Select Page

অন্তর জ্বলেছে…

অন্তর জ্বলেছে…

অন্তর জ্বালা
পরিচালক : মালেক আফসারী
অভিনয়ে : জায়েদ খান, পরী মনি, জয় চৌধুরী, মৌমিতা মৌ, কাজল, বড় দা মিঠু, রেহানা জলি, অমিত হাসান, সাংকো পাঞ্জা, চিকন আলী, বাদল, জ্যাকি ও ববি।
রেটিং : ৩/ ৫

একে তো নকল ছবি, তার ওপর পরিচালক মালেক আফসারী বলেছেন-ইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রাখতে হলে মৌলিক ছবি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। মৌলিক ছবি নির্মাণ মানেই নাকি প্রযোজকের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।

এসব বিবৃতি ‘অন্তর জ্বালা’ দেখবার ব্যাপারে বারবারই আমাকে অনাগ্রহী করে তুলেছিল। তাছাড়া ১৯৮৩ সালে পরিচালনায় অভিষেক হওয়া পরিচালক ২০১৭ সালে এসে কতটা এই সময়কে পর্দায় ধারণ করতে পারবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা জায়েদ খান এবং পরী মনিকে এর আগে কোনো শক্তিশালী চরিত্রে দেখিনি। তাদের কাছ থেকে নির্মাতা কতটা কাজ বের করে নিতে পারবেন, এ প্রশ্ন মাথায় নিয়েই প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করেছি।

তামিল ছবি ‘ভেয়িল’ (২০০৬) দেখিনি। তবে ইতালি ছবি ‘সিনেমা প্যারাডিসো’ (১৯৮৮) আমার প্রিয় একটি ছবি। শুনেছি ‘সিনেমা প্যারাডিসো’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ‘ভেয়িল’-এর প্রথম তিনভাগ লেখা হয়েছিল। তবে আসল-নকল এসব ভুলে শুধুমাত্র বিনোদিত হবার নিমিত্তে মধুমিতার পর্দায় চোখ রেখেছি। এক কথায় বললে, একজন সিনেমা পাগল ভক্তের জীবনের গল্প ‘অন্তর জ্বালা’। তামিল ছবিতে প্রধান চরিত্র পাগল থাকেন নায়ক মারুদুর গোপালান রামচান্দারানের জন্য। আমাদের ‘আলাল’ অর্থাৎ জায়েদ খান প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্নার ভক্ত। এ গল্পে ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের অন্তর জ্বলে। বাবা-মার জন্য ছেলের কিংবা ছেলের জন্য বাবা-মার অন্তর জ্বলে। প্রেমিকের জন্য প্রেমিকার হাহাকার, আবার প্রেমিকা হারিয়ে প্রেমিকের অন্তর জ্বলে।

সরাসরিই বলি, না চাইতেও বেশ কিছু নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে ‘অন্তর জ্বালা’ দেখতে গিয়েছিলাম। তবে ছবি দেখা শেষে খেয়াল করলাম আমার অন্তর সত্যি সত্যিই জ্বলছে। আলাল, দুলাল, সোনা চরিত্রগুলোর জন্য বাড়ি ফিরেও আমার মায়া হচ্ছে। নকল গল্প নির্বাচন করার জন্য নির্মাতা অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন না। তবে একটি ব্যাপারে তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, গল্প বলার ক্ষেত্রে তিনি নিজের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পুরোপুরি সৎ ছিলেন। কোনো কিছু প্রমাণ করার জন্য নয়, শুধুমাত্র দর্শকদের বিনোদন দেবার চেষ্টা করে গেছেন প্রতিটি ফ্রেমে। ‘অন্তর জ্বালা’ নির্মাণের ক্ষেত্রে মালেক আফসারী যে নিজের মেধার সবটুকু ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তা পর্দায় সুস্পষ্ট। একটি দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য যত ধরনের আয়োজন করা যায়, সবই তিনি করেছেন। গ্রাম বাংলার রূপ, গ্রীষ্ম থেকে শীত-ষড়ঋতুর প্রতিটি চরিত্রই নান্দনিকভাবে এসেছে এই ছবিতে। ইদানিংকালের অনেক বাংলা ছবিতেই আগের মত আবেগ খুঁজে পাওয়া যায়না।

তবে এ ছবির বেশ কিছু দৃশ্য দর্শকের মন ছুঁয়ে যাবে। কয়েকটি দৃশ্যের কথা আলাদাভাবে বলা যায়, যেমন: শিশু আলালকে নগ্ন করে বেধে রাস্তায় ফেলে রাখা, প্রেক্ষাগৃহে নায়ক-নায়িকার প্রেম, প্রজেকশন কক্ষে নায়ক-নায়িকার হাতে নাতে ধরা পড়া, সোনার বাবার আলালকে ভর্ৎসনা করা, সোনা চরিত্রের শেষ দৃশ্য, বাড়ি ফিরে এসে আলালের বাবার মুখোমুখি হওয়া, ভাই দুলালকে ফিরে পাওয়া, মায়ের সাথে পুনর্মিলন, পরিণত আলালকে বেধে বাবার প্রহার করা, বাস স্ট্যান্ডে অ্যাকশন এবং আলালের সেই সংলাপ (আমার জীবনের গল্পটা রাস্তার ধুলার মত) বলার দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে এবং ভাবতে বাধ্য করেছে, মালেক আফসারী ২০১৭ সালে এসেও দর্শকদের হৃদয়গ্রাহী করে গল্প বলার বিদ্যা ভুলে যাননি। সময়কে ধারণ করেছেন তিনি। বানিজ্যিক উপাদান না থাকার অজুহাত দেখিয়ে ‘আমরা রোদে পুড়ি’ গানটি না রাখলেও পারতেন। তবে সাহসী পরিচালক গানটি রেখেছেন এবং আমাদের মুগ্ধ করেছেন। সিনেমা মানেই তো বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিটি চরিত্রের উপস্থাপন। এ ক্ষেত্রে পরিচালক মালেক আফসারী এবার ‘অন্তর জ্বালা’য় শতভাগ সফল। প্রতিটি চরিত্রের কাছ থেকে সেরা অভিনয় আদায় করে ছেড়েছেন তিনি।

এক কথায় বললে, এ ছবির প্রাণ ‘আলাল’ চরিত্রের জায়েদ খান। ২২টি ছবিতে যার অভিনয় আমার মন ছুঁয়ে যেতে পারেনি, সেই জায়েদ খান এবার আলাল চরিত্রে অভিনয় করে ২০১৭ সালে আমার প্রিয় তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। কারণ এ ছবিতে আমি আলালকে দেখেছি, জায়েদ খানকে খুঁজে পাইনি (‘পোস্টার লাগাবো’ গানটি ছাড়া)। সবচাইতে ভালো লেগেছে, ‘অন্তর জ্বালা’য় জায়েদ নায়ক হতে চাননি। অভিনেতা হতে চেয়েছেন। যে কারণে প্রযোজক হয়েও আরেক নায়ক জয় চৌধুরীকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। ৫টি গানের মধ্যে মাত্র ২টি গানে উপস্থিত থেকেছেন। এ বিষয়টিকেও সাধুবাদ জানাতে হয়। অনেক দৃশ্যে চোখ দিয়ে, অভিব্যক্তি দিয়ে অভিনয় করেছেন। মায়ার বাঁধনে জড়িয়েছেন দর্শকদের। যদিও সংলাপ প্রক্ষেপণে এবং উচ্চারণে ভবিষ্যতে আরো যত্নশীল হতে হবে তাকে। তবে সব মিলিয়ে জায়েদ খান এবার সফল। ছবির ব্যবসায়িক ফলাফল যাই হোক, ‘অন্তর জ্বালা’ দিয়ে জায়েদ খান দর্শকদের অন্তরে বিরাজ করবেন দীর্ঘদিন। চিত্রনায়িকা পরী মনি যেমন ‘অন্তর জ্বালা’র সোনামণি চরিত্র দিয়ে স্থায়ীভাবে দর্শকের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। মাত্র ৪০ মিনিটের স্বল্প উপস্থিতি। অথচ কী দুর্দান্ত অভিনয়! যতক্ষণ পরী মনি ছিলেন, রঙ ছড়িয়েছেন। পুরো সময় জুড়ে আলোকিত ছিল পর্দা। কী মায়া তার চোখে, কী ভালোবাসা তার সংলাপে, কী আবেগ তার পুরো অবয়বে। আড়াই ঘন্টার অনেক ছবিতেই পরী মনিকে এর আগে নায়িকা নামের শ্যোপিস হতে দেখেছি। তবে এবার স্বল্প সময়ের চরিত্রে পরী মনি তার মেধার পুরোটা উজাড় করে দেবার সুযোগ পেয়েছেন এবং তিনি তার সেরা অভিনয় দিয়ে সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে ‘ঐ জানোয়ারের বাচ্চারা, আমার আলালরে ছাইড়া দে’-এই সংলাপ বলার দৃশ্যে পরীমণির অভিনয় তাকে এ বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের তালিকায় শামিল করবে। ছবি শেষ হবার বেশ আগেই পরীমণির চরিত্রের সমাপ্তি হলেও শেষ দৃশ্য পর্যন্ত পরী মনির জন্য দর্শক হাহাকার করেছেন। আরেকটু দেখবার আশায় আফসোস করেছেন। আর এখানেই পরী মনির বিজয়।

বিজয় পেয়েছেন ছবির আরেক নায়ক জয় চৌধুরীও। দর্শকদের তাকে নিয়ে কোনো আশা ছিলনা। কিন্তু ‘দুলাল’ চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করে রীতিমত চমকে দিয়েছেন তিনি। অভিনয়, অভিব্যক্তি, অ্যাকশন, নাচে ভীষণ সাবলীল জয়ের উচ্চারণের এবং পোশাকের ব্যাপারে আরো অনেক যত্নশীল হতে হবে। তার কণ্ঠস্বর ও শারীরিক গঠনও নায়কোচিত নয়। তবে সুঅভিনয় দিয়ে সব সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পেরেছেন জয়। বিশেষ করে জায়েদ খানের সঙ্গে দৃশ্যগুলোতে জয়ের আবেগী অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। তুলনায় জয়ের নায়িকা মৌমিতা মৌর ‘রূপা’ চরিত্রটি আপাদমস্তক আবেগী, গল্প প্রধান ছবিকে ছন্দপতন করেছে বার বার। যদিও মৌমিতা মৌ-ও বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। তবে গানের দৃশ্যে তার মেদবহুল শরীর ও খোলামেলা উপস্থিতি আমাকে অন্তত বিনোদন দিতে পারেনি। মেদ ঝরিয়ে অভিয়ে মনোযোগী হলে মৌমিতা মৌয়ের সফল হবার সম্ভাবনা প্রবল।

অন্যান্য চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে কাজল বেশ ভালো করেছেন। অভিনয়ে তার নিয়মিত হওয়া উচিত। বড়দা মিঠু নতুন করে তার জাত চিনিয়েছেন এ ছবিতে। তার শক্তিশালী অভিনয় এ ছবির সম্পদ। রেহানা জলি-ও আর দশটা ছবির চেয়ে এখানে বেশ সপ্রতিভ। তার বাস্তবিক অভিনয় মন ছুঁয়েছে। অমিত হাসান, সাংকো পাঞ্জা, চিকন আলী, বাদল, ববি, জ্যাকি নিজেদের মেধা প্রকাশের তেমন কোনো সুযোগ পাননি। তবে নির্মাতাকে ধন্যবাদ দেবো, এ ছবিতে শিশুশিল্পীদের দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করিয়ে নেবার জন্য। সাধারণত: বাংলা ছবিতে শিশুশিল্পীরা বেশ কৃত্রিম অভিনয় করেন। তবে এ ছবির প্রায় প্রতিটি শিশুশিল্পীর (বিশেষ করে আমরা রোদে পুড়ি গানের শিশুশিল্পীরা) অভিনয় ছিল সাবলীল। পরিণত আলাল এবং কামরুন্নাহারের ছোটবেলার চরিত্রে হুবুহু জায়েদ খান এবং কাজলের মত দেখতে শিশুশিল্পীদের বের করে এনেছেন নির্মাতা। এ বিষয়টির জন্যও তাকে কৃতিত্ব জানাতে হয়।

‘অন্তর জ্বালা’ ছবিতে গান রয়েছে ৫টি। এর মধ্যে ‘আমরা রোদে পুড়ি’ এবং ‘ছোট ছোট কিছু আশা’ গানের সুর নকল হলেও মূল গানের চেয়ে এ গান দুটোই আমার কাছে বেশি শ্রুতিমধুর মনে হয়েছে। বিশেষ করে দুটি গানে এবং আবহ সংগীতে এস আই টুটুলের কণ্ঠ অসাধারণ লেগেছে। ‘ছোট ছোট কিছু আশা’ গানে ন্যান্সির কণ্ঠ আবারো প্রমাণ করেছে কেন তিনি সেরা। সুদীপ কুমার দীপ গীতিকার হিসেবে বেশ ভালো লিখেছেন। ‘পোস্টার লাগাবো’ গানটির প্রয়োজন ছিলনা এ ছবিতে। গানটি দর্শককে গল্প থেকে বের করে এনেছে। আলাল এবং সোনামণির চরিত্র এ গানে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তাছাড়া জায়েদ খানকে পুরো ছবির মধ্যে শুধু এই একটি গানেই ভালো লাগেনি। ‘মধু কই কই’ ও ‘তুই ফিরে তাকালে’ আমজনতার জন্য বানিজ্যিক গান। মায়াভরা গল্পে গান দুটি আমার কাছে বিষ খাওয়ানোর মতই। এ গান দুটি না থাকলে সার্বিকভাবে ছবির শিল্পমান আরো বেড়ে যেত। তবে জয় এবং মৌমিতা মৌ ভালো নেচেছেন। তবে ‘অন্তর জ্বালা’ ছবির অন্যতম সম্পদ আলী আকরাম শুভ’র আবহ সংগীত। আবহ সংগীতও যে একটি ছবির বড় চরিত্র হয়ে উঠতে পারে, আলী আকরাম শুভ সেটি আবারো বুঝিয়েছেন। প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্যে আবহ সংগীতই আমাকে গল্পের সাথে ধরে রেখেছিল।

আব্দুল্লাহ জহির বাবু নকল গল্প নির্বাচন করলেও তার সংলাপ ছিল সহজ-সরল, কিন্তু অর্থবহ। আমাকে মুগ্ধ করেছে। চিশতি জামালের সম্পাদনা ভালো। তবে আরো ভালো হতে পারতো। লাল মোহাম্মদের চিত্রগ্রহণ আর দশটা মূল ধারার বানিজ্যিক ছবির চেয়ে বেশ ভালো। বিশেষ করে কয়েকটি দৃশ্যে বেশ ভালো। ‘আমরা রোদে পুড়ি গানের চিত্রায়ণ’ নকল হলেও বাংলার রূপ আমার মন ছুঁয়েছে। এ গানের নৃত্য পরিচালনাও ছিল চমৎকার। কালার গ্রেডিং বেশ কিছু দৃশ্যে ভালো লাগেনি। পোষাক ও রূপসজ্জা বেশ বাস্তবসম্মত ছিল। শুধু দু-একটি দৃশ্যে জায়েদ খান ও পরী মনির কালো মেকআপের ধারাবাহিকতা ছিল না। ‘ছোট ছোট কিছু আশা’ গানের শুরুতে প্রজেকশন কক্ষে পরীমণির মেকআপ এবং হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে জায়েদ খানের সংলাপ ‘আমার হিরো মইরা গেছে?’ বলার দৃশ্যে নায়কের অতিরিক্ত কালো মেকআপ দৃষ্টিকটু লেগেছে। আলোক সম্পাত কিছু দৃশ্যে অসাধারণ। তবে মধুমিতায় বেশ কিছু দৃশ্যে অন্ধকার লেগেছে। শিল্প নির্দেশনায়ও বাস্তবিক ব্যাপার ছিল। বিএফডিসির সনাতন সেট ছিলনা। এ বিষয়টি চোখে আরাম দিয়েছে।

তবে এত ভালোর উল্টো পিঠে কিছু মন্দ কথাও বলতেই হয়। এটা ঠিক, ‘অন্তর জ্বালা’ আমাকে ভীষণভাবে বিনোদিত করেছে। তারপরও মোটা দাগের কিছু ভুল এড়িয়ে যেতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে নির্মাতার পাশাপাশি সেন্সর বোর্ড সদস্যদের ওপরও প্রায়ই মনঃক্ষুন্ন হই আমি। প্রায়ই নির্মাতারা Interval শব্দের বানান লিখতে গিয়ে Intervel লিখেন। এ ছবিতেও একই ভুল হয়েছে। বাংলা ছবিতে বাংলা শব্দ বাদ দিয়ে ভুলভাল ইংরেজি লেখার প্রয়োজনটা কি? তাছাড়া এ ছবিতে পিরোজপুরের গল্প বলা হয়েছে। অথচ কোনো চরিত্রের মুখেই বরিশালের ভাষা পেলাম না। প্রয়াত নায়ক মান্নার চলচ্চিত্র এবং মৃত্যুর যে দৃশ্যগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তা যেনতেনভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। পোস্ট প্রডাকশন আরো নিখুঁত হতে পারতো। বিশেষ করে জি সিরিজ, অনুপম মিউজিকের লোগো সরিয়ে দেয়া যেত। তাছাড়া এ ছবিতে ‘কাসেম মালার প্রেম’ (১৯৯১) ছবির ডিজিটাল ব্যানার দেখানো হয়েছে। ২৬ বছর আগে কি এ দেশে ডিজিটাল ব্যানার ছিল? ২০০৭ সালের গল্পে বিকাশ, স্মার্ট ফোন দেখানো হয়েছে। যতদূর জানি বিকাশের যাত্রা এ দেশে শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। স্মার্ট ফোনের ব্যবহারও ঠিক কাছাকাছি সময়ে। এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া যেত। সবচেয়ে বেশি যেটি চোখে লেগেছে, কিশোর আলাল মান্না অভিনীত ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান’ চলচ্চিত্র দেখেন। আর পরিণত আলাল দেখেন মান্নার ‘পিতা মাতার আমানত’। অথচ দুটি ছবিই মুক্তি পেয়েছিল মান্না মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে (গল্পে তখনও নায়ক মান্না বেঁচে আছেন)। ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান’-এর নতুন করে ব্যানার করতে গিয়ে লেখা হয়েছে ‘শ্রেষ্ট সন্তান’। এখানেও বানান বিভ্রাট। আরেকটি দৃশ্যে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে থেকে দেখানো হয়েছে মান্না অভিনীত চলচ্চিত্র ‘মান্না ভাই’। আর ভেতরে চলছে ‘মনের সাথে যুদ্ধ’। অথচ প্রেক্ষাগৃহটি মাল্টিপ্লেক্সও নয়। কিশোর আলাল দেখেন ‘রাজপথের রাজা’ (১৯৯৫)। আর পরিণত আলাল দেখেন ‘টোকাই রংবাজ’ (১৯৯৯)। ৪ বছরের ব্যবধানে আলাল কি খেয়ে এতটা বড় হয়ে গেল, জানতে চাই। মান্নাকে উপস্থাপন করা যেতেই পারে। কিন্তু মান্নার যারা অন্ধ ভক্ত, তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে হলেও তথ্যগত এই ভুলগুলোর ব্যাপারে সাবধানী হওয়া উচিত ছিল। কারণ মান্না এখনো হারিয়ে যাননি। বেঁচে আছেন শত কোটি দর্শক হৃদয়ে।

উচ্চারণের ব্যাপারে জায়েদ খান, জয়, মৌমিতা তিনজনেরই আরো যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল। স্ক্রিপ্টকে ‘ইস্ক্রিপ্ট’ বলেছেন ডাবিং শিল্পী চরিত্রে অভিনয় করতে আসা মৌমিতা। কেন? তার ভুল ধরিয়ে দিতে আসা জয় নিজেই ‘টেকনোলজি’ শব্দের ভুল উচ্চারণ করেছেন। কেন? আরেকটি দৃশ্যে জায়েদ খানকে যখন তার বাবা শার্ট খুলে প্রহার করেন, সে দৃশ্যে জায়েদ খানের শারীরিক গঠন আরো রোগা হতে পারতো। পিরোজপুরের বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা-নেত্রকোনা-ঢাকার বাস কেন, বুঝিনি। আশা করছি এসব ভুলগুলো ‘হতেই পারে’ না ভেবে কি করে ভুল শুধরে একটি চলচ্চিত্রকে আরো সমৃদ্ধ করা যায়, ভবিষ্যতে সে চেষ্টাই করবেন নির্মাতা। কারণ আমি বিশ্বাস করি, চিত্রনাট্যকার আব্দুল্লাহ জহির বাবু এবং নির্মাতা মালেক আফসারী শুধু নকল ছবিই লিখতে এবং নির্মাণ করতে পারেন না। তাদের পক্ষে সম্ভব অসাধারণ মৌলিক কাহিনী লেখা ও নির্মাণ করা। নকল গল্পের প্রতি যে যতেœর ছাপ তারা দিয়েছেন, সেই শ্রম ও আন্তরিকতা যদি মৌলিক গল্পে দেয়া হতো আমাদের বুকটা কিন্তু গর্বে ভরে যেত। আর তাই ‘অন্তর জ্বালা’ দেখে আমরা বিনোদিত হয়েছি ঠিকই। তবে অহংকার করতে পারছি না। আর তাই মালেক আফসারীর কাছে অনুরোধ, আপনার পরবর্তী চলচ্চিত্রটি মৌলিক গল্পের দেখতে চাই। ‘অন্তর জ্বালা’ ব্যবসাসফল না হলে সিনেমা ছেড়ে দেবেন-এ ধরনের বিবৃতি দিয়ে দর্শক আকর্ষণ করার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার। আপনার মেধাই আপনার পক্ষে কথা বলবে। কারণ যে নির্মাতা নকলটা এত ভালো করতে পারেন, ২৪ বছর চলচ্চিত্র পরিচালনা করেও নিজেকে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন, তিনি মৌলিক কাহিনী দিয়েও পর্দা কাঁপাতে পারবেন-এই স্বপ্ন কিন্তু আমরা দেখতেই পারি। আপনি কি আমাদের স্বপ্নকে সমর্থন দেবেন?

*লেখাটির সংক্ষেপিত আকার সমকাল ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত।


মন্তব্য করুন