Select Page

চোখে পানি, মগজে একরাশ প্রশ্ন ও কিছুটা হাহাকার

চোখে পানি, মগজে একরাশ প্রশ্ন ও কিছুটা হাহাকার

 ‘পরাণ’ চোখে পানি, মগজে একরাশ প্রশ্ন, কিছুটা হাহাকার নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হবার সিনেমা…

প্রবাদ আছে, ‘জ্ঞানের যদি ঠিকঠাক ব্যবহার না করা হয়, তবে তা ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়ে যায়’। এই কথাটি আমাদের জীবন এবং সমাজ ব্যবস্থায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা কম-বেশি সবার জানা। যারা এইটুকু পড়েছেন তাদের মনে একটা প্রশ্ন উদয় হতেই পারে, সিনেমা বা সিরিজ নিয়ে লেখা ফিচারে হঠাৎ এই জ্ঞান কচলানো কেনো?

উত্তর একজন সাধারণ সিনেমাপ্রেমী হিসেবে এভাবে দিতে চাই যে, কঠিন এক দুঃসময় পার করা ইন্ডাস্ট্রিতে হাতেগোনা কয়েকজন তরুণ মেধাবী মানুষ অনবরত একটা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিনেমার দিন বদলের আশায়। এখন সেই মানুষগুলোর ইন্ডাস্ট্রির ভালো কিছুর জন্য সকল কষ্ট, মনোবল এবং স্বপ্ন দেখার প্রক্রিয়াটা আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে শুরু করবে যদি আমরা মানে সাধারণ দর্শকেরা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সেই সিনেমাগুলি না দেখে উল্টো সমালোচনা শুরু করি। ভালো একটা কাজকে যেমন সকলের কাছে ভালো বলে একটু উৎসাহিত করা উচিত তেমনি যেটা ভালো লাগেনি সেটা নিয়েও গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার আছে আমাদের।

বর্তমানে প্রায় ঢালের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ইন্ডাস্ট্রিতে হাতেগোনা অল্প কয়টা সিনেমাই পাওয়া যায় যেগুলো সুস্থধারার বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে উতরে যাবার মিনিমাম একটা লেভেল ধরে রাখতে সক্ষম হয়। আশি বা নব্বই দশকের সোনালী দিনে সিনেমায় বাণিজ্যিক সিনেমার জমজমাট নানা উপকরণ (স্টার ইমেজ, সামাজিক ড্রামা, নাচ, গান, ফাইট, প্রেম, পরিবার) মজুদ ছিল। যা দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে টেনে নিয়ে আসতো। এখন সেই ঘরানার সিনেমার সংখ্যা খুবই সামান্য। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে গত ঈদে ‘শান’ এবং ‘গলুই’ দর্শকদের হলে ফিরিয়েছে। দুই ঘরানার দুই বাণিজ্যিক সিনেমার এমন সফলতা আশাবাদী করে আমাদের। এরই ধারাবাহিকতায় রায়হান রাফীর ‘পরাণ’ চমৎকার বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে আমাদের আগ্রহ কাড়তে সক্ষম হয়েছে টিজার, ট্রেলার ও শ্রুতিমধুর গানের কল্যাণে।

বরগুনার এক গা ছমছমে সত্য ঘটনার অবলম্বনে এই ‘পরাণ’ নির্মিত হয়েছে বলে গুঞ্জন থাকলেও সিনেমাটি দেখার পর মনে হয় নির্মাতা, গল্পকার, চিত্রনাট্যকার মিথটা নিয়ে জাস্ট চরম একটা খেলা খেলে দিয়েছে। আমাদের আন্দাজ বা অনুমানের বাইরে যেয়ে এক ভিন্ন গল্পের দেখা মিলেছে। একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প থেকে কীভাবে ‘পরাণ’ চমৎকার থ্রিলার ঘরানার সিনেমা হিসেবে বেশ ভালোভাবে উতরে গেছে তা না দেখে বোঝার উপায় নাই।

একটি কথা হয়তো অনেকেরই শুনতে বা পড়তে ভালো লাগবে না। তবে বাস্তবিক সত্য হচ্ছে বিদ্যা সিনহা মিম, শরিফুল রাজ এবং ইয়াশ রোহানের মতো দক্ষ অভিনয়শিল্পী থাকা সত্ত্বেও সিনেমার সাইনবোর্ড কিন্তু দর্শকদের পালস খুব ভালোভাবে বোঝা তরুণ রায়হান রাফী।

রাফী তিন বছরের গ্যাপ শেষে ফিরেছেন রূপালি পর্দায়। ‌‘পোড়ামন-২’ ও ‘দহন’-এর পরে ‘পরাণ’ জয়ে ফেরাটা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্ব বহন করে। অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করা এই নির্মাতা কতটা যত্নশীল ছিলেন তা বোঝা যায় সিনেমার প্রতিটা ফ্রেম দেখেই। পরিচালনার পাশাপাশি সংলাপ ও চিত্রনাট্যতেও তিনি কাজ করেছেন গল্পকার, চিত্রনাট্যকার শাহজাহান সৌরভের সাথে। এই সেগমেন্টেও তারা দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন অসাধারণভাবে।

সিনেমার সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, অনেকদিন পরে একটি সিনেমা প্রথম থেকে একেবারে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত সাসপেন্স এবং থ্রিল ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে পুরোপুরিভাবে। কোনো বিরক্তি ছাড়াই দেখা যায় শেষ পর্যন্ত। প্রেক্ষাগৃহে কিছু দৃশ্যে যেমন হাততালি দিতে হবে, তেমনি শিস বাজাতেও হবে।

আইসক্রিম, ন ডরাই, গুণিন এর মতো বেশ ভালো এবং ভিন্নধর্মী নির্মানের সাথে যুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে একজন অভিনেতা হিসেবে শরিফুল রাজের ‘পরাণ’ সিনেমায় মফস্বলীয় মাস্তান ‘রোমান’ চরিত্রে নিজের সেরাটা তিনি দিলেন কিনা সেই প্রশ্ন তুলে রাখলাম দর্শকদের জন্য।

তিন বছরের বিরতির পর লাক্স সুন্দরী থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী বিদ্যা সিনহা সাহা মিম ফিরলেন ‘পরাণ’ দিয়ে। বলতে বা লিখতে একটু লজ্জা লাগলেও এটা সত্য যে যেকোনো যুবকের বুকে ঝড় তোলার মতো লাস্যময়ী,  স্নিগ্ধ এবং পাশের বাড়ির মিষ্টি মেয়ে ‘অনন্যা’ হিসেবে তিনি ঝড়ই তুলেছেন। এক হিসেবে সিনেমার গল্প এগিয়েছে অনন্যা চরিত্রের মধ্য দিয়েই। দুই তরুণের সাথে প্রেম, লুকোচুরি, দ্বিধা, নিজেকে নিজেই বুঝতে না পারা এক অষ্টাদশী তরুণী হিসেবে মিমের চরিত্রটি নায়িকা বা অভিনেত্রীদের নিয়ে এমনভাবে যে ভাবনার একটা শুরু হয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে সেটাও কম স্বস্তির নয়। এবং ‘সিফাত’ চরিত্রে ইয়াশ রোহান ছিলেন ঠিকঠাক। ‘স্বপ্নজাল’ সিনেমার সেই প্রেমিক ছেলেটা এই সিনেমায় যতটা সময় পেয়েছেন পুরোটাই ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন।

মূল তিন চরিত্রের বাইরে টেলিভিশন অভিনেত্রী রোজি সিদ্দিকী যেন রীতিমতো আগুনই ধরিয়েছেন স্ক্রিনে। তার বয়সের একজন অভিনেত্রীকে এমন দমদার  ভিলেন হিসেবে স্ক্রিনে প্রেজেন্ট করার সাহস দেখানোর জন্য রায়হান রাফীর প্রতি কৃতজ্ঞতা। এবং রোজি সিদ্দিকীকে ধন্যবাদ জানাতেই হয় এমন চরিত্রে অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। শহীদুজ্জামান সেলিম, শিল্পী সরকার অপু, রাশেদ মামুন অপু সাবলীল ছিলেন যার যার চরিত্রে। তবে আরেকজনের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। নাসির উদ্দিন খান যা করে দেখালেন তা আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বলিউডে প্রয়াত ইরফান খান বা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো শক্তিশালী অভিনেতাদের করতে দেখি। এক্সপ্রেশন, সংলাপ ডেলিভারি এবং বডি ল্যাংগুয়েজ তাকে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়। স্ক্রিনে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পুরোটা সময়। নির্মাতারা সামনের দিনে এই অভিনেতাকে নিয়ে আরো ভিন্ন এবং ব্যতিক্রমী চরিত্রে ভাববেন সেটাই কামনা!

সিনেমা আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি বলেও একটা কথার প্রচলন রয়েছে। তবে সেই প্রচলিত ধারা থেকে অনেক দূরে সরে যাবার পরও ‘পরাণ’ আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার, তাদের মধ্যকার খুনসুটি, রাজনৈতিক নেতা-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় মাস্তানদের মধ্যকার নানারকম কানেকশন, ত্রিভুজ প্রেম, শ্রুতিমধুর সুন্দর কিছু গান, অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, যুতসই এডিটিং সব মিলিয়ে ‘পরাণ’ নিঃসন্দেহে এক সুন্দর নির্মাণ। মিছিল সাহার সিনেমাটোগ্রাফি এবং সিমিত রায় অন্তরের এডিটিং এক অন্যরকম ভালোলাগার সৃষ্টি করে। ময়মনসিংহের এমন অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর আগে অন্য কোনো সিনেমায় এতো নান্দনিকভাবে উঠে এসেছে কিনা আমার জানা নেই!

ভালো সিনেমা আসেনা বলে হলে যাই না এমন মন্তব্যকারীদের জন্য অনুরোধ একবার হলে গিয়ে ‘পরাণ’ দেখুন। আমাদের নিজেদের গল্প, নিজেদের জীবন, নিজেদের নানারকম জানা-অজানা সামাজিক চিত্রের এমন অপরূপ নির্মাণ মিস করা যতটা না ভুল ঠিক ততোটাই লেখার প্রথম লাইনের মতো আবারো বলতে/লিখতেই হয়, এবার আমাদের এগিয়ে আসার পালা নীরবতা ভেঙে। আমরা যদি এমন একটি পরাণের কাছাকাছি যাবার উৎসাহ দেখাতে না পারি তাহলে সামনে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখানো তরুণদের মনোবল ভেঙে যেমন দেয়, তেমনি নতুন স্বপ্ন দেখতেও বাধা দেয়!! তাই সিদ্ধান্তটা এখন আমাদের হাতে…


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন