চলচ্চিত্রের সব্যসাচী মাহফুজ আহমেদ
দেশীয় চলচ্চিত্রে মাহফুজ আহমেদ দুই ধারার সব্যসাচী শিল্পী। বাণিজ্যিক ও অফট্র্যাক দুই ধরনের ছবিতেই নিজের পারফেকশন দেখিয়েছে। অসাধারণ অভিনেতা তো বটেই তার সাথে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।
মাহফুজের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকুন দেখবেন একটা ভারিক্কি ব্যাপার আছে। ব্যক্তিত্বের জন্য এটা লাগে। ভয়েস আছে ভরাট যেটা লাগে অভিনয়ের জন্য।
বাণিজ্যিক ছবির মাহফুজ ছিল তার সময়ের সেরা তারকাদের সাথে পারফরম্যান্স করা একজন দক্ষ শিল্পী। ‘প্রেমের কসম’ ছবিতে অভিনয় করেছে নায়িকা অন্তরার বিপরীতে। হাছিবুল ইসলাম মিজানের ছবি। ছবির প্রযোজক তখন মাহফুজ সম্পর্কে হাই লেভেলের কমেন্ট করেছিল। এ ছবিতে খালিদ হাসান মিলুর ‘কতদিন দেহি না মায়ের মুখ’ গানটি ব্যবহৃত হয়। গানে মাহফুজ শহর থেকে গ্রামে যায়। অত্যন্ত সুদর্শন দেখতে তখন।
‘আজ গায়ে হলুদ’ ছবিতে প্রেম, বন্ধুত্ব ও ধর্মের অসাধারণ উপস্থাপনায় মৌসুমী, আমিন খানদের সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে। ভারতীয় এক অভিনেত্রীর বিপরীতে ছিল ‘শবনম’ ছবিতে। ফোক ঘরানার এ ছবিতে ব্যতিক্রমী মাহফুজকে দেখা গেছে। ‘কপাল’ ছবিতে শাবনূর, শাকিব খান দুজনের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছে।
প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে যায় বাণিজ্যিক ‘লাল সবুজ’ ছবিতে। ক্যাম্পাস পলিটিক্সের সাথে লোকাল পলিটিক্স মিশে সবসময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক গল্পের ছবি। শহীদুল ইসলাম খোকনের মতো এত ঝানু পরিচালকও মাহফুজকে নিয়ে বাজিটা ধরেছিলেন। মাহফুজ সফলও ছিল। একজন শিক্ষকের সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার ভেতর দিয়ে সমাজকে সন্ত্রাসমুক্ত করা ছিল তার কাজ।
নিজেকে ভাঙাগড়া ছিল মাহফুজের কাজ। অফট্র্যাক ছবির মাহফুজ বাণিজ্যিকের চেয়ে এগিয়ে শতগুণ। তার ছবি নির্বাচনের সচেতনতা যে কানো নতুন শিল্পী যারা ভালো কাজ করতে চায় তাদের জন্য আদর্শ। একজন অভিনেতার ঝুলিতে শ্রাবণ মেঘের দিন, বাঙলা, চার সতীনের ঘর, জয়যাত্রা, মেঘের পরে মেঘ, দুই দুয়ারী, জিরো ডিগ্রী এ ছবিগুলো থাকাটা ঈর্ষণীয়।
জাহিদ হাসান যেখানে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এর টাচি চরিত্র শেষের তিকে মাহফুজ দেখায় চমক। তার লিপে ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটি ছবিতে ভাইটাল রোল প্লে করে।
‘বাঙলা’ ছবিতে নিয়ন্ত্রিত অভিনয় বলে দেয় শাবনূরের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনয়ের পাশাপাশি তার যোগ্য কো-আর্টিস্ট ছিল মাহফুজ। ‘এই শব্দহীন জীবন আর ভালো লাগে না’ এ সংলাপটি ছবিতে মাহফুজের সবচেয়ে টাচি সংলাপ ছিল। বোবা স্ত্রী শাবনূরের সাথে শব্দহীন দাম্পত্য জীবন তার জন্য বেদনার ছিল। দেশের রাজনৈতিক থমথমে পরিস্থিতে তার অভিনয় ছিল মাপা।
শাবনূরের বিপরীতে ‘চার সতীনের ঘর’ ছবিতেও মাহফুজের তুলনা নেই। শাবনূরকে ভালোবাসত। মাঝি বলে সামাজিকভাবে সেটার স্বীকৃতি প্রথমে ছিল না কিন্তু আলমগীর শেষ বয়সে নিজের বহুবিবাহের কুফল বুঝতে পেরে শাবনূরকে তার মতো স্বাধীন করে দেয়। তখন মাহফুজ পায় শাবনূরকে। সামাজিক শ্রেণির দিক থেকে মাহফুজের চরিত্রটি শক্তিশালী ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ছবির মধ্যে অন্যতম সেরা ‘জয়যাত্রা’তে লিডিং ছিল মাহফুজ। রিয়াজের সাথে ‘মেঘের পরে মেঘ’ ছবিতেও দাপুটে অভিনয় ছিল। রিয়াজের বন্ধুর চরিত্রে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে ছবিটি নির্মিত। ‘দুই দুয়ারী’ ছবির মাহফুজ তত স্ট্রং না হলেও তার ভূমিকায় সে নিজেকে প্রমাণ করেছে। একজন প্রেমিক ও রোগীর চরিত্রে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছিল তার চরিত্রের অংশ। শাওনের সাথে ‘বরষার প্রথম দিনে’ গানটিতে অসাধারণ অভিনয় করেছে। রোমান্টিকের বিপরীতে স্যাড ভার্সনের গানে ‘সোহাগপুর গ্রামে একটা মায়াদিঘি ছিল’ এটাতেও খোঁচা খোঁচা দাড়ির মাহফুজ বদলে যাওয়া লুকে অনবদ্য ছিল।
‘জিরো ডিগ্রী’ ছিল সাম্প্রতিক সময়ের সেরা অভিনয়ের ছবি তার এবং জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। বড় বিরতির পরে সর্বশেষ ‘প্রহেলিকা’ ছবিতেও প্রশংসিত হয়েছে।
একজন মাহফুজ আহমেদ চলচ্চিত্রে অনেকের থেকে অনেকভাবে এগিয়ে তার সমকাল ও উত্তরকাল মিলিয়েই। একজন আদর্শ অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠাই অর্জন তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে।