চিন্তার চাষী আলমগীর কবির
আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রে চিন্তার জাগরণকে বুঝতে তাঁর নামকরা তিনটি ছবিই যথেষ্ট। নতুনত্ব ছিল ছবিগুলোর কনটেন্ট ও প্রেজেন্টেশনে।’
‘সূর্যকন্যা’ প্রথম কোনো বাংলাদেশী ছবি যেখানে সমাজতন্ত্র ও নারীর জাগরণ দেখানো হয়েছে।এরপরেও কিছু ছবিতে দেখানো হয়েছে কিন্তু এটাই প্রথমবার ও সেরা ছিল এ কনটেন্টে। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা বুলবুল আহমেদ ‘লেনিন’ চরিত্রে অনবদ্য এক স্বপ্নবাজ। তিনি তাঁর জীবন থেকে সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনটি দেখার স্বপ্ন দেখে যান। তিনি রাস্তায় ছিনতাইকারী দেখলে নাগরিক হিশেবে তাঁর কি দায়িত্ব ভাবতে থাকেন, নারীকণ্ঠের ভয় ভয় আওয়াজে ‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী/ আমারে আলোতে ডেকে নাও’ গানটি শুনতে পান অচেনা এক মানবীর কণ্ঠে।
উনিশ শতকে নারীর জাগরণ বেগম রোকেয়া যেভাবে সরেজমিনে দেখিয়েছেন আলমগীর কবির সেই জায়গাটিকে নারীর পাশাপাশি পুরুষের চোখেও দেখে যান। সভ্যতায় চিন্তার প্রগতি এখানেই যা লেনিন বা বুলবুল আহমেদের মাধ্যমে নির্মাতা আলমগীর কবির পুরুষতন্ত্রকে বিট দিচ্ছেন। অসাধারণ ছিল। ছবিতে সমুদ্রসৈকতে জয়শ্রী কবিরের নৃত্যটিতে সাদাকালো ইমেজেই অ্যানিমেশনের ব্যবহার দর্শককে তাক লাগিয়েছিল। এটাও বিপ্লবী ছিল।
‘সীমানা পেরিয়ে’ আরেকটি স্বপ্নের প্রকাশ। আলমগীর কবির শ্রেণিসংগ্রাম দেখান ‘কালু’ বা বুলবুল আহমেদকে দিয়ে। নির্জন দ্বীপে টিকে থাকার লড়াই রবিনসন ক্রুসো যেভাবে করেছিল তা ছিল লেখক ড্যানিয়েল ডিফো-র স্বপ্ন। আলমগীর কবির তাঁর স্বপ্নকে তাঁর মত করে দেখিয়েছেন। বুলবুল আহমেদের লিপে দরদী কণ্ঠে ভুপেন হাজারিকার ‘মেঘ থমথম করে কেউ নেই ‘ এ গানটি অপূর্ব আকুতি তৈরি করে। সে আকুতির মূলে আছে প্রতিকূল আবহাওয়াতে টিকে থাকার লড়াই। এ গানে যে মানবতার প্রতি আবেদন আছে তা একশো গানের থেকে এগিয়ে। এমন উদ্দীপনা থেকেই হালআমলের নির্মাতা কামার আহমেদ সাইমন নির্মাণ করেন ‘শুনতে কি পাও’ ছবি যেখানে তিনি দেখান ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ দুর্গত মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম।
‘টিনা’ বা জয়শ্রী কবিরের লিপে বিখ্যাত গান ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’ গানটির বক্তব্যে সমাজ কাঠামোর গণতান্ত্রিক পরিবেশে নারী-পুরুষ সমতার একটা শক্ত আবেদন আনে। কাগজে-কলমে আর বাস্তবে যেখানে ভিন্নতা থাকে সমাজে। তাই গানের মাঝখানে ‘নিয়ম ভাঙার নিয়ম’-এর কথা বলা হয়েছে। এক নিয়মকে ভাঙতে হবে আর এক নিয়ম দিয়ে। তাইতো কালু-টিনার প্রেম দিয়ে নিয়ম ভাঙার কাজটি আলমগীর কবির করলেন নিজের হাতে। ঘুচে গেল শ্রেণি, ধর্মের দ্বন্দ্ব। সীমানা পেরিয়ে জয় হল প্রেম, মানবতার। ঘুচে গেল ভৌগোলিক ও মানসিক দূরত্ব। ঘটল সস্পূর্ণ নতুন চিন্তার জাগরণ।
‘মহানায়ক’ ছবির কথা আর কি বলব! এপিক ছবি। প্লেবয় বুলবুল আহমেদের বিশ্বভ্রমণ আর ব্যক্তিবুদ্ধির কৌশল স্রেফ অতুলনীয়। ‘director’s credit’ এর সাথে ‘artist credit’ যোগ করে এমন এপিক ছবি হতে পারে নতুবা নয়। এখানেও আলমগীর কবির তাঁর মেধাকে ব্যবহার করেছেন ধর্ম বা শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রগতির দিক থেকে। বুলবুল আহমেদকে দিয়ে নানা দেশের সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে তারপর ধর্মীয় ও শ্রেণির বেড়াজাল ভেঙে একে একে প্রেমের ফাঁদ পেতে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তাদের মধ্যে মিশে যাবার একটা দুর্দান্ত সাফল্য দেখান। প্রতারণা থাকলেও মানবতা, দায়িত্ববোধ মানুষের থাকে তাইতো বুলবুল আহমেদের মুখে তার সহকারীকে বলতে শুনি ‘বিবেক বলে একটা কথা আছে, সে আপনি বুঝবেন না।’ আরো আছে ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’ বা ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয় ‘ গানের আত্মবিশ্লেষণ। আছে কাউকে প্রেমের অভিনয়ে ধোকা দিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। সাদামাটা গানবাজনা, মারপিটের মসলাদার বাণিজ্যিক নায়ক থেকে বেরিয়ে বুলবুল আহমেদ-কে আলমগীর কবির দেখান ‘মহানায়ক’ রূপে যার হিরোইজম ছিল ছবির গল্পের সাথে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আয়োজনে। এটাও নতুন ছিল ঐ সময়ের চলচ্চিত্রে।
একজন কৃষক যেমন তার কর্ষিত জমিতে বীজ বপন করে উর্বর মাটি থেকে কাঙ্ক্ষিত ফসলের স্বপ্ন দেখেন নির্মাতা আলমগীর কবির তেমনিভাবে তাঁর চিন্তার ধারায় নতুনত্ব দিয়ে উর্বর করেছেন আমাদের চলচ্চিত্রের প্রাথমিক ভিত্তিকে। শিল্পের জন্য তিনি ছিলেন চিন্তার চাষী।