিল। বাংলা চলচ্চিত্র থেকে এক সত্যিকারের সুপারস্টারের বিদায় হয়ে গেল, কী দাপট ছিল তার সিনেমাগুলোর, কী দর্শক ছিল তার ছবিগুলোর। ওয়াসিম মানেই যেন সেই ছবিগুলো সুপারহিট, বাংলা চলচ্চিত্রে ওয়াসিমই একমাত্র নায়ক ছিলেন যার বেশিরভাগই ছবিই ছিল সফল।
প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক এসএম শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’ (২২/০৯/১৯৭২) ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক ঘটে ওয়াসিমের, পাশাপাশি ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। ছবিটিতে মূল অভিনেতাদের তালিকায় ছিলেন রাজ্জাক-শাবানার মতো তারকারা। সঙ্গে অলিভিয়ার চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশও ঘটে, যিনি পরবর্তীতে বাংলা চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়িকাদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন।
যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করা ওয়াসিমের জন্ম চাঁদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে ২৩ মার্চ ১৯৪৭ সালে। তার আসল নাম মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ। পরিচালক মহসিনের পরিচালনায় ‘রাতের পর দিন’ (১১/০৫/১৯৭৩) ছবিটির মাধ্যমে ওয়াসিম নামে পরিচিতি হন, দারুণ সফলতা পেয়ে যায় ছবিটি। সে সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতার বিপরীতে একজন সাধারণ ছেলের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে সিনেপাড়ায় আলোচনায় চলে আসেন তিনি, যার প্রেক্ষিতে পরের বছরেই ওয়াসিমকে নিয়ে কাজে নেমে পড়েন দুই বিখ্যাত পরিচালক ইবনে মিজান ও মমতাজ আলী সাহেব।
এই বছরই তাদের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘ডাকু মনসুর, (২৬/০৭/১৯৭৪, ইবনে মিজান), ‘কে আসল কে নকল’ (০২/১২/১৯৭৪ মমতাজ আলী) ও ‘জিঘাংসা’র (২৪/১২/১৯৭৪, ইবনে মিজান) মতো সুপার হিট ছবিগুলো। পরপর তিন ছবির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ওয়াসিম তখন চিত্রপাড়ায় অন্যরকম এক উচ্চতায়, যেখানে তার কাজ ছিলো শুধুই সামনের দিকেই ছুটে চলা। সেই প্রেক্ষিতে আসতে লাগলো ‘দুশমন’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘দি রেইন’, ‘বাহাদুর’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘রাজ দুলারী’, ‘আসামী হাজির’, ‘তুফান’, ‘রাজমহল’, ‘বারুদ’, ‘বন্দুক’, ‘শীষ নাগ’, ‘বেদ্বীন’, ‘রাজকন্যা’ এর মতো সুপার ডূপার হিট ছবিগুলো।
মজার ব্যাপার হলো এগুলোর প্রায় বেশির ভাগই ছিল পোশাকি ও ফ্যান্টাসি ঘারানার, যার কারণে তাকে এ ধরনের ছবির নায়কের রাজাও বলা হতো। আবার তাকে সাহসী ও বাহাদুর নায়ক নামেও ডাকা হতো। তার যথার্থ কারণও ছিল… অভিনয় করতে গিয়ে তিনিই বোধহয় একমাত্র নায়ক যিনি সবচেয়ে বেশিবার পর্দায় ঘোড়া চালিয়েছেন, করেছেন ভিলেনদের সঙ্গে তরবারির ঝনঝনানি, বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে মোকাবিলা তো ছিলই। পর্দায় উনার ঘোড়া চালানো এতটাই বাস্তবসম্মত লাগতো যে মনে হতো তিনি সত্যিকারের একজন ঘোড়ার সাওয়ারী।
কলেজের ছাত্রাবস্থায় বডি বিল্ডার হিসেবে ১৯৬৪ সালে বডি বিল্ডিংয়ের জন্য ইস্ট পাকিস্তান খেতাব অর্জন করা ওয়াসিমের শারিরীক গঠনও ছিল নায়কোচিত। সুঠোম দেহের অধিকারী ওয়াসিমকে দারুণ মানাতো ফোক ফ্যান্টাসি ছবিগুলোতে। শুধু ফোক ফ্যান্টাসি আর অ্যাকশন ছবিই না সামাজিক লোককাহিনির দারুণ সব সফল ছবিও উপহার দিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে ‘মহেশখালির বাঁকে’, ‘বিনি সুতার মালা’, ‘আলতা বানু’, ‘নান্টু ঘটক’, ‘ধন দৌলত’, ‘ভাগ্যলিপি’, ‘প্রিন্সেস টিনা খান’, ‘ঘরে বাইরে’, রসিয়া বন্ধু’, ‘হাসনা হেনা’, ‘আমানত’, ‘নূরী’, ‘চাচা ভাতিজা’, ‘সেতু বন্ধন’, ‘হিসাব চাই’, ‘জীবন ধারা’, ‘আঁচল বন্দী’, ‘ছলনা’, মোহন বাঁশী’, ‘মান মর্যাদা’, ‘সাক্ষী’, ‘মানসী’, ‘প্রান সজনী’ অন্যতম।
একটা সময় এমন অবস্থা ছিল যেখানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একচেটিয়া ওয়াসিমেরই রাজত্ব ছিল। পোশাকি, সামাজিক, গ্রামীণ, মারদাঙ্গা সব ধরনের ছবিতেই তার নাম সফলভাবে উচ্চারিত হতো। ওয়াসিম মানেই যেন পয়সা উসুল ছবি, ওয়াসিম মানেই যেন প্রর্দশকদের মুখে হাসি, পর্দায় যখন ওয়াসিম দুরন্ত গতিতে ঘোড়া চালিয়ে আসতেন তখন ছবিঘর করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠত, তার নাম নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়তো তখনকার সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা।
প্রায় ১৪০টির মতো ছবিতে অভিনয় করা ওয়াসিম জুটি হয়ে সবচেয়ে বেশিবার পর্দা ভাগাভাগি করেছেন শাবানা, রোজিনা ও অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে, যার মধ্যে শাবানা ২০টি, রোজিনা ৩৪টি ও অঞ্জুর সঙ্গে ২৬টি চলচ্চিত্রে জুটি হয়ে অভিনয় করেছেন। আরেক অভিনেত্রী অলিভিয়ার সঙ্গেও দারুণ একটি জুটি গড়ে উঠেছিল তার, মোট ১২টি ছবিতে তারা জুটি হয়েছিলেন, যার মধ্যে ‘বাহাদূর’, ‘বুলবুল এ বাগদাদ’, ‘বেদ্বীন’, ‘লাল মেম সাহেব’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া সুচরিতা, কবরী, ববিতা, নূতনসহ সে সময়ের আরো অনেকের সাথেই অভিনয় করেছেন।
ওয়াসিমের ছবি মানেই তখন সিনেমা হলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। তার নতুন কোন ছবির জন্য সে সময়ের দর্শকরা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতো, শুধু তাই নয় প্রর্দশকরাও অপেক্ষা করতেন কবে ওয়াসীমের নতুন ছবি রিলিজ পাবে… এমনও হয়েছে ওয়াসিমের ‘আসামী হাজির’, ‘রাজ দুলারী’, ‘বাহাদুর’, ‘বন্দুক’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘তুফান’, ছবিগুলোতে দর্শকদের জোয়ারে হলের গেটও ভাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। ওয়াসিমের এমন সাফল্য শুধু দেশেই নয় পৌছে গিয়েছিলো খোদ হলিউডেও, অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের বিএফডিসি সফরে সেখানকার ছবিতে অভিনয় করারও অফার পেয়েছিলেন। ওয়াসিম একমাত্র নায়ক যার একটি ছবি ‘দি রেইন’ (যখন বৃষ্টি এলো) এক সঙ্গে বিশ্বের ২৬টি দেশে মূক্তি পেয়েছিল, যা আজও একটি রের্কড৷
যাই হোক… ওয়াসিমের ছবি মানেই সেখানে তার অনবদ্য অভিনয় আর দর্শকদের মুগ্ধ হয়ে তা উপভোগ করা। বিশেষ করে মমতাজ আলীর ‘ঈমান’ চলচ্চিত্রে একসঙ্গে তার তিনি তিনটি চরিত্রে অভিনয় যা আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল ঘটনাই বলতে হয়। অভিনয়ের পাশাপাশি ওয়াসিম প্রযোজক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। নিজের ডব্লিউআর প্রোডাকশন থেকে নির্মাণ করেন ‘মোহন বাঁশি’, ‘হিসাব চাই’, ‘নয়া তুফান’ নামের তিনটি চলচ্চিত্র। ৭০ থেকে ৮০ দশকে রাজত্ব করা একজন ওয়াসিমের চলচ্চিত্রের সফলতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু এতটুকু বলতে হয় ওই দুই দশকের বাংলা চলচ্চিত্রকে সোনালী যুগের আখ্যায় পরিণত করার অবদানে একজন ওয়াসিমের নাম লেখা থাকবে স্বর্নাক্ষরে!
অথচ এই রকম একজন অভিনেতাকে চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সন্মাননা পুরস্কার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে’ সন্মানিত না করা ছিল খুবই দুঃখজনক৷
এক নজরে ওয়াসিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু ছবির নাম— রাতের পর দিন, ডাকু মনসুর, দুই রাজকুমার, দি রেইন, বাহাদুর, জীবন সাথী, দোস্ত দুশমন, রাজ দুলারী, আসামী হাজির, তুফান, রাজমহল, বারুদ, বন্দুক, ঈমান, শীষ নাগ, বেদ্বীন, মোকাবেলা, রাজ নন্দিনী, শাহী দরবার, বিনি সুতার মালা, কুদরত, স্বাক্ষী, সোহাগ মিলন, মানসী, সওদাগর, নান্টু ঘটক, রাজ সিংহাসন, আবেহায়াত, প্রান সজনী, তিন বাহাদুর, ধন দৌলত, বানজারান, পদ্মাবতী, রসের বাইদানী, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, রাজিয়া সুলতানা, লাল মেম সাহেব, জিপসি সওদাগর, নরম গরম, সোনাই বন্ধু, সতী নাগ কন্যা, ধর্ম আমার মা, নূরী ও মান মর্যাদা।
ওয়াসিম অভিনীত চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান— চুমকি চলেছে একা পথে (দোস্ত দুশমন), রূপ নগরের রাজা তুমি আজ পাবে সাজা (রাজমহল), এই মন তোমাকে দিলাম (মানসী), পেয়েছি আমি তারে (সোহাগ মিলন), কী জানি কী যাদু করলা (আয়না মতি), মনটা যদি খোলা যেত (চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা), আমি তোমারি চির ভিখারী (চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা), কথা দাও সাথী হবে (রাজ নন্দিনী), কী যাদু আছে (বাহাদুর), হিরার চেয়ে দামী (তুফান), আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই (দি রেইন/যখন বৃষ্টি এলো), কোন বাগানে আছো বন্ধু (সোনাই বন্ধু), পদ্মাবতী বেদেনী (পদ্মাবতী), প্রেম করেছো তুমি (রাজ দুলারী), পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার (জিঘাংসা), ভালোবাসি তোরে বন্ধু (আমানত), ওরে মন চোরা (সওদাগর), দোহাই লাগে সুজন (পদ্মাবতী), ঢাকা শহর দেখমু আজ দুইজনে ঘুইরা ঘুইরা (নান্টু ঘটক), চাকবুম চাকবুম চাঁদনী রাতে (আবেহায়াত), এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না (নরম গরম), আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙ্গাল (প্রিন্সেস টিনা খান), ও রসিয়া নাগর আমার মন পিঞ্জিরার মন (রসের বাইদানী), প্রেম প্রেম ভালোবাসা দেয়া নেয়া মন (ধন দৌলত), আমরা দুটি ছেলে মেয়ে খোকনরে তুই বাপ (সাক্ষী), ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল নাও (লাল মেম সাহেব), বন্ধুরে (নূরী), কথা দাও ও সজনী(সোনাই বন্ধু), কী যাদু করিলা (প্রাণ সজনী) ও কত রঙ্গ জানো রে মানুষ কত রঙ্গ জানো (প্রাণ সজনী)।