চমৎকার ছবি ‘গাড়িওয়ালা’র গাড়ি কেন চলে না?
কোরবানির ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি আশরাফ শিশির পরিচালিত ‘গাড়িওয়ালা’। কারণ, ছবিটি এরই মধ্যে ১৯টি দেশের ৫৫টি শহরে ৫৫টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের যোগ্যতা অর্জন করেছে। অর্জন করেছে ২১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। অথচ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর চিত্রটা পুরো উল্টে গেল। প্রেক্ষাগৃহে কপি-পেস্ট ছবির ভিড়ে দর্শকের কাছে আগ্রহের ঘাটতি নিয়েই ‘গাড়িওয়ালা’র গাড়ি চলছে ঢিমেতালে। কারণটা আসলে কী? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা যাক।
‘গাড়িওয়ালা’ একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র। যদিও বিভিন্ন সময়ে নির্মাতার কণ্ঠেই পাওয়া গেছে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়টি মানতে নারাজ। আশরাফ শিশির নাকি ছোট-বড় সবার জন্যই এই ছবি নির্মাণ করেছেন। সত্যিই তাই! সিনেমা দেখার পর এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতেই পারে। তবে চলচ্চিত্রের প্লট থেকে শুরু করে প্রতিটি চরিত্র মনে করিয়ে দেবে সাধারণ একজন মানুষের শৈশবের কথা। কারণ শৈশব হয় দুরন্ত এবং স্বপ্নময়। কিন্তু সব দুরন্তপনার মধ্যে যখন বাস্তবতা প্রবেশ করে ঠিক তখনই একটি শিশু পরিণত বয়সে রূপান্তরিত হয়। গাড়িওয়ালা সেই রূপান্তরিত হওয়ার গল্প।
গল্পপাঠ:
গাড়িওয়ালার গল্প শুরু হয় হাবিল-কাবিল নামে দুই ভাইকে নিয়ে। তাদের সঙ্গে নির্মাতা তুলে নিয়েছেন গ্রাম-বাংলার অপরূপ প্রকৃতিও। যেখানে ফড়িং ওড়ে, সূর্যমুখী খেতের মাঝখানের আইল ধরে দৌড়ে যেতে পারে দুরন্ত শিশুরা, যেখানে ক্রমাগত স্বপ্নবাজ হয়ে ওঠার গল্প তৈরি হয়। সেই হাবিল-কাবিল এমনই এক গ্রামে ছুটে বেড়ায় ক্রমাগত।
তাদের মা চরিত্রে অভিনয় করেছে রোকেয়া প্রাচী। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্ত হাবিল-কাবিলের মা। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে গ্রামের মানুষের কু-দৃষ্টি দর্শককে এই বাস্তব সমাজের চিত্রই দেখাবে। কারণ, এই সমাজে নারী বড় অসহায়। আর তার একা থাকার সুযোগ নেয় কিছু লোলুপ পুরুষ। সেই পুরুষদের কামুক চাহনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই পরিবেশন করেছেন পরিচালক। যেখানে অশ্লীলতা নেই, ইশারা ইঙ্গিতেই তিনি বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন দর্শকদের।
হাবিল-কাবিলের মূল স্বপ্ন একটি বেয়ারিংয়ের গাড়ির মালিক হওয়ার। সেই স্বপ্নে তাদের ঘুম হয় না। তার আগে হাবিল তার ছোট ভাইকেই বলে, আমাদেরও বেয়ারিংয়ের গাড়ি হবে। দুরন্ত শৈশব কখনও হার মানে না। হাবিল-কাবিল হার মানেনি। অন্যের মতো রডের তৈরি কিংবা শক্ত কাঠের তৈরি গাড়ি হয়তো তারা তৈরি করতে পারেনি কিন্তু গাছের ডাল দিয়ে, পুকুরের শাপলা বিক্রি করে সত্যি-সত্যিই বেয়ারিং কিনে তারা ঠিকই গাড়ি তৈরি করে ফেলে। এর নামই তো স্বপ্ন। এর নামই তো শৈশবের দুরন্তপনা।
এই দুই শিশুর মধ্যে দারিদ্র নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই। শুধু আক্ষেপ- বাবার নিখোঁজ সংবাদ। যে অবহেলা-অনাদরের মধ্যে তারা বেড়ে উঠছে, সেখানে বাবা থাকলে হয়তো এমন হতো না, এমনই ভাবনা তাদের। এভাবেই গল্প এগোয়। গল্প কোথায় যাবে, কেউ জানে না। দর্শকও জানবে না। গল্পের ভেতর দিয়ে মায়ের অসুস্থতার সময় হাবিল হয়ে ওঠে দায়িত্ববান পুরুষ। গোপন কষ্ট বুকে চেপে, নিজের মধ্যে রেখে দেওয়ার মধ্যেই একজন শিশু যেন পরিণত হয়ে উঠল। এমনই বার্তা দিয়ে গেছে পর্দার গাড়িওয়ালা। জীবনের গাড়ি সম্পর্কে যেই শিশুর বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, সেই শিশু কষ্টকে আরও না বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে চালকের আসনেই বসে পড়ে। এখানে শেষ হয় গল্প। তবু থেকে যায় তার রেশ। কারণটা নির্মাতাই বলে দিয়েছেন, ‘সব গল্প গল্পকারদের জানা থাকে না।’
পুরো ছবির মধ্যেই শৈশবের অনেক স্মৃতি যেন ফিরে আসে। যেমন সিনেমা প্রচারের অংশ হিসেবে এলাকা এলাকায় মাইকিং করে বেড়ানো। আছে লেইস ফিতা লেইসের সেই বিক্রেতারা, আছে কামার-কুমার, আছে জিলাপি বানানোর দৃশ্যসহ আরও কত কি। শৈশবে যেসব দৃশ্য দেখে বিস্ময় জেগে উঠত তার সব কিছুই আছে গাড়িওয়ালায়।
গৃহে অচল গাড়িওয়ালা:
সম্ভবত এমন শিশুতোষ বিষয় তুলে ধরায় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে গাড়িওয়ালা। তবে বিদেশে সচল গাড়িওয়ালা দেশে কেন এতটা অচল? তারই উত্তর খুঁজে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করা যায় বর্তমান সময়ের যান্ত্রিকতা। এই সময়ের নাগরিক শিশুদের কাছে গ্রামের সেই দুরন্তপনার অনুভূতি প্রায় অজানা। অন্যদিকে দর্শক যে বিনোদন চলচ্চিত্রের মধ্যে খুঁজে বেড়ায় তার তেমন কিছুই নেই গাড়িওয়ালায়।
ছিমছাম সাধারণ গল্পের মতোই এগিয়েছে গাড়িওয়ালা। আছে ছোট্ট ক্লাইমেক্স। যা এই আলোচনায় না বলাই শ্রেয়। তাছাড়া সিনেমার অধিকাংশ সময়ই নির্মাতা দেখিয়েছেন গ্রামীণ প্রকৃতিকে। তিনি যেন বাংলার প্রকৃতির গল্পই বেশি বলতে চেয়েছেন। প্রকৃতির সঙ্গে শৈশবের সম্পর্ক বোঝাতে চেয়েছেন। মাঝে মাঝে হাবিল-কাবিলদের সংগ্রাম আর দুরন্তপনা তুলে ধরেছেন। এই ছবিতে সংলাপ খুবই কম। আঞ্চলিক ভাষায় সিনেমা খুব কম হয় এ দেশে। এক্ষেত্রে সত্যিই এ ধরনের কাজ প্রশংসাযোগ্য। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নির্মাতা ছিলেন পরিপাটি।
এই প্রাকৃতিক সিনেমায় কোনও গান নেই, নাচ নেই, রঙচটা নায়িকা নেই, মারামারি নেই। কোনও ব্যবসায়িক সিনেমার সঙ্গেই তো মেলে না। তাই তো দর্শকও আলোচনা করে না। সুন্দরী নায়িকা, রঙচটা দৃশ্য এ সবই তো দর্শককে টানে। এই রঙের টানের ভেতর এমন মৌলিক সিনেমায় আগ্রহ কেন দেখাবে দর্শক? দর্শক তো বিনোদন চায়। সস্তা বিনোদনের আশায় হাবিল-কাবিলরা যেমন বাস্তবে আলোচনায় থাকে না, ঠিক তেমনি তারা সিনেমাতেও নির্বাক। তাছাড়া গাড়িওয়ালার পুরস্কারের প্রকাশ যেভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঠিক সেভাবে এই চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা নিয়ে বিশেষ আলোচনা নেই কোথাও। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাই যেভাবে বিদেশে প্রচার প্রচারণায় সময় ব্যয় করেছেন ঠিক সেভাবে দেশে প্রচারে তেমন বড় কোনও উদ্যোগও দেখা যায়নি। অনেকেই দাবি করেন, যেসব সিনেমা আগে বিদেশে মুক্তি দেওয়া হয়, সে সব সিনেমার মূল্য উদ্দেশ্যই থাকে পুরস্কার, দর্শককে হলে টানা নয়। ঈদের ঠিক আগেই এমনই একটি ভিন্নধাঁচের সিনেমা ‘জালালের গল্প’ মুক্তি পেয়েছে। ওই সিনেমাও বিদেশে মুক্তি দিয়ে অনেক পুরস্কার নিয়ে এসেছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দেশে তার প্রচার ছিল ব্যাপক। যে কারণে ভিন্নস্বাদের হলেও দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছিল ‘জালালের গল্প’।
‘চলচ্চিত্র’ যখনই বলা হবে, তখনই তার একটি ব্যবসায়িক অবয়বও দাঁড় করানো জরুরি। গাড়িওয়ালা’র বিপণন ব্যবস্থায় দেশের দর্শককে মাথায় রাখা হয়নি বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ভালো দিক-মন্দ দিক:
গাড়িওয়ালা চলচ্চিত্রের গল্প খুব যে শক্ত তাও নয়, সাধারণভাবে এগিয়েছে পুরো গল্প। হুটহাট করে গল্পের মাঝখানে প্রকৃতির অংশ তুলে ধরা অনেকসময় অযথা শট মনে হয়েছে। পুরো ছবিতে যে নান্দনিকতা ছিল তার অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে শেষ দৃশ্যের স্পেশাল ইফেক্ট। শেষ দৃশ্যে বৃষ্টি ও আকাশের বিজলি চমকানোর যে স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে, তা পুরো ছবির প্রাকৃতিক বক্তব্যকে ব্যহত করেছে বলেই মনে হয়। এছাড়া, ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের একটি নির্মাণকে আদৌ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বলা যায় কি না, এ নিয়েও বিতর্ক চলতে পারে। তবে এই ছবির অন্যরকম দিক ছিল অযথা গল্পকে দীর্ঘায়িত করা হয়নি। আর মন্দ দিক হলো, যতটা না পরিচালক গল্প বলেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিয়ে সময় নষ্ট করেছেন। কখনও কখনও কিছু কিছু দৃশ্য বিরক্তেরও কারণ হয়েছে।
যদিও গাড়িওয়ালার লং শটগুলো ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে যখনই হাবিল-কাবিল দৌড়ে যায়, তখন শেষ বিকেলের সূর্য লাল হয়ে ওঠে। আর হাবিল-কাবিল হেঁটে যায়। এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবে না এমন দর্শক খুব কমই পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতিকে তুলে ধরার প্রতিটি দৃশ্যই প্রশংসা করার মতো ছিল। অভিনয়ের ক্ষেত্রে হাবিল চরিত্রে মারুফ শেখ এবং কাবিল চরিত্রে কাব্য খুব সুন্দর অভিনয় করেছে। এছাড়া রোকেয়া প্রাচীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও তার অংশ খুব বেশি নয়। রাইসুল ইসলাম আসাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। মোদ্দাকথা প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে অতিরিক্ত কিছুই দেখাননি পরিচালক। কারণ, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল হাবিল-কাবিলকে তুলে ধরা। তিনি সেদিকেই বেশি মনোযোগী ছিলেন।
গাড়িওয়ালা ছবি এখন পর্যন্ত অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছে, সামনে হয়তো আরও পাবে। একটি চলচ্চিত্রের মূল বিষয় তার পুরস্কার নয়। একটি চলচ্চিত্রের আসল পুরস্কার তার দর্শক। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গাড়িওয়ালার ক্ষেত্রে বিদেশি পুরস্কারের বিষয়গুলোই সামনে আসছে, আলোচনায় আসছে। অথচ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা কমই হচ্ছে। এমনকি সিনেমাহলে দর্শকদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো সাড়াও নেই। অথচ কপি-পেস্ট ছবির প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বেশি। বরং মনে হয়েছে আশরাফ শিশির যদি শুরু থেকেই এটিকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে প্রচার করতেন তবে ভিন্ন মাত্রা যোগ হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। তখন শিশু-কিশোরদের আবদারে বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে হাজির হতেন প্রেক্ষাগৃহে। সঠিক প্রচার কৌশলের অভাবে এ যাত্রায় যেন গাড়িওয়ালা তার আসল যাত্রীদের মিস করে গেল।
যাইহোক, বাস্তবতা হলো গাড়িওয়ালার মতো মৌলিক, নিজেদের গল্প যখন অনাদরে পড়ে থাকে, তখন এর দায় দর্শকদের ওপরই বর্তায়। ‘এদেশে ভালো সিনেমা হয় না’, এমন আক্ষেপ তখন বৃথা হয়ে যায়।
শেরিফ আল সায়ার