গতানুগতিকের ভিড়ে সত্যিকারের নির্মাতা শাফায়েত মনসুর রানা
ম্যারাথন, রিভিশন, হাতটা দাও না বাড়িয়ে, উচ্চ মাধ্যমিক পরিবার, এক্স ওয়াই জেড, এক্স ওয়াই জেড রিটার্নস, ভিটামিন টি, চার সপ্তাহ, আমরা ফিরব কবে, অ্যাওয়ার্ড নাইট, আমার নাম মানুষ, সব মিথ্যে সত্য নয়, আমাদের সমাজবিজ্ঞান, ক্যাফে ৯৯৯, প্রেসার কুকার, মশাল এবং আকাশ ভরা তারা।
যে তালিকাটি দেয়া হলো একজন পরিচালকের কাজের মধ্যে যে কতটা ভেরিয়েশন থাকতে পারে তারই নমুনা এটা। পরিচালক শাফায়েত মনসুর রানা নিজের নির্মাণের ধরনটিকে এমনভাবে গড়ে নিয়েছেন সেখানে তাঁর নামই একটা ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে।
আজকালকার নির্মাতাদের সবচেয়ে কমন যে সমস্যাটা দেখা যায় একটা কাজ জনপ্রিয়তা পেলে ঠিক তার মতোই আরো কাজ করতে থাকে। দর্শক চাইবে হিট হবে ভিউ হবে এ ধরনের মানসিকতা থেকে কাজ করে কিন্তু এর বাইরে একদম নিজস্ব একটা ধরন তৈরি করে কাজ করে যাচ্ছেন শাফায়েত মনসুর রানা। আপনি কোনোভাবেই তার একটা কাজকে অন্য কাজের মতো পাবেন না। প্রতেকটি কাজ আলাদা সেটা হোক টেলিফিল্ম, নাটক কিংবা শর্টফিল্ম। বিষয়বৈচিত্র্যে, বক্তব্য আলাদা রেখে তাঁর প্রত্যেকটি কাজই একটার থেকে আরেকটা আলাদা করা যায় এবং এভাবেই তিনি তৈরি করেছেন তাঁর আইডেন্টিটি।
দেখে নেয়া যাক তাঁর কাজের ভেরিয়েশন। প্রথমদিকের ‘ম্যারাথন’ নাটকের কথা যদি বলি একজন নির্মাতার প্রথমদিকের কাজই এত ম্যাচিউর কীভাবে হয় নাটকটি দেখার সময় এটা মনে হবে। আনিসুর রহমান মিলনের অভিনয়ের একটা স্পেশালিটি তিনি তুলে ধরেছেন এ নাটকে। একটা মানুষকে সারাদিন দৌড় করানো হচ্ছে সে জানে না কে তাকে দৌড় করাচ্ছে অফিসের চাপের মধ্যেও। ঠিক নাটকের ক্লাইমেক্সে গিয়ে দর্শককে ধাক্কা দিয়ে দিচ্ছে যার জন্য মিলন নিজেও প্রস্তুত ছিল না। এটাই তো নাটকের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।
‘রিভিশন’ নাটকের কথা বলি। এ নাটকটিকে অনেকে রোমান্টিক বলবে হয়তো টিপিক্যাল সেন্সে কিন্তু না এটি রোমান্টিকের আড়ালে সূক্ষ্ম বক্তব্যধর্মী নাটক। বহুগামী সম্পর্কের ভিড়ে বিবেকজাত যে আত্মশুদ্ধি তারই একটা মেসেজ আছে।
‘হাতটা দাও না বাড়িয়ে’ অল্প সময়ের মধ্যে আপনাকে একটা ভালো লাগার মধ্যে নিয়ে যায়। মা, মাতৃত্ব, সম্পর্ক, ভুল এসব জীবনমুখী বিষয়গুলোকে উপলব্ধি করাবে নাটকটি। আর যারা বলে বেড়ায় মেহজাবিন এখন কাঁদতে শিখেছে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এ নাটক মেহজাবিন প্রথমদিকেই কত চমৎকার কেঁদেছে এবং কোনো রকম অতি কিছু নেই একদম ন্যাচারাল। এখন ওয়েব সিরিজ, ওয়েব ফিল্মে যে ধরনের থ্রিলার দেখানো হয় তার মধ্যে বেশিরভাগই রিপিটেশনে ভরা, ক্লাইমেক্স আগে থেকে আঁচ করা যায়, মজাটা থাকে না শাফায়েত মনসুর রানা-র ‘এক্স ওয়াই জেড, এক্স ওয়াই জেড রিটার্নস, চার সপ্তাহ’ এগুলো থ্রিলারের রিয়েল টেস্টটা দেয়।
এক ‘অ্যাওয়ার্ড নাইট’-এর মতো মারাত্মক স্যাটায়ারধর্মী কাজ কয়জন করে দেখিয়েছেন! পুরস্কার যে কীভাবে দূষিত রাজনীতির পড়ে যায় আর হাসির পাত্র হয়ে যায় তারই একটা উপস্থাপন আছে এ নাটকে।
নাটকে ফ্যামিলি স্টোরি আজকাল গদগদ হয়ে কান্না করে দেয়া বা ইমোশনাল কোনো সস্তা টপিকে নিতে পারলে কাড়ি কাড়ি ভিউ পাওয়া যাবে এভাবেই চলে। একটু কান্না করাতে পারলেই যেন কেল্লা ফতে। কিন্তু শাফায়েত মনসুর রানা অন্যভাবে দেখাচ্ছেন। তিনি বলছেন অঝোরে চোখের জল ফেললেই ফ্যামিলি স্টোরি হয় না এটিকে লজিক্যালি পয়েন্ট আউট করতে হয়। যেমন ধরুন ‘আমরা ফিরব কবে, সব মিথ্যে সত্য নয়, আমাদের সমাজবিজ্ঞান, উচ্চ মাধ্যমিক পরিবার’ নাটকগুলো। একটিও সস্তা ইমোশন তুলে ধরেনি। বাস্তবিক পারিবারিক বিষয়গুলোকে লজিক্যালি তুলে ধরেছে সাথে গভীর জীবনদর্শন আছে। আপনি দেখতে দেখতে যদি কাঁদেনও সেটা প্রেমিক চলে যাচ্ছে আর প্রেমিকা মাটির ব্যাংক দিয়ে তাকে সাহায্য করছে এ ধরনের টিপিক্যাল ইমোশন দেবে না, দেবে সম্পর্কের জটিল কোনো সমীকরণ থেকে উঠে আসা লজিক্যাল ডিপ ইমোশন।
পরিবার থেকে বের হয়ে রাস্তার যে জীবন সেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত শিক্ষিত লেবাস ধারণ করেও যেসব ভুল করে যাচ্ছে তাকে নির্মাতা দেখান ‘আমার নাম মানুষ’ নাটকে। দেখতে দেখতে আপনারও মনে হবে যে সমস্যাগুলো দেখানো হয়েছে সজ্ঞানে বা অসচেতনতায় নিজেরাও সেসব ভুল করে থাকবেন। এই সেন্সটাকে গ্রো করানোর মতো নাটক এটি। প্রেমিক-প্রেমিকা, দম্পতি বা অন্য সম্পর্কগুলোর ভিত্তি, বিশ্বাস, বিবেককে জাগানো এসব জরুরি বিষয়ে আলো ফেলা কাজ ‘ক্যাফে ৯৯৯।’
কমেডির নামে যেসব ভাঁড়ামি এখন ইউটিউব দখল করেছে তাদের জন্য জাস্ট একটাই স্টাডি পার্ট ‘ভিটামিন টি।’ হুমায়ূনীয় কমেডির ক্লাস না হয় বাদই দিলাম তাঁর পরবর্তী সময়ের কমেডি নাটকের ক্লাস নতুন করে কীভাবে দাঁড়াতে পারে তার একটা উদাহরণ এ নাটক। শর্টফিল্মের মজা, চমক, ক্লাইমেক্সের আকর্ষণ, মেসেজ এসব বিবেচনায় ‘মশাল, প্রেসার কুকার, আকাশ ভরা তারা’ ক্রিয়েটিভ কাজ।
এই কাজগুলো স্বতন্ত্র, বেছে নেয়া যায় একটা আরেকটার থেকে। এভাবেই একজন শাফায়েত মনসুর রানা স্টেরিওটাইপ, রিপিটেশনে ভোগা, আত্মতৃপ্তিতে ভারাক্রান্ত সময়ের নির্মাতাদের ভিড়ে নিজে একটি আইডেন্টিটি তৈরি করেছেন। সময়ের চাহিদায় সচেতন দর্শকের যে প্রজন্মটি ফিকশনের প্রকৃত টেস্ট খুঁজে বেড়ায় তাদের জন্য একজন শাফায়েত মনসুর রানা একটি নির্ভরতার নাম। আগামীর নির্মাতাদের জন্য এ নামটি শিক্ষণীয় এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।