চলচ্চিত্র দিবস, জিডিপি, সংস্কৃতির বাজেট ও দুঃখপ্রকাশের সংস্কৃতি…
কিছুদিন আগে একজন নবীন গবেষক এদেশে নির্মিত সুররিয়াল সিনেমার খোঁজখবর করছিলেন। বলছিলাম, যেখানে পুরো ইন্ডাষ্ট্রিটাই সুররিয়াল সেখানে আলাদা করে সিনেমা খোঁজার দরকার কি। ভালো করে চারপাশটায় তাকিয়ে দেখুন, এখানে সমস্ত কিছুই সুররিয়াল।
বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে স্বাভাবিক জীবন নয়, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ বলে একটা শ্লোগান আছে। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে টেলিভিশনে নাটক বলে একটি ব্যাপার আছে। তাও আবার নানা দৈর্ঘ্যের কারনে নানা নাম। সিঙ্গেল নাটক, টেলিফিল্ম, টেলিমুভি, টেলিছবি। একই জিনিস আবার ওটিটি’তে গেলে নাম হয়ে যায়- ওয়েব ফিল্ম।
আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাষ্ট্রিকে ঘোষণা করা হয়েছে শিল্প (ইন্ডাষ্ট্রি অর্থে), আছে এটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে, অথচ আদতে এটি সংস্কৃতি। আমাদের পরিচালক সমিতি আছে আন-অফিসিয়ালি তথ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে, প্রযোজক সমিতি সরাসরি বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে, আর শিল্পী সমিতি আছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে প্রেক্ষাগৃহ একজনের আর প্রজেক্টর আরেকজনের। সুররিয়েলিজমের আর কত উদাহরণ লাগবে?
*
এই সাবকন্টিনেন্ট ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাঝে বিরতি বলে কিছু নেই। কিন্তু সব চলচ্চিত্রের জন্যে তো বিরতির প্রয়োজন হয়না। চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী সে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। মাল্টিপ্লেক্সের যে স্ক্রীনটায় একটু চিন্তাশীল বা জীবনঘনিষ্ট চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে সেটাকে নিশ্চয়ই ’ব্রেক ফ্রী’ হিসেবে রাখা যায়। সব ছবি দেখবার সময় তো আর পপকর্ণ আর চিপসের মচমচ্ শব্দ শুনতে ভালোলাগার কথা নয়।
*
আগে চলচ্চিত্র সেন্সরে জমা দেয়ার জন্যে এফডিসি থেকে এনওসি নেয়ার ব্যাপারটা শুধুমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্রের বেলায় প্রযোজ্য ছিল। কিছুদিন আগে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রের জন্যেও ১৫ হাজার টাকা ফি দিয়ে এনওসি (অনাপত্তি পত্র) নেয়ার আইন করা হয়েছে! সেন্সর পেতে হলে এনওসি নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে! এসব নিয়ে কথা বলার কেউ নেই, কিন্তু নানা সমিতির মুহুর্মুহু নির্বাচন আর ভোট চাওয়ার লোকের সংখ্যা অগণিত। এফডিসি থেকে এনওসি আনবার আগে আবার ২টি সমিতি থেকেই সার্টিফিকেট নিয়ে জমা দিতে হয়। সরকারি দফ্তর থেকে সেন্সর সনদ পাওয়ার জন্যে, আগে ২টি বেসরকারি দফ্তরের সনদপত্র লাগছে। নইলে সেন্সর কেন, এনওসি’র জন্যেই আবেদন করা যাচ্ছেনা।
*
সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা কতোটা সীমিত সেটা প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আমাদের বড় ভাইয়েরা দুঃখ প্রকাশ করে যে বিবৃতি দেন, সে একই বিবৃতি আমরা ছোটোবেলা থেকে পড়ে আসছি। চলচ্চিত্রেও বছরে একবার অনুদান দেয়া ছাড়া আর কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। আর সেই অনুদান নিয়েও আমরা যে এর যথাযথ ব্যবহার করতে পারছিনা, সেই ব্যর্থতার দায়ভারও আমাদের আছে। গত ৫ বছরে অনুদান পাওয়া ৫০টি চলচ্চিত্রের মাঝে কয়টি নির্মিত হয়েছে, সেই হিসেবটাও আমাদের করতে হবে।
*
সংস্কৃতির সাথে বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আদর্শের সংযোগ থাকে। সেই বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আদর্শ একজন কৃষককে যেমন প্রভাবিত করতে পারে, তেমনি একজন শিক্ষক, আমলা, নীতি নির্ধারক কিংবা উৎপাদনের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত একজন শ্রমিককেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ না হয়েও ন্যাশনাল জিডিপিতে সংস্কৃতির কন্ট্রিবিউশন থাকে। পৃথিবীর সব দেশেই সংস্কৃতি সরকারি এবং বেসরকারি দুই রকমের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েই এগিয়ে চলে। সব বিষয়ে সরকারের আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা প্রয়োজন হলেও বেশীরভাগ উদ্যোগ হয় বেসরকারি। যে কোনো প্রাইভেট বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মেমোরান্ডাম অফ আর্টিকেল-এ ‘সিএসআর’ বলে একটি বিষয় থাকে। (ভারতে এটি ‘কোম্পানি অ্যাক্ট’ এর অধীন।) যেখানে বার্ষিক লভ্যাংশের একটি অংশ সমাজ সংস্কৃতির কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে হয়। কিন্তু এই দেশের কোম্পানিগুলোর নজর কেবল ব্যাংক-লোন আর মুনাফার দিকেই। যেহেতু এদেশের কোম্পানী আইনে সিএসআরের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তাই সমাজ সংস্কৃতির জন্যে কোনো দায়ভারও তাদের নেই।
সরকারের দিক থেকেও এসব দেখভালের কেউ নেই। এদের বাধ্য করবার কেউ নেই। কিন্তু আমরা যদি একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ ও মূল্যবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠী আশা করি তাহলে সংস্কৃতি খাতে যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে। বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অবকাঠামোগত সকল পরিবর্তনের জন্যে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
আর মাত্র দুমাস পরেই নতুন বাজেট ঘোষিত হবে। বাজেট বরাদ্দ না বাড়লে অগ্রজদের ‘দুঃখ প্রকাশ’ করা পুরনো বিবৃতিটাই আবার কষ্ট করে কপি-পেষ্ট করতে হবে। আর আমাদেরও দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেটাই পাঠ করতে হবে।
*
সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের জানাতে চাই, আপনারা তো বাজেটের আগে জিডিপিতে সংস্কৃতির অংশগ্রহণ কতটুকু তার পরিসংখ্যান খোঁজেন। কিন্তু জানা প্রয়োজন, মূল্যবোধের মৃল্যটুকু বাঁচিয়ে রেখে যে দায়িত্ববান সুশৃঙ্খল নাগরিক আপনারা আশা করেন, সে দায়িত্বশীল সুনাগরিক তৈরির কাজটা করে সংস্কৃতি। যার পরিসংখ্যান চোখে দেখা যায়না। সেটা দেখার জন্যে সেটা বোঝার জন্যে, আইকিউ এর পাশাপাশি ই-কিউ ও থাকতে হবে। আই কিউ এর সঙ্গে ই-কিউ যেটা ডেলিভার করে, তার নাম সংবেদনশীলতা। যেটা গ্রেট লিডারদের থাকে। সংস্কৃতিকর্মীদেরও থাকে। আমরা সরকারের কাছে ভূটানের মতো ‘মিনিষ্ট্রি অব হ্যাপিনেস’ চাইছিনা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সমাজ যদি শরীর হয় সংস্কৃতি তার মুখাবয়ব। আর চলচ্চিত্রে সেই মুখাবয়বের সুস্পষ্ট ছায়াটুকু পড়ে। যদি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা না করেন, তাহলে বিশ্ব মানচিত্রে দেশের রোগাক্রান্ত চেহারার ছবিটুকুই ছাপা হবে।
*
আমরা জানি, সারা পৃথিবীতেই কমিউনিটি ভিউয়িং এর সংখ্যা কমছে। বাড়ছে পার্সোনাল ভিউয়িং। সবকিছু ছাড়িয়ে মোবাইল এখন ফার্স্ট স্ক্রিন। প্রযুক্তির উদ্ভাবনায় প্রদর্শন ব্যবস্থার এই নতুন যুগে সবকিছুই এখন- ‘কন্টেট’। তো এই কন্টেন্ট মেকিংয়ের সময়ে, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কর্মপদ্ধতি যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনি নতুন সময়ের জন্য প্রয়োজন নতুন গল্প, নতুন অভিব্যক্তির নতুন সিনেমা।
নতুন জমানার চলচ্চিত্র চর্চা ও অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন নতুন সিলেবাস, নতুন ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো, নতুন বৈশিষ্ট্য আর রিলে রেস্ টা এগিয়ে নেওয়ার জন্যে প্রয়োজন নতুন শ্লোগান।
*
মগজে কারফিউ নিয়ে পথচলা খুব আনন্দের কাজ নয়। নিরাপত্তার অভাববোধে তাড়িত জনগোষ্ঠী সৃজনশীলতার চর্চা করবে দূরে থাক, জীবন থেকে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক আনন্দটুকুই নিতে পারে না। তবুও প্রতিবছর নানা দিবস আসে, আর আমরাও পরিবর্তনের প্রত্যাশা নিয়ে সেসব উদযাপনের চেষ্টা করি। আর গভীর মনোবেদনার সাথে লক্ষ্য করি, ২ কোটি মানুষের এই রাজধানী শহরেও নানান শিল্পকলার একটিরও নতুন কোনো শাখা তৈরি হয়নি। মঞ্চের সংখ্যা একটিও বাড়েনি। একটা সিঙ্গেল স্ক্রিনও রেনোভেট করে সিনেপ্লেক্সে রূপান্তরিত হয়নি। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোতেও ডিজিটাল টিকেটিং এর ব্যবস্থা হয়নি। ই-টিকেটিংসহ বক্স অফিস নেই, তাই প্রযোজকও মাঠে সক্রিয় নেই। সম্মিলিত ভাবেই একটা জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র চাওয়া হচ্ছে অনেকদিন। পূরণ হয়নি।
কোথাও কোনো অগ্রগতির খবর নেই। তাই বলে দিবস উদযাপন আর শুভেচ্ছা বিনিময়ে কার্পণ্য কিসের! সবাইকে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস উপলক্ষে অনেক অনেক শুভেচ্ছা!!
০৩ এপ্রিল, ২০২৩