Select Page

রিভিউ/ মনপুরা : ভালো লাগার ছবি

রিভিউ/ মনপুরা : ভালো লাগার ছবি

এ শতকের বাংলা চলচ্চিত্রের আলোচনায় গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘মনপুরা’র নাম বারবারই আসে। দর্শকপ্রিয় সেই সিনেমা নিয়ে ২০০৯ সালের ৩ জুলাই সংখ্যা সাপ্তাহিক মুখোমুখিতে রিভিউ লেখেন রফিকুজ্জামান। অনুপম হায়াৎ সংকলিত ও সম্পাদিত ‘পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচনা (১৯৫৬-২০০৯)’ বই থেকে রিভিউটি নেয়া হয়েছে।

মনপুরা। কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও নির্দেশনা: গিয়াস উদ্দিন সেলিম। চিত্রগ্রহণ: কামরুল হাসান খসরু। সম্পাদনা ও সংগীত: ইকবাল কবীর এ জুয়েল। অভিনয়: মামুনুর রশীদ, শিরিন আলম, মনির খান শিমুল, আহসানুল হক মিনু, দিলারা জামান ও মিরানা জামান এবং ফজলুর রহমান বাবু। প্রধান ভূমিকায়: ফারহানা মিলি ও চঞ্চল চৌধুরী। প্রযোজনা ও পরিবেশনা: মাছরাঙ্গা প্রডাকশন।

ভূমিকা

ঢাকার ছবির জগতে যখন ছবির বিষয়ের আকাল দেখা দেয় কিংবা ব্যবসায় নেমে আসে খরা তখন হঠাৎ একটি ছবি এসে সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রিলিজের আগে যে ছবি সম্পর্কে ছবির ব্যবসায়ীরা কথাই বলতে আগ্রহী হন না, এমনকি নির্মাতা, নিজেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন তেমনই একটি ছবি কখনো কখনো দর্শক নন্দিত হয়ে ওঠে। সাথে সাথে লক্ষ্মীর ঝাপিও ভরে ওঠে। ‘মনপুরা’ তেমনই একটি ছবি। বেশ কিছুদিন হলো ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। ঘুরেফিরে সারাদেশেই চলছে। অতি সাধারণ একটি প্রেমের ছবি। নির্মাতার দিক থেকেও কোন মুন্সিয়ানা নেই। তবে প্রচলিত ও জনপ্রিয় দু’একটি গান আছে যা দর্শকের মুখে মুখে ফিরছে। এতেই মনপুরা সবার মন কেড়ে নিয়েছে। একই ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল ‘রূপবান’ ও ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবির ক্ষেত্রে। ষাটের দশকে ‘রূপবান’ উর্দু ছবির রাহুগ্রাস থেকে বাংলা ছবিকে রক্ষা করেছিল। ওই সময় ‘রূপবান’ যে ব্যবসা করেছিল উপমহাদেশে আর কোন ছবি এত ব্যবসা করেনি। নব্বইয়ের দশকে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটিও ব্যবসায় রেকর্ড সৃষ্টি করে। এ ছবিটি কলকাতায়ও নির্মিত হয়। সেখানেও একই ব্যবসা করে। ‘মনপুরা’ ঢাকাই ছবির বর্তমান মন্দা ব্যবসাকে চাঙ্গা করার পথ করে দিয়েছে।

কাহিনীসূত্র

মনপুরা ছবির পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম। এটা তার প্রথম ছবি। এর আগে তিনি টিভি নাটক তৈরি করে হাত পাকিয়েছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি চরের নাম মনপুরা। চারপাশে নদী। দূরে বসতিপূর্ণ গ্রামগুলো দেখা যায়। জনমানবশূন্য চর মনপুরা। সেখানে বাস করে অন্যের খুনের দায় মাথায় নেয়া এক যুবক সোনাই। দূর গ্রাম উজানতলীর হাবিব আলীর মা-মরা মেয়ে পরী বাপের সাথে মনপুরায় মাছ ধরতে এসে সোনাইর প্রেমে পড়ে। কিন্তু মনপুরা চরের মালিক গাজীর পছন্দ হয় পরীকে। গাজীর মনে হয় পীরের কথা। সুন্দরী কোন মেয়ের সাথে তার পাগল ও খুনি ছেলে হালিমের বিয়ে দিলে হালিম সুস্থ হয়ে যাবে। পরীর নামে সমস্ত সম্পত্তি লিখে নিয়ে গাজী তাকে পুত্রবধূ করে ঘরে তোলে। শর্ত থাকে যে, পরী কখনও তার স্বামীকে ত্যাগ করতে পারবে না। পরী সোনাইকেই তার স্বামী হিসেবে জানে। সোনাইর ফাঁসির খবর শুনে পরী নিজের জীবন দিয়ে পাগল হালিমের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে। অন্যদিকে সোনাই জামিনে ছাড়া পেয়ে পরীর আত্মহত্যার খবর শুনে দেশান্তরী হয়।

পর্যবেক্ষণ

ছবির শুরুটা এরকম- রাতের বেলা প্রবল বৃষ্টির মধ্যে গাজীর পাগলপুত্র যুবক হালিম দাঁড়িয়ে ভিজছে ও তার সামনে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে মৃত পড়ে আছে বাড়ির কাজের মেয়ে যুবতী রহিমা। রহিমাকে কেন হত্যা করা হলো তা স্পষ্ট নয়। এমনকি এ হত্যার সমর্থনে একটি ফ্ল্যাশব্যাক আছে তাতেও মোটিভ বোঝার উপায় নেই। তবে দর্শক হিসেবে মনে হয় গল্পটা শুরু করার জন্য সোনাইয়ের ওপর খুনের দায় চাপিয়ে দিয়ে জনমানবশূন্য মনপুরা চরে পাঠাতে ওরকম একটি উদ্দেশ্যমূলক দৃশ্যের প্রয়োজন ছিল। মনপুরা চরে সোনাইর সঙ্গী হয় পাখি, ছাগল, গরু, বাছুর ইত্যাদি। এগুলোর সাথে সোনাইর আচরণ ও কথা বলা ভালো হয়েছে এবং দর্শককে আনন্দও দিয়েছে। চরের পাশে হাবিব আলীকে মাছ ধরতে দেখে সোনাইর এগিয়ে আসা, পরীর নৌকা ফ্রেমে প্রবেশ করা এবং সোনাই পরীর চার চোখের মিলন, ভাত খাওয়া, ঘরের বেড়া ধরে দু’জনের আঙুল এগিয়ে আনা এবং গানের মধ্যে দু’জনের কাছাকাছি আসার দৃশ্যগুলো সোনাই- পরীকে জীবন-মরণের সাথী করেছে। সোনাই ও পরীর প্রথম দেখার পর রাতে দু’জনের কারোরই ঘুম না আসা। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করা স্বাভাবিক মনে হয়নি। সোনাইর বেলায় কিছুটা স্বাভাবিক মনে হলেও পরীর বেলায় তা মনে হয়নি। কারণ গাজীর কাজের ছেলে সোনাইর কাছে জনমানবশূন্য চরে পরীকে আকাশের পরী মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু গ্রামের বাসিন্দা পরী কি এ বয়সে আর কোন যুবককে দেখেনি? এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। তারপর এ দৃশ্যে ভৌতিক আবহ সংগীত ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, পুরো ছবিতেই এ ধরনের আবহ সংগীত ব্যবহার করায় ছবির অঙ্গহানি ঘটেছে। যে মেয়েকে রঙিন কাগজ দিয়ে ঠোঁট রাঙাতে হয় সে কীভাবে কপালে সুদৃশ্য টিপ ও পায়ে নূপুর পরতে পারে, বিষয়টি বোধগম্য নয়। পরীর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পাখিকে মুক্ত করা, শূন্য খাঁচা, সোনার ময়না পাখি গানের মধ্যে কল্পনায় পরীর আবির্ভাব ও ডিজলভ্ করে পরীর দূরে চলে যাওয়া ও একসময় বিনীত হওয়ার দৃশ্যে সোনাইর হৃদয়ের আকুতি দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পুলিশ দিনের বেলায় সোনাইকে ধরতে পারলো না অথচ রাতের বেলা ধরে ফেললো- এটা একেবারেই অযৌক্তিক। বরং নদীতে ভাসমান সোনাইকে পাকড়াও করা অনেক বেশি যুক্তিসংগত হতো। সোনাইর ফাঁসি হবে- একথাটা পরীকে শাশুড়ির জানানো আর পাগল হালিমের জানানো কি এক? ফ্ল্যাশ ফরওয়ার্ডে সোনাইকে ফাঁসিতে ঝোলাতে নিয়ে যাওয়া ও পরীর ছুটে যাওয়া এবং নিজের কৈফিয়ত দেয়ার দৃশ্যটি হরর দৃশ্যের মতো হয়েছে। তারপর সোনাই জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে ট্রলারের শব্দ কেন ব্যবহার করা হলো, এর কোন ব্যাখ্যা নেই। পরীর কবর থেকে ফেটে নদীতে সোনাই ও পরীর নৌকা পাশাপাশি ও হাত ছোঁয়ার দৃশ্যটির কোন প্রয়োজন নেই। বরং সোনার বৈঠা ফেলে দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে যাওয়ার দৃশ্যটিই যথেষ্ট।

পরিশেষে

‘মনপুরা’ ছবিটি দেখলে মনে হয় না কোন চিত্রনাট্য আছে। পরিচালক তার আবেগ ও ভাবনা প্রসূত কিছু ঘটনা চিত্রায়িত করে পরপর সাজিয়ে দিয়েছেন। পুরো ছবিটাই তৈরি হয়েছে নদীর পাড়ে। পরীর মুখে সংলাপও রয়েছে নদী ছাড়া সে বাঁচবে না। এ প্রেমের সাক্ষী হিসেবে নদী ও ঢেউকে মানা হয়েছে। তারপরও নদীর ব্যবহার নেই বললেই চলে- নৌকায় চলাফেরা ছাড়া। নদীর এলাকা, বারবার বলা হয়েছে আকাশে মেঘ কিন্তু কখনও বৃষ্টি হয়নি, ঝড় হয়নি। খোলা আকাশ; কিন্তু সূর্য দেখা যায়নি। রাতের দৃশ্য খুবই কম, চাঁদও দেখা যায়নি। ছবিতে ক্যামেরার মুভমেন্ট নেই বললেই চলে। প্রতিটি শটই স্থির শট তবে কিছু কিছু দৃশ্যকল্প মনোরম। সোনাই ও পরীর নৌকা ফ্রেম আউট ও হাবিব আলীর নৌকার ফ্রেম ইন হওয়ার দৃশ্যটির সম্পাদনা ভাল হয়েছে। তবে ছবির সামগ্রিক সম্পাদনা দর্শককে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়েছে। এছাড়া আত্মহত্যা, ফাঁসির কথা ও স্বপ্নে পরীকে মৃত মায়ের আহ্বান ছবির পরিণতির ইঙ্গিত বহন করে। গ্রামের সুন্দরী যুবতী মেয়ে পরীর খোলা পেলব কোমর বারবার ক্যামেরায় ধরার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সফল হয়েছে সোনার পালঙ্কে ও নিথুয়া বাতাস গান দুটির ব্যবহার।

সোনাইরূপী চঞ্চল চৌধুরী খুব ভাল অভিনয় করেছেন। আগাগোড়াই তার বোকা- বোকা সহজ-সরল আচরণ বজায় থেকেছে। পরীর চরিত্রে ফারহানা মিলি ভাল করেছেন। তা চেহারার চেয়ে চোখ বেশি কাজ করে। ছোট চরিত্রে গাজীর স্ত্রী হিসেবে শিরিন আলম স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন। গাজীর চরিত্রে মামুনুর রশীদ দোটানা ভাবটা সবসময় বজায় রেখেছেন। পাগল হালিমের চরিত্রে মনির খান শিমুলের আচরণকে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। তবে তার আচরণ দর্শককে খুব কাতুকুতু দিয়েছে। আর পরীর বাবা হাবিব আলীর চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবুর খুব একটা কিছু করার ছিল না।

সবশেষে বলব, দর্শক সব সময় নতুন কিছু দেখতে চায় ও শুনতে চায়। ঢাকার ছবির নির্মাতারা যদি নতুন নতুন গল্প নিয়ে ও শ্রুতিমধুর গানসহ ছবি উপহার দিতে পারেন তাহলে সব ছবি ‘মনপুরা’ না হলেও সুদিন ফিরে আসবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।


মন্তব্য করুন