গল্প-অগল্পের সীমাভেদী ‘দেলুপি’
ঘণ্টা কয়েক আগে জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভ মিলনায়তনে ‘দেলুপি’র প্রেস অ্যান্ড ক্রিটিক শো হলো। এর ঠিক আগের দিনই স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পেয়েছে। নির্মাতাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর সারাদেশ ও বিশ্ব ঘুরতেও ছবিটা বের হবে। বা এরকমই আশা। তাঁরা আরও জানিয়েছেন যে যে-অঞ্চলে এর চিত্রায়ন, যাঁদের নিয়ে চিত্রায়ন তাঁরাই ছবিটা আগে দেখেছেন। সেরকমই নির্মাণকালে তাঁরা কথা দিয়ে এসেছিলেন। সেটা ঘটেছে ৫ নভেম্বর।

দাওয়াতপত্রে তাঁরা লিখেছিলেন নির্মাণে মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম ও দল। নির্মিত চলচ্চিত্রটা দেখলে দর্শকদের সেটা হাড়ে-হাড়ে প্রতি মুহূর্তে মনে হতে বাধ্য। তদুপরি, যাঁরা এই নির্মাতাকে (ও নির্মাণ দলকে) ‘শাটিকাপ’ ওয়েবসিরিজ থেকেই লক্ষ্য করেছেন তাঁদের জন্য ‘দল’ বিষয়টা বুঝতে খুব অসুবিধা হবার কথা নয়।
গত বছরের আগস্ট মাসের ঠিক পরপরই বাঁধ ভেঙে খুলনার কিছু অঞ্চল তলিয়ে যাবার ঘটনা জানবার পর সেখানে এই নির্মাতা দল চলে যান। সেখানকার অধিবাসীদের সাথে সেসব সমস্যা সমেতই জীবন যাপন করেন। এক ধরনের নথিকরণ বা ডকুমেন্টেশনের আগ্রহ তাঁদের ছিল। আর ছিল বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে বিপদাপন্নদের মতো করে থাকা। সেই নথিকরণ থেকে ডকুমেন্টারি একটা তাঁদের হয়েছে বলে তাঁরা জানান। কিন্তু এটা একটা কাহিনিচিত্র। বেশ আটপৌরে-অথচ-জমজমাট, সূক্ষ্ম-অথচ-সাসপেন্সময়, গাল্পিক-অথচ-প্রামাণ্যধারী একটা ছায়াছবি। তবে নির্মাতাদের ঘোষণা যেহেতু এটা কল্পকাহিনি, গ্রাহক হিসেবে সেই সত্য ধরেই থাকা ঠিক হবে।

তাওকীরের কাজে রসবোধ তীব্র। আগেও তাই ছিল। সঙ্গীত একটা ডিসরাপশন সমেত সচেতনভাবে-প্রয়োগকৃত-উচ্চকিত। দৃশ্যায়ন প্রায়শই প্রচলিত এইসথেটিক্সের সুতো কেটে দেবার মতো করে দাঁড় করানো। অভিনয় মারহাবা। তাঁর/তাঁদের আগের কাজগুলোর মতোই স্থানীয় ও ‘জ্যান্ত’ মানুষজন অভিনয় করেছেন। এই ধরনের পার্থিব-মানুষদের-অভিনেতা-বানানো একটা সচেতন পরিচালকীয় দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে পৃথিবীর কোথাও কোথাও আত্মপ্রকাশ করেছে, এমনকি আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেও – তামিলনাড়ু, কেরালা, মহারাষ্ট্র সমেত। সনাতনী অভিনয়ধারার পক্ষ থেকে এগুলো নিয়ে সন্তোষ ও সংঘর্ষ দুই-ই আছে। তবে সে আরেক আলাপ।
‘দেলুপি’র গল্পরেখায় অনেকগুলো ছোট গল্পস্রোত আছে। মাথা খাটালে (দর্শক হিসেবে) অনুভব করা সম্ভব, বিশেষ করে যদি আপনি নির্মাতাদের নির্মাণকাল আর নির্মাণপদ্ধতি যা তাঁরা বলেছেন সেটুকু মনে রেখেই বিশ্লেষণ করেন, এই ছোট-গল্পস্রোতগুলো স্থানীয় জনপদীয় জীবনযাপন থেকে পেয়ে থাকবার কথা। সেগুলোর মিশেলও রসিক ও সাবলীল (স্মুদ)। তারপরও পাঁচটা অণুগল্প বা গল্পটুকরা প্রধান বলে বিবেচিত হতে পারে বোধহয় – যাত্রাপালায়-নিবেদিত-প্রাণ একটা দলের যাত্রা করতে পারা বা না-পারার টানাপড়েন; এই অঞ্চলটা যে রাষ্ট্রের অংশ সেখানকার কেন্দ্রীয় শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন, শাসকের উৎপাটন ও পলায়ন; সেই বদলে আকস্মিক অঞ্চলের/গ্রামের দীর্ঘদিন ক্ষমতাচ্যুত অংশের ক্ষমতা দখল; পানির তোড়ের মুখে ভেঙে যাওয়া বাঁধের পুনর্গঠন; এবং অবশ্যই প্রায় কিশোর পার্থ ও প্রায় কিশোরী মেয়েটির (নাম তো গেলাম ভুলে, মনে পড়লে পরে বসিয়ে দেব) প্রণয়-পরিণয়।

যতোই নায়ক-নায়িকা প্রেম বা দৌড়াদৌড়ি করে পালিয়ে বিয়ে করুন না কেন, এই পাঁচটা গল্পসূত্রের মধ্যে সবচেয়ে অন্তর্ভেদী/ইন্টারসেক্টিং চরিত্রটি হলেন মিহির। সম্ভবত গল্পসূত্রে মিহিরের রাজনৈতিকতার গঠন বেশ ভাল রকম কম দানা বেঁধেছে। মানে দর্শকের জন্য কনভিন্সিং যুক্তিসূত্র কম ছিল। এটা আরও কম পাওয়া গেছে কেন্দ্রীয় শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনজনিত কারণে তাঁর পলায়নের বিষয়ে, এবং বিশেষত সেটার সাথে মিহিরের সম্পৃক্তির বিষয়টা। সেই অর্থে দর্শকের যদি গল্পমালাতে দুচারটা পুঁতি কম মনে হয়, দর্শককে আমি দোষ দেব না।
সমাপনীতে মানববন্ধনের দৃশ্যটা দুর্দান্ত। আরও দুর্দান্ত সেখানেই ‘কংসবধের পালা’টা মঞ্চস্থ হবার চিন্তাটা। আর সেই সাথে বিয়াটা দিয়ে ফেলার বুদ্ধি। নির্মাতাদল তরফে মাস্টারস্ট্রোক। তবে বাঁধভাঙা মানুষের বাঁধের ইচ্ছেতে মানববন্ধনের ইচ্ছাটাকে অতি-নাগরিক মনে হতে পারে। কিন্তু, ঢাকার আন্দোলনকারীরা গত এক দশকে আর কীইবা করেছেন যে নির্মাতা/দল বা ‘দেলুপি’র মানুষজন আর কোনো রাজনৈতিক কল্পনা করবেন?
সব কিছু বাদ। যদি প্রান্তিক জনপদের জীবনে লাগাতার সংকট আর রসের মাখামাখি দেখতে চান, যদি মানডেইন/আটপৌরে মুহূর্তের ‘নাট্য’ দেখতে রসগ্রাহী হন আপনি, চলচ্চিত্রনির্মাণের আনঅর্থোডক্স রাস্তায় উৎসাহ থাকে আপনার, আর অতি অবশ্যই যদি দুর্দান্ত পর্দাাভিনয় দেখতে চান, চোখ বুঁজে একবার ‘দেলুপি’ দেখে আসা আপনার টু-ডু লিস্ট।





