Select Page

চাচা, ঢাকা কতদূর?

চাচা, ঢাকা কতদূর?

‘চাচা, ঢাকা কতদূর
ঐ দেখা যায় সদরঘাট সামনে নবাবপুর’
‘মৌসুমী’ ছবির এ সংলাপটি দিয়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন একজন অভিনেতা তিনি সাদেক বাচ্চু। তখনকার রিকশা, অটোরিকশার গায়ে সংলাপটি লেখা থাকত।

সাদেক বাচ্চু আমাদের ঢাকাই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির লাস্ট অ্যাসেট ছিলেন। লাস্ট বলা হচ্ছে এজন্য সুস্থ যতদিন পর্যন্ত থেকেছেন চলচ্চিত্রে কাজ করে গেছেন। সেকাল-একাল পর্যন্ত তাঁর কাজের ব্যাপ্তি ছিল। একাধিক বিনোদনমাধ্যমে বহুমুখী প্রতিভা দেখিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি অভিনেতা।

জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৫৫, ঢাকায় অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুর। মূলনাম মাহবুব আহমেদ সাদেক। পরিচালক ক্যাপ্টেন এহতেশাম তাঁর নাম দেন সাদেক বাচ্চু। ব্যক্তিজীবনে তিনি ডাকবিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন।

তাঁর জীবন সংগ্রামের ছিল এবং সংগ্রামের ছিল বলেই তিনি এতদূর আসতে পেরেছেন। মেট্রিক পরীক্ষার সময় বাবা মারা গেলে ১১ জনের পরিবারে দায়িত্বটা তাঁর উপর আসে। তিনি সেটা সামলে নিয়েছেন। তারপর অভিনয় জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো।

তিনি একাধারে মঞ্চ, টিভি, বেতার ও চলচ্চিত্র অভিনেতা। নিজে নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন। তাঁর তুমুল জনপ্রিয় টিভি নাটক ছিল ‘জোনাকি জ্বলে।’ এছাড়া সেলিম আল দীনের মতো কিংবদন্তি নাট্যকারের ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ নাটকেও কাজ করেছেন। লোকগাঁথা অনুযায়ী নির্মিত ‘হীরামন’ নাটকেও অভিনয় করেছেন। নব্বই দশকের টিভি নাটকে তখনকার জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী যেমন শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত-দের বাবার চরিত্রেও তাঁকে দেখা গেছে।

পেশাদার অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠেন তিলে তিলে। ১৯৬৩ সালে ‘খেলাঘর’ নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৭২-এ ‘গণনাট্য পরিষদ’ থিয়েটারে যোগ দেন। ১৯৮৪-তে ‘মতিঝিল থিয়েটার’-এ আসেন। এখানে নিজে নাটক লিখে নির্দেশনাও দিতে থাকেন। অনেক সুপারহিট নাটক তিনি উপহার দিয়েছেন। টেলিভিশনে আসেন ১৯৭৪-এ। প্রথম নাটক ছিল ‘প্রথম অঙ্গীকার’ নামে। এসময় বিজ্ঞাপনেও তিনি কাজ করেন। টিভিতে উল্লেখযোগ্য নাটক – হীরামন, জোনাকি জ্বলে, গ্রন্থিকগণ কহে, ঝুমকা, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশী কাঁথার মাঠ, হ্যালো চেয়ারম্যান সাব ইত্যাদি।

সাদেক বাচ্চু চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৮৫ সালে ‘রামের সুমতি’ ছবিতে। চলচ্চিত্রে খলনায়ক হবার পাশাপাশি দু’একটি ছবিতে নায়কও ছিলেন যেমন ‘মায়ামৃগ।’ প্রথম খলনায়ক ছিলেন ‘সুখের সন্ধানে’ ছবিতে। এ ছবিতে তাঁকে প্রথমবারের মতো পান তখনকার শীর্ষ নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। কাঞ্চন সাদেক বাচ্চুর অভিনয়ের প্রশংসা করেন। খলনায়কে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এহতেশামের ‘চাঁদনী’ ছবি দিয়ে। এ ছবিতে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলা সংলাপ সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছবিতে কাস্ট হবার গল্পটা ছিল ইন্টারেস্টিং। ঢাকার বিজয়নগরে পরিচালক এহতেশামের অফিস ছিল। একদিন একটা কাজে সেখানে যান সাদেক বাচ্চু। তিনি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এহতেশামকে সালাম দেন। তিনি সালামের জবাবও দেন তারপর পেছন থেকে সাদেক বাচ্চুকে ডাকেন এবং বলেন-‘এ বেটা সুনো, অ্যাকটিং কারেগা?’ সাদেক বাচ্চু জানালেন তিনি অভিনয়ই করেন। শুনে এহতেশাম খুশি হয়ে তাঁর অফিসে বসতে বললেন। অফিসে বসা ছিলেন কিংবদন্তি পরিচালক আজিজুর রহমান। এহতেশাম আসার পর আজিজুর রহমান অনেক প্রশংসা করলেন সাদেক বাচ্চুর। ‘চাঁদনী’ ছবির খলনায়কের জন্য পাথরের খনির একজন খলনায়ক যার গায়ের রং কালো এমন কাউকে খুঁজছেন এহতেশাম। সাদেক বাচ্চু চূড়ান্ত হয়ে গেলেন। ছবিতে সিলেটি ভাষায় সংলাপ বলার প্রস্তাবটা সাদেক বাচ্চুই দেন এবং উপস্থিত বলে শোনান তখন পরিচালকের ভালো লেগে যায় এবং তিনি চূড়ান্ত হন। ছবি মুক্তির পর তো ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে যান সাদেক বাচ্চু। নাঈম-শাবনাজ জুটির ছবিতে তাঁকে দর্শক পছন্দ করায় এ জুটির একাধিক ছবিতে তিনি ছিলেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র :

রামের সুমতি, সুখের সন্ধানে, মায়ামৃগ, চাঁদনী, চোখে চোখে, দিল, আগুন জ্বলে, সোনিয়া, মৌসুমী, এক পলকে, মুক্তির সংগ্রাম, জল্লাদ, রাজগোলাম, রঙিন প্রাণসজনী, পাপী শত্রু, প্রিয়জন, রঙিন সুজন সখি, আনন্দ অশ্রু, আত্মসাৎ, স্বামী কেন আসামী, মেয়েরাও মানুষ, বাবার বাবা, সৈনিক, নাজায়েজ, প্রতিশোধের আগুন, অরুণ শান্তি, মিলন মালার প্রেম, সাগরিকা, বডিগার্ড, চাঁদাবাজ, পাগলীর প্রেম, স্পর্ধা, আদরের সন্তান, সুজন মাঝির প্রেম, স্বপ্নের পুরুষ, মিলন হবে কত দিনে, রঙিন উজান ভাটি, নয়নের নয়ন, দৌড়, রুস্তম, বাস্তব, সাহসী মানুষ চাই, হৃদয় আমার নাম, বন্ধু তুমি আমার, বন্ধু তুমি শত্রু তুমি, নিঃশ্বাস আমার তুমি, প্রিয়া আমার প্রিয়া, আমি নেতা হবো, ক্যাপ্টেন খান, শাহেনশাহ ইত্যাদি।

চলচ্চিত্রে নব্বই দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনেক তারকার শিক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। নাঈম, শাবনাজ, শাবনূর, আমিন খান, অমিত হাসান, মিশা সওদাগর, শাকিব খান থেকে আজকের বুবলী, বাপ্পি পর্যন্ত অনেকে তাঁর কাছে তালিম নিয়েছে। তিনি বাচিক শিল্পীর কাজ করতেন তারকাদের তৈরি করতে। মিশা সওদাগর একবার তাঁকে সরাসরি বলেছেনও-‘বাচ্চুভাই, এই ডেলিভারিটা কিন্তু আপনার কাছ থেকে নিয়েছি।’

সাদেক বাচ্চু-র সেরা ছবির কথা বললে ছয়টি ছবির কথা আসে – রামের সুমতি, চাঁদনী, এক পলকে, মৌসুমী, মুক্তির সংগ্রাম, চাঁদাবাজ। ‘এক পলকে’ ছবিতে খলনায়কের চরিত্রে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিলেন। ছবিটি গার্মেন্টস শ্রমিকের জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। সাহিত্যভিত্তিক ‘রামের সুমতি’ তাঁর ভাইটাল কাজ। ‘চাঁদনী’ খলনায়কের ব্রেক দেয় তাঁকে তাই গুরুত্বপূর্ণ। ‘মৌসুমী’ ছবির ‘চাচা, ঢাকা কতদূর?’ সংলাপটি তাঁকে ওয়ার্ড অফ মাউথে প্রচণ্ড জনপ্রিয় করে এবং পজেটিভ চরিত্রেও অসাধারণ অভিনয় করেছেন তাই ভাইটাল কাজ। ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ছবিতে তিনি অনবদ্য ছিলেন। ‘ক্ষমতা রে ক্ষমতা’ সংলাপটি খুব শক্তিশালী ছিল। পজেটিভ চরিত্রে ‘চাঁদাবাজ’ ছবির ‘স্বাধীনতা রে স্বাধীনতা, আমার স্বাধীনতারে ন্যাংটা কইরা ফালাইছে’ সংলাপটি হার্ট টাচিং ছিল। ছবিতে নায়িকা কবিতাকে রাজিব বাহিনী ধর্ষণ করার পর কবিতা যখন বিবস্ত্র হয়ে রাজপথে দৌড়ায় তখন সাদেক বাচ্চু এ সংলাপটি দেন। এছাড়া ‘নয়নের নয়ন’ ছবিতে খলনায়কের অভিনয় অনবদ্য ছিল। খলিলের হুকুমে সাদেক বাচ্চু এ ছবিতে থুথু চেটে নাকে খত দেয় তখন তাঁর এক্সপ্রেশনগুলো জাস্ট ভয়ঙ্কর ছিল। খলনায়ক হিসেবে সাদেক বাচ্চুর পরিচিত বৈশিষ্ট্য ছিল হাতের তালু ঘষা। তালু ঘষতেন আর অ্যাংরি এক্সপ্রেশন দিতেন।

তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর চলচ্চিত্রে কাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। পরিচালক আমজাদ হোসেন অভিনেত্রী রহিমা খাতুনকে দিয়ে অভিনয় কিভাবে আদায় করে নিতেন। প্রণাম করার একটা শট ছিল রহিমা খাতুন দিতে চাচ্ছিলেন না তখন আমজাদ হোসেন তাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে বললেন, এটা আপনার কাজ আপনাকে করতে হবে। হুমায়ুন ফরীদি সেট থেকে বের হয়ে গেছেন অনেকবার যখন ইচ্ছামতো কাউকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো হত। তিনি বলতেন, যাকে তাকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছ অভিনয় কি এত সহজ জিনিস? এতটা সিরিয়াস ছিল তাঁদের সময়ের কাজ। আর এখন অমুকের আত্মীয় সুতরাং ক্যামেরার সামনে আসলেই হবে এমন একটা অবস্থা চলছে। সালমান শাহ কখনো প্রম্প করত না কেউ করাতে এলে সরাসরি বলে দিত এই আমাকে প্রম্প করবা না। সরাসরি শট দিতে চলে যেত। অনেক জনপ্রিয় তারকারাও থতমত খেয়ে যেত তাঁর সামনে বলত এ কি অভিনয় করছে নাকি সরাসরি কথা বলছে এতটা অসাধারণ ছিল প্রতিভায়। সাদেক বাচ্চুর এসব স্মৃতিচারণ শিক্ষণীয় আজকের তারকাদের জন্য।

তিনি আমৃত্যু অভিনয়ের প্রতি ডেডিকেটেড ছিলেন। সুস্থ থাকা পর্যন্ত চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, থেকেছেন অভিভাবক হয়ে। বর্তমান বিশ্বের মহামারী রোগ ‘কোভিড-১৯’-এ আক্রান্ত হয়ে অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সাথে তিনি লাইফ সাপোর্টে চলে যান। শেষরক্ষা আর হয়নি। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে তিনি ঢাকার মহাখালীর একটি হাসপাতালে মারা যান। তাঁর আত্মা শান্তি পাক।

একজন সাদেক বাচ্চু বহুমুখী মাধ্যমে সফল অভিনয়শিল্পী হিসেবে কিংবদন্তি হয়েছেন। তাঁর কর্মজীবন, অভিনয়দক্ষতাকে ফলো করে এ প্রজন্ম শিখতে পারে অনেককিছুই।


Leave a reply