Select Page

খন্দকার নূরুল আলম: যার সুর মনের কথা বলে

খন্দকার নূরুল আলম: যার সুর মনের কথা বলে

চোখ যে মনের কথা বলে… বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত এ গানটির কথা আসলেই অবধারিতভাবে চলে আসে প্রথিতযশা সংগীত পরিচালক খন্দকার নূরুল আলমের নাম, গানটির মূল শিল্পীও ছিলেন তিনি। অথচ গানটির গাওয়ার কথা ছিল আরেকজন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী জনাব মাহমুদুন্নবীর, কণ্ঠেও তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গানটি সৃষ্টি করার মতো নুরুল আলমের কণ্ঠেই শ্রোতাপ্রিয়তা পায়৷

খন্দকার নূরুল আলমের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট আসামের ধুবরীতে, মাত্র আট বছর বয়সে হঠাৎ এক ঘটনায় তার বাম পা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখন তিনি মাত্র প্রাথমিক স্কুলে অধ্যয়নরতঅ জীবনের এতটুকু বয়সে এমন ধাক্কা খেয়েও থেমে থাকেননি তিনি। পড়াশোনা ঠিকই চালিয়ে গিয়েছেন নিজের অদম্য ইচ্ছাতে।

১৯৫৪ সালে নোয়াখালীর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দর্শন শাস্ত্রে এমএ পাস করেন তিনি৷

সংগীতে প্রথাগতভাবে তালিম নেননি তিনি। তবে প্রচুর গান শুনতেন, গানের ভেতরের এই ভালো লাগা থেকেই মূলত তার সংগীত পরিচালক হয়ে ওঠা। ক্যারিয়ারের একেবারে শুরুর দিকে উপমহাদেশের বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি’তে সুরকার হিসেবে যোগদান করেন খন্দকাল নূরুল আলম। টেলিভিশনের (১৯৬৪) সূচনা লগ্ন থেকেও তিনি যুক্ত ছিলেন, ছিলেন আশির দশকে বাংলাদেশ বেতারের সংগীত প্রযোজক।

বাংলা গানে তার বিচরণ ঘটে ষাটের দশকের একেবারে শুরুতে রেডিওর জন্য একটি আধুনিক গানের সুর করার মধ্য দিয়ে। গানটি ছিল মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর গাওয়া আর মেখোনা কাজল তুমি চপল আঁখিতে শিরোনামে, চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন নূরুল আলম পরিচালিত ‘ইস ধরতি পার’ (২৩/০৯১৯৬৬) নামের উর্দু একটি ছবি দিয়ে, দ্বিতীয় ছবিটিও করেন উর্দুতে, আজহার হোসেন পরিচালিত ‘উলঝন’ (২৬/০৫/১৯৬৭)। বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন আমীর হোসেনের ‘যে আগুনে পুড়ি’ (০২/০১/১৯৭০)-র মধ্য দিয়ে। সে বছর ছবির সব কটি গানই পায় ভীষণ জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে চোখ যে মনের কথা বলে ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মার্জিত ভাষা আর মিষ্টি সুরের এমন রোমান্টিক গানের আবেদন বাংলা চলচ্চিত্রে খুব কমই এসেছে। গানটিকে ধরা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা গানগুলোর একটি।

একই বছর মুক্তি পায় তার সুরারোপিত আরেকটি ছবি সৈয়দ আওয়াল পরিচালিত ‘অন্তরঙ্গ’ (১২/০৬/১৯৭০), সেখানে রহমান-সুচন্দার অভিনয়ে বশির আহমেদের কণ্ঠে সেই মন কাড়া সুর ভুল যদি হয় মধুর এমন, হোক না ভুল গানটি এখনো শ্রোতামহলে সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে আছে।

খন্দকার নূরুল আলমের অন্যান্য উল্লেখ্যযোগ্য কিছু গানের মধ্যে আহা চোখের লজ্জা (চন্দ্রনাথ), এত সুখ সইবো কেমন করে (শুভদা), তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে (শুভদা), মন আমার ছোট্ট বাসা সে বড়ো ভালোবাসা (জন্মদাতা), মন রে ও মন, সুখ পাখি তোর হইলোনি আপন (দেবদাস), তোমারই উপহার আমি চিরদিন (পিঞ্জর), এই রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে (কাজল লতা), আমার সকল চাওয়া (বিরাজ বৌ), এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে (জলছবি), কথাগুলো বড় সুন্দর বড় মিষ্টি (জীবনতৃষ্ণা), জনম জনম ধরে প্রেম পিয়াসী (দেবদাস) অন্যতম৷

চলচ্চিত্রের গানে বিশেষ অবদানস্বরূপ খন্দকার নূরুল আলম তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, তিনবার বাচসাস পুরস্কারসহ বেশ কিছু স্বীকৃতি পান। চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), শুভদা (১৯৮৬) ও পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১) ছবির জন্য পান জাতীয় পুরস্কার। দেবদাস (১৯৮২), চন্দ্রনাথ(১৯৮৪) ও শুভদা (১৯৮৬) ছবির জন্য মেলে বাচসাস পুরস্কার। এ ছাড়া শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পুরস্কার, সরগম ললিতকলা পদক, রাজা হোসেন খান স্মৃতি পদক পান তিনি। পেয়েছেন একুশে পদকও (২০০৮)।

খন্দকার নূরুল আলম শুধু চলচ্চিত্রের গানই নয়, করেছেন আধুনিক ও দেশের গান। তার দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে রুনা লায়লার গাওয়া নদীর মাঝি বলে এসো নবীনআমার মন পাখিটা যায়রে উড়ে যায় উল্লেখ্যযোগ্য।

সর্বোপরি আমাদের চলচ্চিত্রসহ বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করতে বাংলা গানকে সর্বমহলে পৌঁছে দিতে যাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাদের একজন খন্দকার নূরল আলম সাহেব। ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু খন্দকার নূরুল আলমের বর্ণাঢ্য সব সুরের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।


Leave a reply