কেয়ামত থেকে কেয়ামত : পপুলার ও ক্লাসিক
ঢালিউডের সিনেমায় যে সিনেমাগুলো একটা বাঁক পরিবর্তনে অবদান রেখেছে এবং নতুন সময়ের সূচনা করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত।’ সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শেষ থেকে যদি শুরু করা যায় তবে সেটা হবে উত্তম কাজ। গাজী মাজহারুল ইসলামের দরাজ কণ্ঠে বলা কথাগুলো -‘এই প্রেম অমর, অসীম। এই প্রেমের সীমানা কেয়ামত থেকে কেয়ামত।’ কথাগুলের মধ্যে লুকিয়ে অাছে ক্লাসিক দিকটি যা প্রেমের জন্য সব দেশকাল পাত্রে ঠিক। অাপনি অামি লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, অানারকলি-সেলিম, রোমিও-জুলিয়েট তাঁদের উদাহরণ টানলে তারাও মানুষের হৃদয়ে অমর প্রেমের জন্য স্মরণীয়। প্রেমের জন্য জীবন উৎসর্গের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাই ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ একটি অাদর্শ প্রেমের সিনেমা। জীবন উৎসর্গ এ সিনেমার কেন্দ্র।
‘রিমেক’ ও ‘নকল’ নিয়ে অাজকাল বেজায় তর্ক বাঁধে।যত্রতত্র ‘নকল’ বলে ধুয়া ধরা সমালোচকরা ‘রিমেক’-কে ‘নকল’ থেকে অালাদা করতে পারে না বা চায় না। অামির খান-জুহি চাওলা জুটির ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ হিন্দি সিনেমার কপিরাইট থেকে বাংলা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত‘ সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। হিন্দির ফ্রেম টু ফ্রেম রেখে বাংলাদেশী সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে গল্প, গান, অভিনয় সব ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। মোটাদাগে সিনেমাটি হয়ে উঠেছে উত্তম রিমেকের উদাহরণ যাকে একটি উত্তম অভিযোজন বলাই উচিত।
‘সো কলড বাংলা সিনেমা’ বলে যে ফ্যাশনেবল সমালোচকরা নাক সিঁটকায় সিনেমার গল্পকে কেন্দ্র করে তারা লক্ষ করবে এ সিনেমার হিন্দি মূল ভার্সনে দুই উচ্চ পরিবারের চিরায়ত দ্বন্দ্ব এবং প্রেমের সম্পর্ক না মানার কারণে তৈরি ফ্যামিলি ড্রামা ছিল। এ ড্রামা শুধু বাংলা সিনেমার গতানগতিক বৈশিষ্ট্য ছিল না। বরং অারো উদাহরণ টানলে অমিতাভ বচ্চনের ‘অগ্নিপথ’, শাহরুখ খানের ‘বাজিগর’ এগুলো প্রতিশোধের গল্প। এমনকি মহানায়ক উত্তম কুমারের ‘হারানো সুর’-ও স্মৃতি হারিয়ে অাবার ফিরে পাওয়ার মতো ঘটনায় ব্যাপ্ত।বলতে গেলে যুগ বা সময় যখন যেমন দর্শক ডিমান্ড করেছিল সেটাই ছিল ট্রেন্ড। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত‘ ফ্যামিলি ড্রামায় অনবদ্য উপস্থাপন।
সিনেমাটি স্লো বা স্পিডি কোনোটাই না হয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে গল্প বলেছে। অাহমেদ শরীফের ভাই রাতিন রাজিবের বোনের সাথে প্রতারণা করলে রাজিবের বোন অাত্মহত্যা করে।রাজিব খুন করে রাতিনকে। জেলে যায়। ফিরে অাসার পর ততদিনে ছেলে সালমান শাহ বড় হয়। সালমানের সাথে প্রেম হয় অাহমেদ শরীফের মেয়ে মৌসুমীর। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জন্য তাদের সম্পর্ক মানা না হলে তারা কৌশলে বাড়ি থেকে পালায়। পাহাড়ি অঞ্চলে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘাতক একদিন পৌঁছে যায় সেখানে। দুই পরিবার তাদের নিতে অাসে। ঘাতক সালমানকে গুলি করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে গুলি করে মৌসুমীকে। মৌসুমীর মৃত্যুর পর সালমান কোমরে বাঁধা ছুরি নিজের পেটে চালিয়ে দেয়। তারপর সব ইতিহাস।
এ গল্পের প্রেজেন্টেশনে একজোড়া নতুন মুখ সালমান শাহ–মৌসুমী নব্বই দশকের তৃতীয়ার্ধ্বে দর্শক অাগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। হালের ক্রেজ তৈরি করেছিল এ জুটি। প্রথম সিনেমায় নতুন এ জুটির অনবদ্য অভিনয় দর্শক গ্রহণ করে। দুজনের লুকে একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব ছিল। অভিনয়ের সময় ইনোসেন্টলি একটা অাবহ তৈরি হয়। সালমান তাঁর হ্যান্ডসাম পর্দা উপস্থিতিতে ‘ও অামার বন্ধু গো’ গানে যখন একের পর এক অসাধারণ সব এক্সপ্রেশন দিয়ে যাচ্ছে সেইসাথে মৌসুমীর গ্ল্যামার ও সুন্দর রোমান্টিক এক্সপ্রেশনগুলো একই সময়ে গানের রোমান্টিক প্রেজেন্টেশনকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়। অন্য গানগুলোও একইভাবে কেমিস্ট্রি তৈরিতে সাহায্য করেছে। রাজিব অসাধারণ ছিল তাঁর চরিত্র রূপায়ণে। একইসাথে বোনের জন্য খুনী হয়, জেল খেটে এসে ছেলের জন্য স্নেহশীল পিতা, ছেলের প্রেমকে মেনে না নেয়া কঠোর পিতা, ছেলেকে ফিরে পেতে অাহমেদ শরীফের সাথে লড়াই করা দায়িত্ববান পিতা সবই তার চরিত্রে অনেক বৈশিষ্ট্যকে দেখায়। রাজিব-অাহমেদ শরীফ দ্বন্দ্ব ‘ দেন মোহর’ সিনেমার মতোই দ্বন্দ্বমুখর এ সিনেমায়। রাজিবের বড়ভাই অাবুল হায়াত অার একটি অসাধারণ চরিত্রে ছিল। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, ভালোবাসা ইত্যাদি তাদের মধ্যেও ছিল। অন্যান্য সব চরিত্র নিজেদের জায়গায় সেরা পারফর্ম করে গেছে।
প্রেমের সিনেমায় ইমোশনাল দিক প্রাধান্য পাবে সেটাই স্বাভাবিক। সালমান–মৌসুমীর প্রেম যখন শুরু হয় ঐ প্রথম ইমোশনকে দর্শকের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। সারারাত জঙ্গলে কাটানোর পর রাস্তা খুঁজে পেলে যখন বাড়ি ফিরতে হবে তখনই মৌসুমী বলে বাড়ি ফিরে তার সাথে দেখা করবে কিনা সালমান। মূলত ‘love at first sight’ এর বিষয়টা মৌসুমীর থেকে শুরু হয়। এর অাগে খুনসুটি, ভালো লাগার বিভিন্ন সময়গুলো থেকে ভালোবাসে সালমানকে। সালমানও অাবেগ ধরে রাখতে পারে না। এছাড়া ‘রাজ, অামি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’ মৌসুমীর এ অতি সাধারণ সংলাপই প্রেমের প্রকৃত প্রকাশ হয়ে ওঠে।
সোহানুর রহমান সোহান পরিচালনার জায়গায় নিখুঁত ক্রম মেইনটেইন করেছেন। একটা কোণাও বাদ রাখেননি।একটা সিকোয়েন্সে দেখা যায় মৌসুমীকে বাড়ি থেকে পালিয়ে নিয়ে অাসে তার বান্ধবী। খবরটা সালমানকে দেয় বন্ধু মিঠু। বলে-‘রেশমী চলে এসেছেএসেছে, তোকে পালাতে হবে।’ সালমান ড্রয়ার খুলে ডায়েরি থেকে জমানো টাকা নিয়ে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে চলে যায়।সূক্ষ্ম এ ব্যাপারগুলো মেইনটেইন করেছেন পরিচালক। ক্লাইমেক্সে রক্তের দাগ দেখে অাসা ঘাতক মৌসুমীকে গুলি করার পর সালমান নিজের পেটে ছুরি চালায় যখন তাদের দুজনের অভিনয় তার সাথে রাজিব, অাবুল হায়াত, মিরানা জামান, আহমেদ শরীফ তাদের অার্তনাদ ঐ সময়টাকে পাথর করে দেয়। ছোটবেলায় বড়ভাইবেরাদাররা যখন বলত এ দৃশ্যটাতে দর্শক নিশ্চুপ হয়ে যেত। দর্শক পিনপতন নীরবতায় ঐ দৃশ্যের ভেতর প্রবেশ করত। একে বলে সিনেমা ও দর্শকের emotional attachment. এটা খুব জরুরি জিনিস।
সালমান শাহ-র অকালমৃত্যু এ সিনেমার সাথে একটা জায়গায় ফিলোসফিকে দাঁড় করায়। সালমান-মৌসুমীর একটা সিকোয়েন্স অাছে যেখানে মৌসুমীকে সূর্যাস্তের সাথে জীবনের মিল দেখায় সালমান। মৌসুমী প্রশ্ন করে-‘অাপনি এ সমস্ত কুসংস্কার বিশ্বাস করেন?’ সালমান জবাব দেয়- ‘বিশ্বাস করি না কিন্তু অায়ু থাকতে কে মরতে চায় বলুন?সালমান বাঁচতে চেয়েছিল বাস্তব জীবনে কিন্তু বাস্তব তাঁকে দেয়নি বাঁচতে। সালমান শাহ ঢালিউডে সেই ইমেজ তৈরি করে গেছে যার অকালে চলে যাওয়ার জন্য দর্শকের অাক্ষেপ থাকবে কেয়ামত থেকে কেয়ামত। সিনেমাটি এক্ষেত্রে অার একটা বিশ্লেষণ অানে।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাটি হিন্দি মূলটির থেকে বাংলাদেশী দর্শকের কাছে বেশি পপুলার ও ক্লাসিক। এটা জরিপ করলে প্রমাণিত হবে নিশ্চিত। এর বিভিন্ন লক্ষণও অাছে। বাংলাদেশের জল-মাটি-হাওয়ায় এখানকার সমাজ-সংস্কৃতিতে গল্পে, সুরেলা গানে নির্মিত এ সিনেমা পপুলারিটি অর্জন করেছে। বলাকা সিনেমাহলে ‘সালমান শাহ স্মরণ উৎসব’-এ যেদিন সিনেমাটি দেখানো হয়েছিল একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। দর্শক চেয়ার না পেয়ে ফ্লোরে বসেও দেখেছে এটা নিজের চোখে দেখা।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ বাংলা ভাষার উত্তম রিমেক সিনেমা। পপুলারিটি থেকে দিন দিন সিনেমাটি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। অভিনয় ও গানসমৃদ্ধ লেভেল থেকে ক্লাসিক কমার্শিয়াল সিনেমা এটি। সব দিক থেকে ভাবলে এ সিনেমার অাবেদন থাকবে অাগামীতেও।