Select Page

চেনা ভূগোল পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প

চেনা ভূগোল পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প

স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতক কেটে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের বহুলবর্ণিলতা সে অর্থে সাহিত্য বা পর্দায় উঠে আসেনি। ফাখরুল আরেফীন খান পরিচালিত ‘জেকে ১৯৭১’ সম্পর্কিত ভূমিকায় কথাটি ক্লিশে শোনালেও এর চেয়ে ফকফকা মন্তব্য আপাতত আর নেই। অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, ধীরে বহে মেঘনা, মেঘের অনেক রং বা মুক্তির গানের মতো চলচ্চিত্রে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়া গল্প দেখেছি; কিন্তু কয়েক হাজার মাইল দূরের গল্প আমরা দেখিনি কখনো। বিরল সিনেমাগুলো বাদ দিলে আরেফীন আমাদের যুদ্ধের ক্লিশে বয়ান থেকে মুক্ত রেখেছেন। দর্শক হিসেবে এমন একটি সিনেমা আমরা পাই, যার ষোলো আনাই একদম নতুন।

যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিখ্যাত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে আমাদের আদিখ্যেতার শেষ নেই, কিন্তু এ আয়োজন নিয়ে নেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ‘জেকে ১৯৭১’ সিনেমার শুরু আমাদের সে দিক মনে করিয়ে দেয়, যখন জর্জ হ্যারিসনের বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ’ গানটি নতুন আয়োজনে স্লো পিচে বাজতে থাকে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের কোটি মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশে। সে মানুষগুলো বিশেষ করে শিশুদের সহায়তার জন্য ফরাসি যুবক জ্যঁ ক্যুয়ে ছিনতাই করেছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি উড়োজাহাজ। তার দাবি ছিল, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী ওই উড়োজাহাজে তুলে দিতে হবে এবং তাহলেই কেবল মুক্তি পাবে যাত্রীরা।

এর আগে দুটো ছবি নির্মাণ করেছেন ফাখরুল আরেফীন খান—ভুবন মাঝি ও গণ্ডি। প্রথমটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক, এর পরিসর যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত থেকে শুরু করে গত দশক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেখানে রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ থাকার ঘাত-প্রতিঘাত পাওয়া যায়, সে তুলনায় একটা হ্রস্ব সময় ও রাজনৈতিক পরিসর বেছে নিয়েছেন এবার। ব্যাপ্তির চেয়ে একটি পরিস্থিতিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ ছিল। কাজটি ভালোভাবে সামলিয়েছেন ফাখরুল।

তিনি একাধিক বার বলেছেন, ‘জেকে ১৯৭১’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক ছবি। এমন দাবি ঠিকঠাক। যদিও শিল্পের কাজ স্থানীয় অভিজ্ঞতাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করা। খোদ ১৯৭১ সালের ঘটনাকে অনেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বললেও তা যে থাকেনি জেকে ১৯৭১ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সিনেমার কোনো চরিত্রই বাংলাদেশী নয়। শুরুর টাইটেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছাড়া কোথাও বাংলা শব্দ নেই। আছে ফরাসি, ইতালিয়ান, আমেরিকান, উর্দুভাষী পাকিস্তানিসহ একাধিক দেশের যাত্রী। ফলে ভাষার চেয়ে আমাদের নজর দিতে হয় ঘটনাপ্রবাহ তাদের মনে-চেহারায় কীভাবে ছাপ ফেলে সেদিকে। শরণার্থীদের নিয়ে তারা কী ভাবছেন। মানে কাজে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে না পারলেও মানবিক জায়গা থেকে নিপীড়িতের সঙ্গেই থাকা। এটা দেখার ভঙ্গিটাই জ্যঁ ক্যুয়েকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। তিনি মানুষের ভেতরকার ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছেন।

‘জেকে ১৯৭১’-এর শুরুতেই জ্যঁ ক্যুয়েকে উড়োজাহাজে উঠতে দেখি। গল্পে প্রবেশে নির্মাতা বাড়তি সময় নেননি। তড়িৎভাবে চরিত্রগুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরির চেষ্টা করেন। এখানে আরেকটু ডিটেইল আশা করলেও নানা ধরনের ইমোশনের ভেতর জ্যঁ ক্যুয়ের মতো দর্শকও বিভ্রান্ত হন। তার পরও শেষ পর্যন্ত তারা যেভাবে একাত্ম হন, তা অনিবার্যভাবে মানবতার জয় তুলে ধরে।

কোনো ঘটনার আইনি বিচারই সবকিছু নয়। এর আড়ালে থাকা কার্যকারণও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি অ্যাভিয়েশন আইনে দেখি, নিশ্চয় গুরুতর একটি ঘটনা, যেখানে ফ্লাইটভর্তি যাত্রীর জীবন বিপন্ন। আবার জ্যঁ ক্যুয়ের দাবিকেও আমরা পাশ কাটাতে পারি না; হোক কোনো সাত সমুদ্র দূরের ঘটনা। সিনেমায় এ টানাপড়েন আরেকটু ডিটেইল হতে পারত। অবশ্য ইন্দিরা গান্ধীকে তুলে ধরার সাহস দেখিয়েছেন ফাখরুল।

দুই বিমানকর্মীর উগ্র জাতীয়তাবাদ ও এ সম্পর্কিত ঘটনা ছাড়া সিনেমায় জ্যঁ ক্যুয়ের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিরোধ দেখা যায় না। সে ক্ষেত্রে সিনেমাটিক জায়গা থেকে খানিকটা নাটকীয়তা দরকার পড়ে। আশ্চর্যভাবে সেটা আছে। যাত্রীদের কল্পনা যেমন চমকে দেয়, তেমনি জ্যঁ ক্যুয়ে যখন দোভাষীকে তার পিস্তলটা রাখতে দেন, তার চিত্রায়ণ ছিল ভীষণভাবে থ্রিলপূর্ণ। তবে পুরো ছবির সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা দেখার জন্য দর্শককে একদম শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে।

সত্য ঘটনা বা বাস্তব যা-ই বলি, পূর্ণাঙ্গ মানুষকে তুলে ধরা আসলেই চ্যালেঞ্জ। মানুষ ততটুকুই বাস্তব যতটুকু সে রক্তমাংস ও মননে মিলিয়ে থাকে। যা করতে চায় কিন্তু পারে না, সেটা ছাড়া কাউকে পরিপূর্ণভাবে ধরা যায় না। অনেকে মানুষকে তার স্বপ্নের সমান বলেও দাবি করেন। ‘জেকে ১৯৭১’ সে স্বপ্নটুকু তুলে এনে এর সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে আফসোস, বাংলাদেশে অনালোচিত জ্যঁ ক্যুয়ে জীবদ্দশায় এ ভালোবাসাটুকু দেখে যেতে পারলেন না।

/লেখাটি বণিক বার্তায় পূর্ব প্রকাশিত


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বিএমডিবির সহপ্রতিষ্ঠাতা

মন্তব্য করুন