কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া: হাওর অঞ্চলের দর্পণ
অনেকটা চুপিসারেই ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ মুক্তি পেয়েছে, একটি মাত্র হলে। ট্রেলার দেখেই কেমন যেন একটা মাটির গন্ধ পেয়েছিলাম, সেজন্যই দেখতে যাওয়া। মাটির পুরো গন্ধ নিয়েই ফিরে এসেছি।
হাওর অঞ্চলের একটা পরিবারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই সিনেমার কাহিনি। তাদের জীবনের লক্ষ্য আর স্বপ্ন একটাই- পেট ভরে ভাত খাওয়া। ধানের চাষকে ঘিরেই তাদের জীবন আবর্তিত হয়। কিন্তু তাদের এতটুকু স্বপ্নও পূরণ হয় না প্রকৃতির রুদ্রমূর্তিতে। বানের জল তাদের সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পচে যাওয়া ধান গাছকে জড়িয়ে তাদের চোখের জল আর বৃষ্টির জল একাকার হয়ে যায়। এরপরেও তারা থেমে থাকে না, ঘুরে দাঁড়ায়, আবারও নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। নিজের থালার ভাত উঠিয়ে দেয় সম্পূর্ণ অপরিচিত অতিথির জন্য, শুধুমাত্র অতিথি ভাতের কষ্ট করেছে বলে। এর মাঝেও আনন্দ মাতোয়ারা হওয়ার চেষ্টা করে তারা, যদিও আনন্দের উৎস তাদের কাছে নেই বললেই চলে। যাদের কাছে খাওয়ার জন্য চাল নেই, তাদের কাছে বিনোদনের জন্য মোবাইল, ফেসবুক আশা করা বাতুলতা বৈকি! লঞ্চে কোন বিয়ের যাত্রীদল বিয়েবাড়িতে যাচ্ছে- সেটা দেখাই তাদের কাছে সিনেমা দেখার মত আনন্দ! সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যেন নিজের বিয়ের দিনকে খুঁজে পায় তারা, সেই দিনের কথা ভেবে হয়তো একই সাথে কিছুটা আনন্দিত আর দুঃখিতও হয় তারা। তবে অনুভূতির টিকে থাকার সময় এখানে খুবই কম কারণ শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত থাকে, পানি চলে এলে সেখানে নৌকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না৷ সেখানে মরেও শান্তি নেই, কারণ কবর দেয়ার মত বিন্দুমাত্র মাটি অবশিষ্ট থাকে না সেখানে, পানিতে লাশ ভাসিয়ে দেয়াই একমাত্র নিয়তি সেসময়।
প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে এই সিনেমার কাজ হয়েছে। পরিচালক অনেক সততা দিয়ে সিনেমাটি বানিয়েছেন তা স্পষ্ট। পরিচালক যা দেখাতে চেয়েছেন, তাই দেখিয়েছেন। তিন বছরের বেশি সময়ের শুটিং এর কারণে প্রতিটি ঋতু, ঋতু পরিবর্তন আলাদাভাবে ধরতে পেরেছেন চিত্রগ্রাহক। শুধু তাই না, সকাল, সন্ধ্যা, রাত, ভোর- সবগুলো সময়কেই আলাদা করা গেছে। স্থানীয় ভাষায় সবাই কথা বলেছেন আর কেউ অভিনয় করেছেন বলে মনেই হয়নি, সবাই যেন চরিত্র হয়ে গিয়েছিলেন। তবে আলাদা করে বলতে হয় জয়িতা মহলানবীশের কথা, একেবারেই যেন হাওর অঞ্চলের নারীর প্রতিচ্ছবি তিনি।
গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ এক চরিত্র দেখা যায় সিনেমাতে, তার মুখে শোনা যায় চমৎকার সব দার্শনিক সংলাপ। “ধান রোদ সহ্য করতে পারলে তুমি পারবা না ক্যান?” এছাড়াও শোনা যায় প্রিয় মানুষের স্মৃতি মনে করে ‘সোনা বন্ধু’ গানটি।
এত জীবন সংগ্রামের মাঝেও রাতের বেলা ঘুমানোর আগে বাচ্চাকে নিজাম ডাকাতের কাহিনি বলতে ভুল করে না তারা।
প্রোডাকশন ভ্যালু হয়তো আরও ঝাঁ চকচকে হতে পারতো, কোন চেনামুখ নিলে সিনেমাটা হয়তো আরও মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারতো- তবে সেক্ষেত্রে হয়তো সিনেমাটা সৎ থাকতো না, সিনেমাটা হাওর অঞ্চলের হয়ে উঠতো না। সেই জায়গা থেকে এই সিনেমার টিম সার্থক, টিমের প্রতিটি সদস্য সার্থক।
কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া দেখে আপনি যদি হাওর অঞ্চলের মানুষের সম্পর্কে জানতে পারেন আরও বিশদভাবে, তাদের দুঃখ যদি আপনাকে স্পর্শ করে, তাদের ভয়াবহ জীবন সংগ্রাম দেখে আপনি যদি নিজের দুঃখকে তুচ্ছ ভাবতে শেখেন- তাহলেই এই সিনেমা সার্থক। একটা সৎ সিনেমা দেখতে চাইলে এই সিনেমাটা অবশ্যই দেখবেন।