Select Page

গোল্ডেন বাঁশ অ্যাওয়ার্ডস ২০১৮

গোল্ডেন বাঁশ অ্যাওয়ার্ডস ২০১৮

সিনেমায় ভালো পারফরম্যান্সের জন্য সারাবিশ্বে দেওয়া হয় বিশেষ সম্মাননা বা পুরস্কার। কিন্তু ১৯৮১ সাল থেকে আমেরিকায় সবচেয়ে বাজে সিনেমাগুলোকে পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, নিম্নমানের সিনেমা নির্মাণ বা এই ধরনের সিনেমায় কাজ করতে নির্মাতা ও কলাকুশলীদের অনুৎসাহিত করা। হলিউডে দেওয়া এই পুরষ্কারের নাম “Golden Raspberry Awards”। এর দেখাদেখি ২০০৯ সালে ভারতে শুরু হয় ‘Golden Kela Awards’।

আমাদের দেশেওতো কত আজেবাজে সিনেমা নির্মিত হয়। তাই ২০১৪ সাল থেকে আমরাও আমাদের দেশের সবচেয়ে বাজে সিনেমাগুলোকে পুরস্কৃত করা শুরু করি। আমাদের ঢালিউডে এই পুরষ্কারের নাম দেওয়া হয়েছে Golden Baash Awards বা গোল্ডেন বাঁশ অ্যাওয়ার্ডস।

২০১৮ সালের যে সকল সিনেমা ও কলাকুশলীরা আমাদের বিনোদনের নামে বাঁশ দিয়েছেন তাদের এবারের পুরস্কার দেওয়া হবে-

সবচেয়ে বাজে সিনেমা : প্রেমের কেন ফাঁসি
এখন অব্দি বাংলায় যত ফোক-ফ্যান্টাসি ঘরানার ছবি হয়েছে, সেই ঘরানার ছবিগুলোর মুখে আজীবন চুনকালি হয়ে লেগে থাকবে এই ছবিটি। কস্টিউম, মেকাপ, লোকেশন কোনো ভালো বৈশিষ্ট্য দেখে বিচার করা সম্ভব হয় নয় এটি একটি ফ্যান্টাসি ছবি। ইনফ্যাক্ট, এটা একটা সিনেমা এই কথাটিও বিশ্বাস করা কষ্টকর। তার ওপর রয়েছে জোরপূর্বক আদায় করা টাইপ অভিনয় এবং যুগ যুগ ধরে ঘষাপেটা করে আসা মুখস্থ ডায়ালগ। সব মিলিয়ে ছবিটি দেখতে বসলে অবশ্যই আপনাকে ‘ধৈর্য’ নামের অগ্নীপরৗক্ষার সম্মুখীন হতে হবে।

সবচেয়ে বাজে পরিচালক : উত্তম আকাশ (ধুসর কুয়াশা)
উত্তম আকাশের পরিচালনার প্রায় দুই যুগের অভিজ্ঞতা যেন দিনকে দিন ‘ধুসর কুয়াশা’র মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি এখন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। এ ছবিতে তিনি সঠিক ডিরেকশন তো দিতেই পারেননি, উপরন্তু নিপুনের মতো ভালো একজন অভিনেত্রীকে কুরুচিপূর্ণ পোশাক পরিয়ে সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। এই ক্যাটাগরিতে অবশ্য তার প্রতিদ্বন্দ্বীও কম না। অনেক হেভিওয়েট পরিচালকও আছেন যাদের নামের পাশে পুরস্কারটি যেতে পারতো। তবে অন্যান্যদের তুলনায় বাজে ডিরেকশনে তিনি বেশ শক্ত অবস্থানে, তাই এই পুরস্কার তার হাতেই মানায়।

সবচেয়ে বাজে অভিনেতা : আদনান আদি (প্রেমিক ছেলে)
‘আমি প্রযোজক তাই যা মনে আসবে তাই করবো’ এই নীতিতে বিশ্বাসী একজন অভিনেতা কতটুকু সুঅভিনয় দেখাবেন, সেটা বোঝার জন্য মোটেও ফিল্মবোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। নাচ, ফাইট, লুক, অভিনয়, এক্সপ্রেশন সবদিক থেকে তিনি ফেইল মারলেও এই এ্যাওয়ার্ডের প্রতিযোগিতায় তিনি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন।


সবচেয়ে বাজে অভিনেত্রী : নিঝুম রুবিনা (মেঘ কন্যা)
ছবির গল্প ভালো হলেও, তিনি যে চরিত্রটি রূপদান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তার জন্য তিনি একদমই মানানসই ছিলেন না। তবে তিনিও ‘আমি প্রযোজক তাই যা মনে আসবে তাই করবো’ টাইপ নীতিতে বিশ্বাসী। ফলাফল ছবিটি বাজে অভিনয়ে বারবার মার খেয়েছে। ট্রেলারেও সেই ছাপ স্পষ্ট, যার দরুণ ছবিটি মুক্তির আগে কোনো হলমালিক ছবিটি নিতেই রাজি হয়নি! শেষমেষ জোর-জবরদস্তি করে, অন্য ২-৩ ছবিকে মামলা দিয়ে আটকে, তারপরে হলে চালানোর ব্যবস্থা করা হলো।

সবচেয়ে বাজে খল অভিনেতা : জয়রাজ (মাতাল)
নিঃসন্দেহে জয়রাজ একজন সুঅভিনেতা, ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘কমলা রকেট’ ছবিতে তার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছি। কিন্তু ‘মাতাল’ ছবিতে ভিলেনের চরিত্র রূপদান দিতে গিয়ে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলার গতানুগতিক খলচরিত্র তার জন্যে নয়, ভবিষ্যতে ছবি বাছাইয়ের প্রতি তিনি যদি মনোযোগী না হন, তবে এই পুরস্কার পরবর্তীতে তিনি আবারও পেতে পারেন।

সবচেয়ে বাজে পার্শ্ব অভিনেতা : জয়ী দেব রায় (মনে রেখো)
সাধারণত আমাদের দেশে ভিনদেশি কাউকে পুরস্কৃত করা হয় না। তবে এক্ষেত্রে আমাদের মনে হলো ভারতের এই অভিনেতা অন্যান্যদের থেকে যোজন পরিমাণে এগিয়ে। ছবিতে তার চরিত্রে একটা ডাইমেনশন ছিল, ভালো অভিনয় করার সুযোগ ছিল, সিনেমাকে জমাট বিনোদনে নেওয়ার সুযোগও ছিল। কিন্তু তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সব ক্ষেত্রেই ডাহা ফেল মেরেছেন। তাই এই পুরস্কারটির যোগ্যতম দাবিদার তিনিই।

সবচেয়ে বাজে পার্শ্ব অভিনেত্রী : দুলারী (পাংকু জামাই)
ম্যাডামের অভিনয় এবং সাজসজ্জা দেখে আপনার এক পলকের জন্যও মনে হবে না, ইনি ছবিতে দাদীর রোল প্লে করছেন! একসময়ের নেগেটিভ রোল দিয়ে দর্শকমন জয় করা এই অভিনেত্রী ‘পাংকু জামাই’ ছবিতে চওড়া মেকাপ এবং রসকষে ভরা অভিনয় দিয়ে তিনি এই পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছেন।

সবচেয়ে বাজে নবাগত অভিনেতা : শাহের খান (পাগল মানুষ)
উনার অভিনয় দেখে আমার মস্তিষ্কে একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খেয়েছে, ঠিক কোন ট্যালেন্টের বিচারে শাবনূরের বিপরীতে অভিনয় করার সুযোগ দেওয়া হলো? পুরো ছবিজুড়ে তাকে অভিনয় করার নানারূপ চেষ্টা করতে দেখা গেলেও, তিনি দিনশেষে ব্যর্থই হয়েছেন। তাই তার শতচেষ্টার বদৌলতে এই পুরস্কার যাওয়া উচিত তারই হাতে।

সবচেয়ে বাজে নবাগত অভিনেত্রী : সুস্মি রহমান (আসমানী)
সুন্দরী এই মডেল পর্দাজুড়ে তার সৌন্দর্য ছড়ালেও অভিনয়ে তিনি সেই দ্যুতি ছড়াতে পারেননি। ছবির গল্পটি তার চরিত্রের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল, যার দরুণ তার দূর্বল অভিনয় ছবিটিকেও আক্ষরিক অর্থে অনেকখানি দুর্বল করে ফেলেছে।

সবচেয়ে বাজে গান : ফিফটি ফিফটি লাভ (ফিফটি ফিফটি লাভ)
গানটির সুর নির্লজ্জভাবে তেলেগু ছবি ‘বদ্রিনাথ’র (২০১১) ‘নাথ নাথ’ থেকে হুবহু তুলে আনা হয়েছে। দক্ষিণের সুপারস্টার আল্লু অর্জুনের দুর্দান্ত ড্যান্স পারফরমেন্সের জন্য গানটি বেশ জনপ্রিয়। সেরকম একটি গানের সাথে উদ্ভট কথা এবং নাচ মিশিয়ে এতো বাজেভাবে উপস্থাপন করায়, এই পুরস্কার তাদেরই প্রাপ্য।

আরও পড়ুন : ২০১৮ সালের সেরা ছবিগুলো

সবচেয়ে হতাশাজনক সিনেমা : মিস্টার বাংলাদেশ
ক্রাইম ড্রামা জনরার এছবিটি নিয়ে গণমানুষের অনেক আশা ছিল। প্রথমবার জঙ্গিদের জীবনাচরণ নিয়ে কেউ পূর্ণাঙ্গ ছবি বানানোর সাহস দেখিয়েছে, প্রত্যাশা থাকাই স্বাভাবিক। ট্রেলার কিংবা এর গানেও সেই প্রত্যাশার ছাপ ফুটে উঠছিল। কিন্তু ছবিটি মুক্তির পর বাজে চিত্রনাট্য এবং অভিনয়ের কারণে চরম সমালোচিত হয়। ছবিটি দেখে সব শ্রেণীর দর্শক হতাশ হন এবং একটি ভালো আইডিয়ার অপমৃত্যু ঘটে।

সবচেয়ে বাজে রিমেক সিনেমা : ক্যাপ্টেন খান
বছরের সবচেয়ে স্বস্তির খবর হলো, মুক্তি পাওয়া ৪৪টি ছবির মধ্যে মাত্র তিনটি ছবি রিমেক/নকল। অথচ ২০১৭ সালে নকল ছবির পরিমাণ ছিল মোট মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির প্রায় এক তৃতীয়াংশ। তিনটি ছবির মধ্যে একমাত্র নকল ছবি হলো ‘ক্যাপ্টেন খান’, যার গল্প, ক্যামেরাওয়ার্ক এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তামিল ছবি ‘আনজান’ (২০১৪) থেকে হুবহু দেখে বানানো হয়েছে। আর এক্ষেত্রে কোনোরূপ রাইট কেনা হয়নি। প্রযোজক হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পরও স্বৗকার করতে রাজী নন, তার ছবিটি মৌলিক নয়।

সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে বাজে উপস্থাপন : আসমানী
ছবিটি নির্মিত হয়েছে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত কবিতা ‘আসমানী’র ছায়া অবলম্বনে। ছোট্ট এই কবিতাখানা নিয়ে কেন তাদের এক‌টি পূর্ণাঙ্গ সিনেমা তৈরির খায়েশ জাগলো, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। চিত্রনাট্যে নানারকম গোঁজামিল পাকিয়ে ছবিটিকে সম্পূর্ণ হ য ব র ল রূপে উপস্থাপন করার পর আমাদের মনে হয়েছে, এই পুরস্কারের জন্য এই ছবিটিই যোগ্য।

সবচেয়ে বাজে পর্দা জুটি : মাহিয়া মাহিবনি সেনগুপ্ত (মনে রেখো)
কোরবানির ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘মনে রেখো’ ছবিতে মূল কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা মাহিয়া মাহি এবং ভারতের বনি সেনগুপ্তকে পাশাপাশি দেখে মনে হয়েছে ‘বড় বোন ও ছোট ভাই’। অথচ ছবিতে তাদের চরিত্র ছিল যথাক্রমে ভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রী ও ঐ ভার্সিটিতে একই ক্লাসে পাঁচ বছর আটকে থাকা ছাত্রের। তো, এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ জুটির হাতেই তো এই পুরস্কার মানায়!

নাম বদনাম অ্যাওয়ার্ড (বাজে নামের সিনেমা) : চিটাগাইঙ্গা পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া
২০০৬ সালে পরিচালক উত্তম আকাশ পরিচালনা করেছিলেন ‘ঢাকাইয়া পোলা বরিশাইল্লা মাইয়া’। তখনকার সময়ে অর্থাৎ ৩৫ মি.মি এর যুগে মাস অডিয়েন্সের পরিমাণ ঢের বেশি থাকায় নামটি নিয়ে ততটা সমালোচনা হয়নি। এরপরও ভালো অভিনয় এবং গল্প যথেষ্ট উপভোগ্য হওয়ায় সবাই দারুণভাবেই ছবিটি গ্রহন করেছিল। কিন্তু এই ২০১৮ সালে এসে যদি সেই একই পরিচালক এমন সস্তা বিচ্ছিরি নামের ছবি বানান, গল্প দেখার আগেই ছবির প্রতি একটা খারাপ মনোভাব তৈরী হয়। তাই এই ছবিটিই এবার এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য।

দাঁত ভাঙা অ্যাওয়ার্ড (বাজে ডায়ালগ ডেলিভারি) : কাজী হায়াৎ (চিটাগাইঙ্গা পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া)
উনার মতো একজন বড় মাপের পরিচালকের নাম এই ক্যাটাগরিতে লিখতে একটু হলেও কষ্ট লেগেছে। তবে এটাই সত্যি। কমেডি ঘরানার এই ছবিতে কাজী হায়াতের ডায়লগ ডেলিভারি এতোটাই ধীরগতির, দর্শক হাসবে কি, ডায়ালগ শেষ হওয়ার আগেই সবাই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এমন সব ছবিতে তিনি অভিনয় না করে যদি সিরিয়াস গল্পের ছবিতে কাজ করেন, তবে দর্শকের প্রত্যাশা অনেকখানি পূরণ হবে। কমেডি ছবি উনার জন্য নয়।

আরও পড়ুন : ২০১৮ সালের সবচেয়ে বাজে ছবি

নির্মাতা আর কলাকুশলীদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আপনার টাকা বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিনেমার নামে অখাদ্য বানিয়ে দর্শকদের গেলানোর মত জুলুম করবেন না। এতই যখন নিজের চেহারা সিনেমার পর্দায় দেখার শখ, তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে নিজেরা সিনেমা বানিয়ে সেগুলো নিজেদের বানানো সিনেমা হলেই সপরিবারে দেখুন। সেন্সরবোর্ড পার করে দর্শকদের কাছে নিয়ে আসার মত অন্যায় করবেন না প্লিজ।

(বিএমডিবিতে গোল্ডেন বাঁশ অ্যাওয়ার্ডসের সূচনা করেন হিমু সিনেমাখোর। এবার তার ব্যস্ততার কারণে ও অনুমতিতে লেখক পরিবর্তন হয়েছে। এ তালিকা বিএমডিবি কর্তৃপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি নয়। সম্পূর্ণভাবে লেখকের বিবেচনা। বিভাগীয় সম্পাদক)


Leave a reply