Select Page

গ্রামীণ আবহের দশ বাংলা চলচ্চিত্র

গ্রামীণ আবহের দশ বাংলা চলচ্চিত্র

আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা হচ্ছে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত চলচ্চিত্র। এই ধরনের চলচ্চিত্রে নিখুঁতভাবে সমাজ ও পরিবেশ, মাটি ও মানুষের কথা চিত্রাকারে নিহিত থাকে। যেহেতু একটা সময় আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত তাই এ চলচ্চিত্রগুলোতে উপস্থাপিত লোকজ সংস্কৃতি তাদের স্পর্শ করত বেশি।

মন ও সমাজতাত্ত্বিক নানা ব্যাখ্যা থাকলেও এসব চলচ্চিত্রের আবেদন ছিল অন্যরকম। তেমনি অন্যতম সেরা দশ আবহমান গ্রাম-বাংলার সেরা সিনেমা নিয়ে নববর্ষের এই বিশেষ আয়োজন—

ময়না মতি (১৯৬৯): ‘অনেক সাধের ময়না আমার খাঁচা ছেড়ে চলে যায়’ খ্যাত কাজী জহিরের সিনেমা ‘ময়না মতি’। ময়না ও মতি গ্রামের দুই অবোধ কিশোর-কিশোরী। পড়াশুনার জন্য শহরে চলে যায় মতি, এইদিকে গ্রামে বড় হতে থাকে ময়না, তাকে পছন্দ করে গ্রামের আরেক সহজ সরল কৃষক মনা। গ্রামে ফিরে এসে মতি আবার ময়নাকে ফিরে পেতে চায়, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা এদের ভালোবাসা মেনে নেয় না। গরীব ময়নার বিয়ে হয় অত্যাচারী বৃদ্ধ জমিদারের সঙ্গে, কিন্তু ময়না ও মতির নিখাদ ভালোবাসার পরিণতি কী! গ্রামের দুই সহজ সরল প্রেমিক যুগল ময়না ও মতির চরিত্রে অভিনয় করেন চিরসবুজ জুটি রাজ্জাক-কবরী। সিনেমার পাশাপাশি গানগুলো পেয়েছে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা। পরবর্তীতে এটি আবার ‘অনেক সাধের ময়না’ নামে রিমেক হয়। জাকির হোসেন রাজুর পরিচালনায় এই সিনেমায় ছিলেন বাপ্পী, মাহি ও মিলন।

সুজন সখী (১৯৭৫): দুই গ্রাম্য যুবক-যুবতীর ভালোবাসা, সাথে দুই ভাইয়ের পারিবারিক দন্ধ এই নিয়েই ফারুক-কবরীর জনপ্রিয় সিনেমা ‘সুজন সখি’। খান আতাউর রহমানের কাহিনী, সংগীত, প্রযোজনায় সিনেমার নির্মাণের দায়িত্ব ছিলেন প্রমোদকার।ছবিটি সেই সময়ে দর্শকদের মনে সাড়া জাগিয়ে নাম লিখিয়েছিল বাংলা ছবির সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবির তালিকায়, এই স্থান প্রায় এক যুগের ও বেশি সময় ধরে ছিল।এই সিনেমার ‘সব সখীরে পার করিতে’ গানটিকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রেম নিবেদনের অন্যতম সেরা গান। এই সিনেমার প্রায় দুই দশক পর পরিচালক শাহ আলম কিরণ একই নামে রিমেক করেন, রঙ্গীন সুজন সখী হয়েছিলেন জনপ্রিয় জুটি সালমান শাহ ও শাবনূর। কলকাতাতেও এই বিখ্যাত ছবির রিমেক হয়।

লাঠিয়াল (১৯৭৫): বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ‘লাঠিয়াল’। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত এই সিনেমায় দেখা যায় চর অঞ্চলের শ্রেনী বৈষম্য, লাঠিয়ালদের পরিবারের লড়াই। কাদের মাতবরের হয়ে লাঠিয়ালের কাজ করে, তার ভাই দুখু মিয়া গান গেয়ে বেড়ায়, ভালোবাসে গ্রামের মেয়ে বানুকে। মাতবরের ষড়যন্ত্রে দুই ভাইয়ের মধ্যে দেখা দেয় দ্বন্ধ। এই সিনেমায় অভিনয় করে আনোয়ার হোসেন, ফারুক, রোজী সামাদরা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন, আরো আছেন ববিতা।

নয়ন মনি (১৯৭৬): গ্রাম্য কুসংস্কার, মোড়লের কুটকাচালীর বিরুদ্ধে গ্রাম্য সামাজিক প্রতিবাদী রুপক ভালোবাসার সিনেমা ‘নয়ন মনি’। নয়ন ও মনি দুইটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই সিনেমা বিখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেন নিজের লেখা উপন্যাস ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ অবলম্বনে এটি নির্মাণ করে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও জাতীয় পুরস্কার পান। ফারুক ও ববিতার ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য এই সিনেমা পরবর্তীতে ওমর সানী ও শাবনূরকে নিয়ে রিমেক করেন মতিন রহমান।

বিনি সুতোর মালা (১৯৮০): গ্রামের দুই তরুণ-তরুণীর প্রেমগাঁথার বিয়োগাত্মক পরিণতি নিয়ে ফখরুল হাসান বৈরাগীর সুন্দরতম সিনেমা ‘বিনি সুতোর মালা’। ওয়াসিম-রোজিনা জুটির এই সেরা সিনেমা তখনকার সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, গ্রাম্য আবহে গানগুলো হয়েছিল সমাদৃত। পরবর্তীতে অমিত হাসান ও শাবনূরকে রঙিন ভার্সন নির্মাণ করেন পরিচালক শিল্পী চক্রবর্তী।

নোলক (১৯৮৪): যৌতুকের দায়ে বিতাড়িত হয়ে বোনকে ফিরে আসতে হয়েছে, ভাই পেশায় গাড়িয়াল। কথা দেয়, যৌতুকের টাকা পরিশোধ করেই বোনকে পাঠাবেন। সব স্বর্ণ কেড়ে নেয়ার পর নোলক নিতে চাইলে অস্বীকৃতি জানান দাদী। এইদিকে গ্রামের এক প্রভাবশালীর মেয়ের সাথে মন দেয়া নেয়া হয় গাড়িয়ালের। কিন্তু নোলক নিয়ে বাধে বিপত্তি। গ্রাম্য ধারায় যৌতুকের ভয়াবহতা নিয়ে শিবলী সাদিকের ‘নোলক’ এর গল্প এভাবেই উঠে এসেছিল। প্রানবন্ত চিত্রনাট্য ও সংলাপে এই সিনেমা ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করেছে,খুবই উপভোগ্য সিনেমা। অভিনয় করেছে ফরহাদ, মিন্না খান।

শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯): নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ভালোবাসার সিনেমা ‘শ্রাবন মেঘের দিন’। গায়েন মতি, গ্রাম্য কিশোরী কুসুম, জমিদার নাতনী শাহানা, আর শহুরে যুবক সুরুজের মাঝে যে অব্যক্ত প্রেমের মানসিক টানাপোড়ন, তা দর্শকদের মনে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। দারুণ সব গান, দুর্দান্ত গল্প, নির্মাণশৈলীর কারণে দর্শকমহলে এই সিনেমাটি ভীষণ গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিল, হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা হিসেবে এই ছবিটি স্বীকৃত। জাহিদ হাসান, শাওন, মুক্তি, মাহফুজ আহমেদ অভিনীত ছবিটি দর্শকপ্রিয়তার পাশাপাশি জাতীয় পুরস্কারেও বেশ জয়জয়কার ছিল।

খায়রুন সুন্দরী (২০০৪): ‘খায়রুন লো লম্বা মাথার কেশ, চিরল দাঁতের হাসি দিয়ে পাগল করলি দেশ’- দারুন জনপ্রিয় এই গানের সিনেমা ‘খায়রুন সুন্দরী’। খায়রুন নামের এক গ্রাম্য সুন্দরী কন্যার বিয়োগাত্মক কাহিনী চিত্ররুপ এই সিনেমা বন্যার মাঝেও দারুণ ব্যবসাসফল করেছিল। একে সোহেলের পরিচালনায় এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করা মৌসুমীর অন্যতম সেরা সিনেমা, সঙ্গে ছিলেন ফেরদৌস। চিরায়ত গ্রাম বাংলার গাঁথা হিসেবে এটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

হাজার বছর ধরে (২০০৫): প্রখ্যাত উপন্যাসিক জহির রায়হানের কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ অবলম্বনে সরকারি অনুদানে একই শিরোনামে সিনেমাটি নির্মাণ করেন কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। দর্শকপ্রিয়তার পাশাপাশি ছবিটি সমালোচকদের কাছেও ব্যাপক প্রশংসিত হয়। আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি ছবিটি সেরা চলচ্চিত্র সহ মোট ৭টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। সেরা কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন সাহিত্যিক জহির রায়হান। মন্তু, টুনি, আম্বিয়া, মকবুল বুড়ো চরিত্র-সহ গ্রাম বাংলার আবহমান জীবনধারা, মূল্যবোধ, সম্পর্ক, কুসংস্কার অসাধারণভাবে ফুটে উঠা এই ছবিতে অভিনয় করেছেন রিয়াজ, শশী, এটিএম শামসুজ্জামানসহ অনেকে।

মনপুরা (২০০৯): সোনাই আর পরীর গল্প। নির্জন দ্বীপে খুনের দায়ে পলাতক সোনাইয়ের সাথে মাঝিকন্যা পরীর প্রেমের গল্প। দুরন্ত প্রেম, ভালোবাসার মানুষের জন্য হাহাকার আর শেষে বিয়োগাত্মক পরিণতি। এই নিয়েই ‘মনপুরা’র গল্প। নাট্যনির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিমের পরিচালনায় এই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলি। দর্শক মহলে সিনেমাটি দারুন সাড়া জাগিয়েছিল, নাম লিখিয়েছিল বছরের সবচেয়ে বাণিজ্যিক সফল হিসেবে। শুধু দর্শক নয় মন ভরিয়েছে সমালোচকদেরও। আর তাই জাতীয় পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্রসহ একাধিক শাখায় পুরস্কার অর্জন করে। এই ছবির মাঝ দিয়ে যেন বাংলা চলচ্চিত্র তার পুরনো রুপ খুঁজে পেয়েছিল। শুধু ভালোবাসার সিনেমা হিসেবেই নয়, এই সিনেমার গানগুলোও জনপ্রিয়তায় এখনো শীর্ষে।

এই ধারায় আরও উল্লেখ করার মতো সিনেমার মধ্যে রয়েছে ঘানি (২০০৬, কাজী মোরশেদ) ও মৃত্তিকা মায়া (২০১৩, গাজী রাকায়েত)।


Leave a reply