চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সবচে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দুতে পৌছানো খ্যাতিমান এই লেখকের অন্যান্য একাধিক পরিচয়ের অন্যতম হল – চলচ্চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। লেখক হুমায়ূন আহমেদের মত চলচ্চিত্রাঙ্গনের হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র-জীবনও বর্ণ্যাঢ্য, রঙিন এবং সাফল্যমন্ডিত।
লেখক হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্রাঙ্গনে যাত্রা শুরু করেছিলেন লেখালিখির মাধ্যমেই। ১৯৯২ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান লেখক, নাট্যকার, টিভিনাট্যনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ‘শঙ্খনীল কারাগার‘ নামের উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেন এবং এর মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ এর যাত্রা শুরু হয়। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ হুমায়ূন আহমেদের প্রথমদিককার সফল উপন্যাস, মোস্তাফিজুর রহমানও এই উপন্যাসের সফল চলচ্চিত্রায়ন করেন। ফলাফল, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মোট চারটি ক্যাটাগরীতে বিজয়ী হওয়া যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র-ক্যাটাগরীও অন্তর্ভূক্ত। এবং, চলচ্চিত্র নির্মানের আগেই হুমায়ূন আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিজয়ী হলেন।
১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র পরিচালনায় নাম লেখান। পরিচালক হিসেবে তিনি ততদিনে বিটিভির জন্য নাটক নির্মান করে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তা সত্বেও চলচ্চিত্র নির্মান প্রক্রিয়াটি যে খুব সহজ ছিল না তা তিনি তার ‘ছবি বানানোর গল্প’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ‘আগুনের পরশমনি‘ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অপারেশনকে হুমায়ূন আহমেদ তুলে এনেছেন তার ছবিতে। প্রথম চলচ্চিত্রেই বাজিমাত – মোট আটটি ক্যাটাগরীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে আগুনের পরশমনি, এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপরচয়িতা অন্তর্ভূক্ত।
আগুনের পরশমনির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ যে যাত্রা শুরু করেন তা শেষ হয় তার অষ্টম চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলা-র মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ চলচ্চিত্রটি তিনি নির্মান করেছিলেন, কিন্তু মুক্তি দিয়ে যেতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পরে ২০১২ সালে ঘেটুপুত্র কমলা মুক্তি পায়। মুক্তির আগেই হুমায়ূন আহমেদের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আশঙ্কা-সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু ছবি মুক্তির পরে স্পষ্ট হয়, প্রয়োজনবোধেই একটি বক্তব্যসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মান শেষে দায়িত্ববোধ থেকে তিনি শিশুদেরকে সাথে নিয়ে চলচ্চিত্রটি দেখতে যেতে নিষেধ করেছিলেন।
শ্রাবণ মেঘের দিন হল হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। রোমান্টিক ঘরানার এই চলচ্চিত্রে জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ এবং শাওন অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ নতুন আরেকটু পরিচয়ে পরিচিত হন – গীতিকার। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ শিরোনামে সুবীর নন্দীর গাওয়া গানটির গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ। এই চলচ্চিত্রটিও ছয়টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় চলচ্চিত্র দুই দুয়ারী মুক্তি পায় ২০০১ সালে। এই চলচ্চিত্রটি হুমায়ূনের অন্য দুই চলচ্চিত্রের থেকে একটু আলাদা – একটি পরিবারে একজন রহস্য মানবের আগমন ও প্রভাবে বিভিন্নরকম কর্মকান্ড নিয়ে ছবিটি নির্মিত। এর আগের দুটো চলচ্চিত্রে প্রধাণত টিভি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করলেও এই ছবিতে বাণিজ্যিক ধারার অন্যতম নায়ক রিয়াজ অভিনয় করেন। দুই দুয়ারী মোট তিনটি ক্যাটাগরীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
চতুর্থ ছবি চন্দ্রকথার প্রধান চরিত্র চন্দ্রের মাধ্যমে দুর্বলের প্রতি সবলের ক্ষমতার প্রয়োগ, সামাজিক অবিচার প্রভৃতি তুলে ধরেন। প্রথম চলচ্চিত্রের প্রধান অভিনেত্রা আসাদুজ্জামান নূর আবারও হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে হাজির হন চন্দ্রকথা-র মাধ্যমে। এই চলচ্চিত্রের প্রায় সবগুলো গানই হুমায়ূন আহমেদ রচনা করেন।
শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ আবারও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ফিরে যান। এই ছবিতে বাড়তি আকর্ষন হিসেবে যুক্ত হয় হুমায়ূন ফরিদীর অভিনয়। মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে একটি নৌকায় বিভিন্ন ধর্মের এবং পরিচয়ের একত্রিতযাত্রার ছবি তুলে ধরেন হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে নয় নম্বর বিপদ সংকেত সবচেয়ে নিস্প্রভ এবং বাণিজ্যিক। তিনি কেন এই চলচ্চিত্র নির্মান করেছিলেন সেটা দর্শকের কাছে বোধগম্য নয়, তবে ছবির টাইটেলে ‘একটি অর্থহীন মুভি’ হিসেবে স্বীকৃতি দর্শককে বিভ্রান্ত করে ভালোভাবেই। এই ছবির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের নাম শিল্প নির্দেশক ও নৃত্যপরিচালকের খাতায় অন্তর্ভূক্ত হয়।
ঘেটুপুত্র কমলার আগে ২০০৮ সালে তিনি নির্মান করেন আমার আছে জল চলচ্চিত্রটি। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে লাক্স তারকা বিদ্যা সিনহা সাহা মীম অভিনয় করেন।
হুমায়ূন আহমেদ নিজে আটটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, তার উপন্যাস/গল্পকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র। এর মধ্যে তৌকির আহমেদ নির্মান করেন দারুচিনি দ্বীপ এবং হুমায়ূন আহমেদ শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম তার দুটো গল্পের চলচ্চিত্রায়ন করেন, এদের একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র দূরত্ব এবং অন্যটি ডিজিটাল চলচ্চিত্র প্রিয়তমেষু। এছাড়া আবু সাইয়ীদ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের নায়িকা শাবনূরকে নিয়ে নির্মান করেন ‘নিরন্তর‘, প্রবীন চলচ্চিত্রনির্মাতা বেলাল আহমেদ হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মান করেন নন্দিত নরকে এবং শাহ আলম কিরণ নির্মান করেন ‘সাজঘর‘। এছাড়া সুভাষ দত্ত ১৯৯২ সালে হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী ও চিত্রনাট্যে ‘আবদার’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মান করেন, পূর্ণাঙ্গ তথ্যের অভাবে আমরা বাংলা মুভি ডেটাবেজ-এ তা যোগ করতে পারি নি।
ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ বিদায় নিয়েছেন, চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নির্মান বন্ধ হয়েছে ঘেটুপুত্র কমলার মাধ্যমে, কিন্তু চলচ্চিত্রের কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদ কোনদিন মৃত্যুবরণ করবেন না – তার সাহিত্যকর্মসমূহের যোগ্য চলচ্চিত্রায়ন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকে আরও সমৃদ্ধ করবে আর এভাবেই বেচে থাকবেন হুমায়ূন আহমেদ – তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে।
এই গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতার মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলা মুভি ডেটাবেজ এর পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।
ছবি কৃতজ্ঞতা: মুস্তাফিজ মামুন
চলচ্চিত্রের কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদ কোনদিন মৃত্যুবরণ করবেন না – তার সাহিত্যকর্মসমূহের যোগ্য চলচ্চিত্রায়ন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকে আরও সমৃদ্ধ করবে আর এভাবেই বেচে থাকবেন হুমায়ূন আহমেদ – তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে।
কথাটা খুবই ভালো লেগেছে এডমিন।
আমাদের দেশের সাহিত্যকর্ম খুব ভাল অবস্থায় ই আছে।সেসবকে যদি সিনেমায় রুপান্তরিত করা হয় আসলেই সেটা চলচ্চিত্রের মান উন্নয়নে ভাল ভুমিকা রাখবে।
ভাল থাকুন হুমায়ুন যেখানেই থাকুন!
তাঁর হিমু কিংবা মিসির আলী চরিত্রগুলোর উপন্যাস দিয়ে মুভি বানানোর চিন্তা করতেই পারেন পরিচালকরা – একটু রিস্ক নিতে হবে। সবটুকু চেষটা ঢেলে দিলে বাংলা চলচ্চিত্রজগতে একটা ভালো রকমের ভূমিকম্প হবে আমি আশা করি। সবচেয়ে বড় কথা – নতুন প্রজন্মের দর্শকশ্রেণি – যারা বাংলাসিনেমা বিমুখ কিন্তু হূমায়ূনভক্ত, তাদের জন্যে এটা একটা খোরাক হবে নাক সিঁটকানো বাদ দিয়ে নিজ সংস্কৃতিমুখী হওয়ার।
আমাদের পরিচালকরা কি একটু সদয় হবেন্না?