Select Page

খোকন-রুবেলের অজানা কথা

খোকন-রুবেলের অজানা কথা

১৯৬৯ সালে জন্মগ্রহণ করা মাসুম পারভেজ রুবেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় বড় ভাই মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা প্রযোজিত ও শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘লড়াকু’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আগমন করেন। প্রথম ছবিতেই বাংলাদেশের দর্শকদের মার্শাল আর্টের কলাকৌশল দেখিয়ে বাজিমাত করে দেন রুবেল।

সেই থেকে শুরু বাংলা চলচ্চিত্রে একটি ‘রুবেল’ অধ্যায়ের। এরপর ‘উদ্ধার’, ‘বীরপুরুষ’, ‘বজ্রমুষ্ঠি’, ‘মারকশা’ ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য দিয়ে তৎকালীন সময়ের সকল প্রযোজক ও পরিচালকের নজরে পড়েন। কিন্তু তখনও খোকন ও মাসুদ পারভেজ ছাড়া অন্য কেউই মার্শাল আর্ট ভিত্তিক ছবি নির্মাণ করতে সাহস পেতেন না। এই সময় এগিয়ে আসেন পরিচালক আহমেদ সাত্তার ‘হুংকার’ ও ‘বীর বিক্রম’ ও আবুল খায়ের বুলবুল ‘ আমি শাহেনশাহ’ ছবি নির্মাণ করেন। দুই পরিচালকও রুবেলকে দিয়ে সাফল্য পেলেন।

এরপর একে একে মুক্তি পেতে লাগলো ‘বিষদাঁত’, ‘বজ্রপাত’ ‘অকর্মা’ ‘ইনকিলাব’ ‘আজাদ’ ‘উত্থান পতন’ ‘সন্ত্রাস’ ‘শেষ আঘাত’ ‘দেশ দুশমন’ অর্জন ‘লাওয়ারিশ’ ছবিগুলো। প্রত্যেকটি ছবিই বক্স অফিসে সাফল্য পেলে রুবেলের চাহিদা বেড়ে যায়। খোকনের সেই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বললেই চলে। কারণ রুবেল ছাড়া সেই সময়ে একমাত্র ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম ছাড়া কোন নায়কই মার্শাল আর্ট জানতো না। ফলে সিনেমা মুক্তির দিক দিয়ে সেই সময় রুবেলের ছবি একটির পর একটি আসতেই থাকে। এমনও অনেক সপ্তাহ গেছে যে নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত দুটি ছবির নায়কই থাকতেন রুবেল। ফলে একে একে মুক্তি পেতো লাগলো মা মাটি দেশ, গোলামির জিঞ্জির, অধিনায়ক, বীরযোদ্ধা, অন্যায় অত্যাচার, মালামাল, আন, ওমর আকবর, রুবেল আমার নাম, মহাগুরু, মিন্টু সম্রাট, লড়াই , সম্পর্ক , মহাশত্রু, মৃত্যুদণ্ড, মায়ের কান্না, টপ রংবাজ, চোখের পানি, জ্বলন্ত আগুন, ট্রাক ড্রাইভার, বিক্রম, ডন নামক একেকটি মারমার কাটকাট ছবি আর আমরা হুমড়ি খেতাম সিনেমা হলে।

তখন আমাদের কাছে রুবেল মানেই দুর্দান্ত অ্যাকশন ছবির মহানায়ক। টেলিভিশনের পর্দায় বিজ্ঞাপনের সময় খেয়াল রাখতাম রুবেলের কোন নতুন ছবির ট্রেলার দেখাচ্ছে কিনা। স্কুল থেকে ফিরে রেডিওতে কান পেতে থাকতাম রুবেলের কোন নতুন ছবির বিশেষ অনুষ্ঠান দিচ্ছে কিনা মাজহারুল ইসলামের কণ্ঠে। আমাদের হাঁটা চলার সময় সবসময় রুবেলের মতো বডিল্যাংগুয়েজ থাকতো যেন সব সময় প্রস্তুত ঢিসুম ঢিসুম করার জন্য।

সেই সময়ে সিলেটের ‘মনিকা সিনেমা’ (বর্তমানে হলটি নেই) হল সবার কাছে আলাদা পরিচিত পেয়েছিল রুবেলের ছবিগুলো প্রদর্শনীর কারণে। রুবেলের নতুন ছবি মুক্তি পাওয়া মানেই মনিকায় আসবে। কারন সেই সময়ে রুবেলের সবগুলো ছবি একমাত্র মনিকা সিনেমা মুক্তিপাওয়ার সাথে সাথে প্রদর্শনী করতো। মনিকার ব্যবসায়িক সাফল্য দেখে পরবর্তীতে অন্যান্য হলগুলোও রুবেলের ছবি প্রদর্শনীর জন্য প্রতিযোগিতা করতো। পরবর্তীতে নন্দিতা ও লালকুঠি সিনেমা রুবেলের নতুন ছবিগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ জে রানার ‘মহাগুরু’ ছবির আগে রুবেলের অন্য কোন সিনেমা আমি মনিকা ছাড়া দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

রুবেল এমনই এক অভিনেতা ছিলেন যার ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত স্বপন চৌধুরীর ‘বন্ধু বেঈমান’ ছবি ছাড়া অন্য কোন ছবি সুপার ফ্লপ বা মূলধন তুলতে পারে নাই এমনটি জানা নেই। প্রতিটি ছবিটি দেখেছি হাউসফুল দর্শক। এমনকি যেসব ছবি অন্য কোন নায়ক থাকলে সাধারন মূলধন না তোলার ঝুঁকিতে পড়তো নিশ্চিত সে ধরনের ছবিগুলো পর্যন্ত অনায়াসে রুবেলের কারনে মূলধন ফেরত পেতো। অর্থাৎ প্রযোজক পরিচালকদের কাছে রুবেল একটি আস্থার প্রতীক হয়ে গিয়েছিলেন যার ছবি মানেই মূলধন ফেরত আসার নিশ্চয়তা।

১৯৯১ সালে যখন নাঈম-শাবনাজ জুটি, কাঞ্চন–দিতি, মান্না-চম্পা জুটি তুঙ্গে তখনও রুবেল একের পর এক ছবি দিয়ে সবাইকে একা টেক্কা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় মুক্তি পায় গোলাবারুদ, বীরযোদ্ধা, সম্পর্ক, অপহরণ, ঘরের শত্রু, শত্রু ঘায়েল, রক্ত নিশান, সতর্ক শয়তান, মীরজাফর, গোয়েন্দা, জ্বলন্ত বারুদ, শত্রু ভয়ংকর ছবিগুলো। এরপর সালমান–সানীর যুগেও রুবেল ছিলেন সমান জনপ্রিয় ও তাঁর ধারায় একক অধিপতি। অর্থাৎ কেউই রুবেলের ছবি থেকে দর্শকদের ফেরাতে পারেনি।

রুবেল শুধু একজন অভিনেতাই ছিলেন না সেই শুরু থেকেই তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি ফাইট ডাইরেক্টর হিসেবেও সফল ছিলেন। তাঁর সবগুলো ছবিতেই নিজস্ব ফাইটিং গ্রুপ ‘দ্য একশন ও্যারিয়রস’ নামে একটি ফাইটিং গ্রুপ ছিল। বলতে গেলে সেই সময়ে বাংলাদেশে মার্শাল আর্ট কে জনপ্রিয় করে তুলেন রুবেল। যার ফলে তখন অনেক কিশোর তরুন মার্শাল আর্ট শিখতে উৎসাহী হয়। রুবেল তাঁর বিভিন্ন ছবিতে মার্শাল আর্ট এর ভিন্ন ভিন্ন নতুন কলাকৌশল উপস্থাপন করতেন। যার মধ্য ‘ড্রাংকিং কংফু’ (শত্রু সাবধান), উইপিং কংফু (বাঘের থাবা), ড্যান্সিং কংফু (ভণ্ড), ব্লাইন্ড কংফু (চারিদিকে শত্রু) সহ দুর্দান্ত সব কলাকৌশল উপস্থাপন করেন।

এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে… অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা ৭০র দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। প্রযোজক পরিচালক মাসুদ পারভেজ এর সহকারী হিসেবে কাজ করতেন শহীদুল ইসলাম খোকন। দীর্ঘ ১০ বছর গুরু মাসুদ পারভেজ এর সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর পূর্ণ পরিচালক হয়ে ‘পদ্মগোখরা’ ছবির মাধ্যমে খোকন আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু বিধিবাম! প্রথম ছবি ব্যবসায়িক ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর একই ভাবে দ্বিতীয় ছবিও ব্যবসায়িক ভাবে ব্যর্থ হয়।

এরপর এগিয়ে খোকনের ওস্তাদ মাসুদ পারভেজ। নিজের ছোট ভাই রুবেলকে চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে প্রমোট করার দায়িত্ব দেন খোকনের কাঁধে। নিজেদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পারভেজ ফিল্মস থেকে নির্মাণ করলেন ‘লড়াকু’ নামের একটি ছবি পরিচালনার দায়িত্ব দেন খোকনের হাতে। সেই শুরু হলো রুবেল-খোকন দুই নবাগত নায়ক পরিচালক জুটির কাজ। খোকনের তৃতীয় আর রুবেলের প্রথম ছবি ‘লড়াকু’ মুক্তি পাওয়ার পরেই বাজিমাৎ করে দিলেন। সেই সময়কার হিন্দি ছবিতেও অ্যাকশনের যে কৌশল দেখা যায়নি তা দেখা গেলো বাংলা ছায়াছবিতে।

হলিউডের ব্রুস লি’র ছবিতে ভিসিআরের মাধ্যমে দর্শক যা দেখতে পেতো সেটাই দেখলো ‘লড়াকু’তে। তবে মাসুদ পারভেজ এর আগেই ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমকে একটি মার্শাল আর্ট ভিত্তিক ছবি বানান। কাহিনীতে নতুনত্ব, অ্যাকশনে নতুনত্ব ও আলম খানের সুরের দুরদান্ত গানে ভরপুর ‘লড়াকু’ হয় সুপারহিট। ‘লড়াকু’র সফলতার পর খোকনকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

এরপর খোকন আর রুবেল একটানা উপহার দিয়ে গেছেন বীরপুরুষ, বজ্রমুসঠি, বিপ্লব, উত্থান পতন, সন্ত্রাস, টপ রংবাজ, শত্রু ভয়ংকর, অপহরণ, সতর্ক শয়তান, দুঃসাহস, লম্পট ,রাক্ষস, বিশ্বপ্রেমিক, ঘাতক, ভণ্ড, নরপিশাচ ও পাগলা ঘণ্টা ছবিগুলো। বীরপুরুষ, বজ্রমুষ্ঠি, বিপ্লব ছবিগুলো লড়াকুর মতো সুপারহিট হওয়ায় একটানা চারটি সুপারহিট ছবি উপহার দেন খোকন। মাঝে ‘উত্থান পতন’ ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ না হলেও আগের তিনটির মতো সুপারহিট হয়নি।

বীরপুরুষ ও বিপ্লব ছবি দুটো দর্শকদের মনে থাকবে জমজমাট কাহিনী আর দুর্দান্ত সব অ্যাকশন দৃশ্যর জন্য। যেখানে গুলি-বোমার কোন কাজ নেই, পুরোটাই ছিল দুর্দান্ত সব নতুন নতুন কংফুর কলাকৌশল। ‘বিপ্লব’ ছবিতে সর্বপ্রথম দর্শক কিছুক্ষণের জন্য রুবেলকে ন্যাড়া মাথায় দেখতে পায়। খোকনের ছবিতে রুবেল ছাড়াও আরও নতুন কিছু মুখ নিয়মিত হতে লাগলো যারা সকলেই মার্শাল আর্টে পারদর্শী ছিল। এই ক্ষেত্রে ড্যানি সিডাক, ইলিয়াস কোবরা, সিরাজ পান্না ও চিত্রনায়িকা মিশেলার কথা না বললেই নয়।

সিরাজ পান্না ছিলেন তখন রুবেলের সব ছবির বিশেষ আকর্ষণ যিনি মার্শাল আর্টে ছিলেন দুর্দান্ত। বিশেষ করে বীরপুরুষ, বজ্রমুষ্ঠি ও বিপ্লব ছবিতে সিরাজ পান্নার দুর্দান্ত অ্যাকশন দৃশ্যগুলো দর্শকদের মনে থাকবে চিরদিন। তিনটি ছবিতেই রুবেলকে মার্শাল আর্ট শেখাতে দেখা যায় ছোটখাটো হ্যাংলা পাতলা সিরাজ পান্নাকে। আর মিশেলা হলেন একমাত্র নায়িকা যিনি মার্শাল আর্টে পারদর্শী ছিলেন তাই মিশেলাকে খোকন ও মাসুদ পারভেজ ছাড়া অন্য পরিচালকদের ছবিতে দর্শক পায়নি।

লড়াকু থেকে পাগলা ঘণ্টা পুরো ১৫টি বছর ছিল খোকন আর রুবেলের সব দুর্দান্ত ব্যবসা সফল ছবির দাপিয়ে বেড়ানো। তাই পরিচালক খোকনের ছবি আমাদের কাছে সেই সময় ছিল রুবেলের দুর্দান্ত কোন নতুন ছবি পাওয়ার প্রত্যাশা যা ১৬ আনাই বলতে গেলে উসুল।

রুবেলের জনপ্রিয়তার পেছনে যেমন খোকনের অবদান আছে ঠিক তেমনি খোকনের জনপ্রিয়তার পেছনে রুবেলের অবদান আছে যা অস্বীকার করার উপায় নাই। খোকন ছিলেন তাঁর সময়ের পরিচালকদের মধ্য একধাপ এগিয়ে। চিন্তা-ভাবনারও ছিল অনেক ফারাক। যা তাঁর প্রতিটি ছবিতে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। নতুন নতুন কংফুর কলাকৌশল ছিল খোকনের ছবির অন্যতম একটি পার্থক্য। কখনও নিঞ্জা কংফু, কখনও জাম্পিং কংফু, কখনও বজ্রমুষ্ঠি, কখনও ক্যাটিং কংফু, কখনও ড্যান্সিং কংফু, কখনও ফুটবল কংফু এইভাবে নিত্যনতুন কলাকৌশল একেকটি ছবিতে হাজির করতেন।

১৯৯০ দশকের শেষ দিকে খোকনের ‘ভণ্ড’ ছবিটি আমাদের চলচ্চিত্রের একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাংলা চলচ্চিত্রে এমন কমেডি অ্যাকশন ছবি দর্শক এর আগে দেখেনি বললেই চলে। সেই সময় সব ছবিতেই কিছু না কিছু কমেডি দৃশ্য থাকতো কিন্তু খোকনের ‘ভণ্ড’ ছবিটি সেই গতানুগতিক কমেডি ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল যা সচরাচর বাংলা ছবিতে দেখা যায়নি। পুরো ছবিতে ফরীদি ও এটিএম শামসুজ্জামান জুটি অসাধারণ অভিনয় করে দর্শকদের মনে গেঁথে গেছেন।

খোকনের অন্য সব ছবিতে ফরীদি যেখানে ছিলেন দুর্ধর্ষ ভয়ানক সেখানে ‘ভণ্ড’ ছবিতে ফরীদি পুরোই ব্যতিক্রম এক হাসির খোরাক। এই ছবিটিও আমরা সিনেমার মধ্য বিরতির ট্রেলার দেখে পুরো ছবিটি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলাম। মুক্তি পাওয়ার পর ছবিটি সেই বছরের সেরা দশে তো ছিলই এমনকি সেরা ৫টি ব্যবসা সফল ছবির তালিকায় চলে আসে অনায়াসে। খোকনের ‘ভণ্ড’ আমাদের সময়ের দর্শকদের পেরিয়ে এই প্রজন্মের কাছেও সমান জনপ্রিয়। নতুন প্রজন্মের যারা বাংলা বাণিজ্যিক ছবিকে অবজ্ঞা করে তারাও খোকনের ‘ভণ্ড’ ছবিটির ভক্ত।

বাংলাদেশের যে কজন পরিচালক তখন বেশ খুঁতখুতে স্বভাবের বা সবকিছু নিখুঁত চাইতেন তাদের মধ্য খোকন অন্যতম। একেকটি দৃশ্য তিনি খুব যত্ন সহকারে বানাতেন যেখানে ছোটখাটো ভুল নেই বললেই চলে। খোকন ছবির গল্প থেকে শুরু করে পোস্টার সব বিষয়ে দর্শকদের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতেন যার ফলে খোকনের ছবি মানেই ছিল সেই সময়ে সিনেমা হলে কিশোর তরুন সহ পারিবারিক দর্শকদের ঢল।

৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে খোকন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও তার পরবর্তী সময়ের একটি দুর্দান্ত গল্প নিয়ে ‘কমান্ডার’ তৈরি করেন। যেখানে নাম ভুমিকায় ছিলেন সোহেল রানা আর দ্বিতীয় নায়ক ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। ফরীদি থাকলেও রুবেল ছিলেন না। সেই প্রথম রুবেল আর খোকনের মধ্য বিরতি দেখতে পেলো দর্শকরা। তবুও রুবেলবিহীন ‘কমান্ডার’ লুফে নেয় হুমায়ুন ফরীদি ও ছবির গল্পের জন্য। যে ছবিতে ফরিদিকে সিঁধেল চোর হিসেবে দেখা যায় যাকে ধরতে হলে আগে বালু/মাটি ছুড়ে মারতে হয় যেভাবে একটি জ্যান্ত শিং মাছকে ধরতে হয় সেভাবে। দুর্দান্ত ফরীদির কারণে দর্শক রুবেল এর অভাব ভুলে গিয়েই হলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ফলাফল রুবেলবিহীন খোকনের সুপারহিট একটি ছবি।

এরপরেই খোকন শুধু ফরীদিকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়ে বিপরীতে শাবানা, চম্পা ও সুবর্ণা মুস্তফার মতো তিনজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে নিয়ে তৈরি করলেন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম নায়কবিহীন সম্পূর্ণ সোশ্যাল কমেডি ছবি ‘পালাবি কোথায়’। যার প্রযোজক ছিলেন ফরিদি নিজেই। ছবিটি ঈদের ছবিগুলোর সাথে মুক্তি পেলো কিন্তু ফলাফল খুবই খারাপ। অর্থাৎ ছবিটির গল্পে নতুনত্ব ও নির্মাণে মুন্সিয়ানা থাকলেও দর্শক ছবিটি গ্রহন করেনি। ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয় ফরিদির প্রযোজিত প্রথম ছবিটি যার ফলে দ্বিতীয় আর কোন ছবি প্রযোজনা করেনি।

এরপর খোকন, রুবেল ও ফরীদি ফিরে আসেন দুর্দান্ত ‘বিশ্বপ্রেমিক’ দিয়ে। যা ছিল সেই বছরের সেরা ১০টি ব্যবসাসফল ছবির একটি। ছবিটির গল্প অন্য সবগুলো ছবির চেয়ে আলাদা, হুমায়ুন ফরীদিকে কৌতুক ও খল দুইভাবে উপস্থাপন এবং আলম খানের সুরের একাধিক দুর্দান্ত গান ছিল ছবিটির প্রাণ। এরপর রুবেলকে নিয়ে ঘাতক ও ভণ্ড সুপারহিট লম্পট ও নরপিশাচ নামক দুটি ছবিতে খোকন রুবেল ও ফরীদিকে দর্শক পায় ।

একটানা চারটি সুপারহিট ও হিট ছবির পর খোকন আবারও রুবেলকে ছাড়া আরেক মার্শাল আর্ট হিরো আলেকজান্ডার বো কে নিয়ে ‘ম্যাডামফুলি’ নামক একটি নারীকেন্দ্রিক ছবি তৈরি করেন যা ছিল চিত্রনায়িকা শিমলার প্রথম ছবি।

‘ম্যাডামফুলি’র গল্প ও শিমলার দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণে ছবিটি দর্শক প্রিয়তা পায়। প্রথম ছবিতেই শিমলা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এই ছবিতে আরও ছিলেন ববিতা, ফরীদি ও শামসুজ্জামান। ‘ভণ্ড’ ছবির পর এখানেও ফরীদি ও শামসুজ্জামানের কৌতুক রসায়ন দর্শকদের চরম আনন্দ দেয়।

এরপর আবার রুবেল, শিমলা, ফরীদি ও শামসুজ্জামানকে নিয়ে আরও একটি রোমান্টিক কমেডি ছবি ‘পাগলা ঘণ্টা’ নির্মাণ করেন যা দর্শকপ্রিয়তা পায়। এরপর আবারও রুবেলবিহীন খোকন নির্মাণ করেন সেই সময়ের দুর্দান্ত ফরমে থাকা চিত্রনায়ক মান্নাকে নিয়ে ‘ভেজা বিড়াল’। গল্প, নির্মাণ, মান্নার অভিনয় সবকিছু ঠিক থাকার পরেও দর্শকপ্রিয়তা পায়নি যার ফলে মান্নাকে নিয়ে আর কোন ছবি তৈরি করেননি খোকন। এরপর আবার রুবেলকে নিয়ে তৈরি করেন এই দশকে ‘যোদ্ধা’ ছবিটি । এরপর ‘মুখোশধারী’ ছবিতে রুবেল ও শাকিব খান এবং সর্বশেষ ‘চাই ক্ষমতা’ রুবেলকে নিয়ে নির্মাণ করেন। সেটাই সম্ভবত খোকনের সাথে রুবেলের শেষ কাজ ছিল ।

এরপর খোকন ইমপ্রেস টেলিফিল্মের মাধ্যমে ‘লাল সবুজ’ নির্মাণ করেন যার নায়ক ছিল মাহফুজ আহমেদ। এই ছবিটিও তেমনভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি যেমনটি খোকনের আগের ছবিতে পাওয়া যেতো। এরপর থেকে খোকন একটা লম্বা বিরতি দিয়ে শাকিব খানকে নিয়ে তৈরি করেন ‘টাকা’ এবং এরও অনেকদিন পর নির্মাণ করেন ‘ভণ্ড’ ছবির সিকুয়্যাল ‘চেহারা ভণ্ড ২’, যা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর আর খোকনের নতুন কোন ছবি দেখা যায়নি।

শহীদুল ইসলাম খোকনের পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যর পাল্লা অনেক অনেক ভারি। সাফল্যর কাছে ৩/৪ টি ছবির ব্যর্থতা কিছুই নয়। খোকন যে মেধাবী ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। যে খোকন আমাদের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের শেষ দেড় দশক সহ তিন দশকে অনেক অবদান রেখেছেন তাঁর বিনিময়ে খোকনকে সেভাবে মূল্যায়ন করতে আমরা পারিনি যা আমাদের ব্যর্থতা। খোকনকে নতুন প্রজন্মের সিনেমার দর্শকরা চিনুক আর নাই চিনুক খোকনের নাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরাদের তলিকায় চিরদিন রাখতেই হবে। বাংলা সিনেমাপ্রেমিদের কাছে খোকন-রুবেল জুটির নাম চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

উপমহাদেশে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র জগত বলিউড যখনও মার্শাল আর্ট নির্ভর ছবি তৈরি করতে পারেনি সেখানে খোকন একের পর এক মার্শাল আর্ট ভিত্তিক অ্যাকশন ছবি দিয়ে সাফল্য পেয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশে মার্শালআর্ট জনপ্রিয় করার পেছনে পরিচালক খোকন- রুবেল জুটির অনেক অবদান যা অনস্বীকার্য।

খোকনের মতো একজন পরিচালক বলিউড পেলে অনেক দূর এগিয়ে যেতো এবং যথাযথ মূল্যায়ন করতো এটা বলা যায়। অথচ এই খোকন জীবিত থাকাবস্থায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আরও অনেক কিছু দেয়ার ক্ষমতা ছিলো কিন্তু আমরা তা নিতে পারিনি যা আমাদের চিরকালের একটি বদস্বভাবের উদাহরণ ছাড়া কিছুই নয়। আমরা গুণীদের সম্মান ও মূল্যায়ন করতে জানি না তাই তো আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্প ৯০ দশকের চলচ্চিত্রের চেয়েও অনেক পিছিয়ে আছে যা দেখলে শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না।

আমরা কি পারি না আবারও একজন শহীদুল ইসলাম খোকনের মতো মেধাবী পরিচালক ও রুবেলের মতো মার্শাল আর্ট হিরো জুটির মাধ্যমে আমাদের প্রিয় চলচ্চিত্র শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে?


Leave a reply